প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের গুরুত্ব
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদানকে মূলত দু’ভাগে ভাগ করা হয় — (১) প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান এবং (২) সাহিত্যিক উপাদান। প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান আবার চার ভাগে বিভক্ত। এগুলি হল যথাক্রমে স্থাপত্য-ভাস্কর্য, লেখমালা, মুদ্রা ও অভিজ্ঞান মুদ্রা। সাহিত্যিক উপাদান দেশীয় সাহিত্য ও বিদেশীয় সাহিত্য- -এই দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত। সুপ্রাচীনকাল থেকে আনুমানিক খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত যে সমস্ত ভারতীয় গ্রন্থ রচিত হয়েছে সেগুলি আলোচ্য সময়কালের সাহিত্যের পর্যায়ে পড়ে। বিদেশীয় সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত হল ভারতের বাইরে বিভিন্ন দেশের গ্রন্থ, যেগুলিতে ভারতবর্ষ সংক্রান্ত আলোচনা লিপিবদ্ধ হয়েছে। এছাড়া, বিভিন্ন সময়ে ভারতবর্ষে আগত বহু বৈদেশিক পর্যটকদের লিখিত বিবরণও এই পর্যায়ে পড়ে।
ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে প্রত্নতত্ত্বের এক বড় ভূমিকা আছে। প্রাচীন ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে একথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। প্রত্নতত্ত্বের সাহায্যে যে ইতিহাস রচিত হয় তা বিজ্ঞানভিত্তিক। (যে বিজ্ঞান আমাদের সুশৃঙ্খলভাবে খননকার্য করতে এবং জনসাধারণের বাস্তব জীবন সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে সাহায্য করে তাকে বলা হয় ‘প্রত্নবিদ্যা’।
প্রত্নবিদ্যা এখন প্রকৃতপক্ষে একটি বিজ্ঞানসম্মত বিষয় বলে স্বীকৃত