চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্ব
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকা, এরিয়ান, প্লুতার্ক, স্ট্র্যাবো, প্লিনির মত লেখকদের বিবরন থেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রশাসনিক ব্যবস্থাসহ তার সম্পর্কে বহু তথ্য জানা যায় । খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের প্রথমভাগে মগধের ক্ষমতা উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল প্রধানত নন্দবংশের শাসকদের আগ্রাসী নীতির সুবাদে । নন্দবংশের পর মগধে ক্ষমতায় আসেন মৌর্যবংশের শাসকেরা এই নতুন শক্তির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম শাসক ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য । তাঁর জন্মবৃত্তান্ত এবং বংশ পরিচয় সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্যের অভাব রয়েছে । অনুমান করা হয় যে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য অরাজতান্ত্রিক গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত ছিলেন । তবে যাইই হোক জাস্টিনের তথ্য থেকে বোঝা যায় যে, প্রায় ভুঁইফোর অবস্থা থেকে চন্দ্রগুপ্ত-এর ক্ষমতা লাভ করেছেন ।
গ্রিক লেখকদের বর্ননা অনুযায়ী আলেকজান্ডারের ভারত ত্যাগের পরপরই চন্দ্রগুপ্ত (স্যান্ডোকোট্রস) এক বিশাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন এবং আলেকজান্ডার কর্তৃক নিযুক্ত গ্রিক প্রশাসকদের হত্যা করে ম্যাসিডোনীয় অধিকারের শেষ চিহ্নটুকুও মুছে দেন ।
পন্ডিত মহলে মতপার্থক্য রয়েছে যে, তিনি প্রথমে গ্রিক শাসনের উৎখাত ঘটান না, নন্দবংশের অবসান ঘটান । নানা তথ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করার পর ঐতিহাসিক ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন যে, প্রথমে চন্দ্রগুপ্ত নন্দবংশের শেষ শাসক ধননন্দকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং মগধে মৌর্য শাসনের প্রতিষ্ঠা করেন । (খ্রিঃপূঃ ৩২৫/৩২৪ অব্দ) রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নন্দ সম্রাটকে পরাজিত করে কীভাবে তিনি ক্ষমতা দখল করেছিলেন তার বর্ননা পরবর্তীকালের রচনা মিলিন্দপঞহো, মুদ্রারাক্ষস এবং মহাবংশটীকাতে আছে । মগধে ক্ষমতা লাভ করার পরই চন্দ্রগুপ্ত উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রসারিত নন্দদের সাম্রাজ্যভুক্ত ভূখন্ড নিজ অধিকারে নিয়ে আসেন এবং একারনেই পাঞ্জাব এবং উত্তর পশ্চিম এলাকায় গ্রিক প্রশাসকদের বিরুদ্ধে তার সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে যায় । জাস্টিনের বর্ননাতেও সহমত ব্যক্ত হয়েছে । সম্ভবত চন্দ্রগুপ্ত গ্রিক প্রশাসকদের উৎখাত করেছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব ৩১৭/৩১৬ ও পরে । এই দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সাফল্যটি এসেছিল মৌর্য শাসন প্রতিষ্ঠার প্রায় সাত-আট বছর পর ।
গ্রিক প্রশাসকদের বিরুদ্ধে তাঁর সাফল্যকে অনেক ঐতিহাসিক বিদেশী শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তি হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন । পরাধীনতার হাত থেকে দেশীয় স্বাতন্ত্রের কৃতিত্বও তাঁকে দেওয়া হয়েছে । গ্রিক প্রশাসকদের বিরুদ্ধে তাঁর জয়লাভের ফলে তিনি আরও একটি রাজনৈতিক ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন । আলেকজান্ডারের বিজিত ভূখন্ডে পূর্বদিকের ক্ষমতায় আসেন সেলুকাস । সিন্ধু উপত্যকায় গ্রিক শাসনের অপসারন এবং চন্দ্রগুপ্তের ক্ষমতাবৃদ্ধির দরুন সেলুকাস ও চন্দ্রগুপ্তের মধ্যে সংঘাত দেখা যায় । গ্রিক বিবরনী থেকে জানা যায় যে, একটি মৈত্রী চুক্তির দ্বারা উভয়পক্ষের শত্রুতার অবসান ঘটে । শর্ত অনুযায়ী সেলুকাস চন্দ্রগুপ্তকে প্যারোপ্যামিসাডাই, অ্যারোকোসিয়া এবং গ্রেডোসিয়া – এই তিনটি ভূখন্ড ছেড়ে দেন । বিনিময়ে চন্দ্রগুপ্ত) সেলুকাসকে পাঁচশোটি রণহস্তি উপহার দেন । কিন্তু এই চুক্তির বলে আবিয়া বা হেবাট অঞ্চল চন্দ্রগুপ্তের কাছে হস্তান্তরিত হওয়ার কোনো তথ্যের ভিত্তি নেই ।
ভিনসেন্ট স্মিথ প্রথম উল্লেখ করেন যে, সেলুকাস ও চন্দ্রগুপ্তের সংঘর্ষের পর একটি বৈবাহিক মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং চন্দ্রগুপ্ত সেলুকাসের কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন । এই মত কার্যত মেনে নিয়েছিলেন ঐতিহাসিক হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীও । কিন্তু স্ট্র্যাবো, আপ্পিয়ান, প্লুতার্ক ও জাসটিনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষনের পর ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমান করেন যে, সেলুকাস ও চন্দ্রগুপ্ত নিজেরা কোনো বৈবাহিক মৈত্রী চুক্তির শরিক ছিলেন না । ঐতিহাসিক রোমিলা থাপারের মতে, এই চুক্তির মধ্য দিয়ে সম্ভবত গ্রিক ও ভারতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে আন্তর্বিবাহরীতি সিদ্ধ বলে পরিগণিত হতে থাকে । এটাই সম্ভবত ভারতবর্ষের ইতিহাসে প্রথম আর্ন্তজাতিক চুক্তি যার সঙ্গে প্রথম মৌর্য শাসক চন্দ্রগুপ্তের নাম জড়িয়ে আছে ।
মৌর্য সাম্রাজ্যের ভূখন্ড সম্প্রসারিত হয়ে যে প্রায় সর্ব ভারতীয় আকার নিয়েছিল তার কৃতিত্ব অনেকটাই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রাপ্য কারন তাঁর পুত্র বিন্দুসারের আমলে সাম্রাজ্যের বিস্তার বিশেষ ঘটেনি এবং পৌত্র অশোক কেবলমাত্র কলিঙ্গই জয় করেছিল । অতএব, অনুমান করা যায় যে, যে বিশাল এলাকার উপরবিন্দুসার ও অশোক রাজত্ব করতেন তার বেশীরভাগটাই তাদের অধিকারে এসেছিল উত্তরাধিকার সূত্রে । সমরকুশলী রাজ্য বিজেতা ও মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা তাঁর অসামান্য কৃতিত্ব ছাড়াও তিনি একজন দক্ষ প্রশাসকও ছিলেন । জৈন গ্রন্থ রাজাবলীকথে অনুসারে চব্বিশ বছর রাজত্ব করার পর জৈন ধর্মে অনুরক্ত হন এবং ভদ্রবাহুর সাহচার্যে দাক্ষিণাত্যের কর্ণাটকে চলে যান এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয় আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দে।
চন্দ্রগুপ্তের প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য আমাদের প্রধানত মেগাস্থিনিসের রচনা এবং কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের উপর নির্ভর করতে হয় । রুদ্রদামনের জুনাগড় শিলালেখ, দিব্ববদান, মুদ্রারাক্ষস, জৈন পরিশিষ্টপর্বন গ্রন্থ থেকেও চন্দ্রগুপ্তের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে জানা যায় । অশোকের লেখতে এবিষয়ে অশোক যে নতুনত্বের সৃষ্টি করেছিলেন তা বাদ দিলে বাকী অংশই ছিল চন্দ্রগুপ্তের শাসন ব্যবস্থার অর্ন্তভুক্ত ।
চন্দ্রগুপ্তের প্রশাসনিক ব্যবস্থার উল্লেখ প্রসঙ্গে মেগাস্থিনিস রাজার অপ্রতিহত ক্ষমতার কথা বলেছেন । রাজ্যের কোথায় কি ঘটছে সেবিষয়ে রাজার সতর্ক দৃষ্টি ছিল । একাজে তাকে পরিদর্শক বা গুপ্তচররা সাহায্য করতেন। উপদেষ্টা এবং নিয়ামব এক পরিষদ প্রশাসনে রাজাকে সাহায্য করতেন । পদস্থ রাজকর্মচারীদের মধ্যে এগ্রোনোময় এবং অ্যাস্টিনোময়দের উল্লেখ করেছেন মেগাস্থিনিস। অ্যাগ্রোনোময়রা জেলার বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আর অ্যাস্টিনোময়রা ছিলেন পটলিপুত্রের পৌর প্রশাসনের দায়িত্ব ।
রাজার উল্লেখ প্রসঙ্গে কৌটিল্য উল্লেখ করেছেন যে, রাজা তিনি রাষ্ট্রের অংশ মাত্র । কৌটিল্যের মতে রাজা রাষ্ট্রের সর্ব্বচ্চ ক্ষমতার অধিকারী এবং এই ক্ষমতা সর্বসাধারনের স্বার্থরক্ষাতেই স্বার্থক হবে । প্রজার সুখেই রাজার সুখ, প্রজার হিতেই রাজার হিত, নিজের স্বার্থ নয়, প্রজার স্বার্থই রাজার কাম্য । কৌটিল্যের মতে রাজার রাজ্য পরিচালনায় সবচেয়ে বেশী সাহয্যের দরকার ছিল মন্ত্রীদের কাছে । মন্ত্রী এবং মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে রাজা প্রয়োজনে আলোচনা করলেও রাজার উপর তাদের বিশেষ নিয়ন্ত্রণ ছিল না । কৌটিল্য রাজস্ব অধিকর্তা হিসাবে সমাহর্তা এবং কোয়াধ্যক্ষ হিসাবে সন্নিধাতা পদের উল্লেখ করেছেন । রাষ্ট্রের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুপ্তচরদের গুরুত্ব তিনি স্বীকার করেছেন । চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্ব অনস্বীকার্য।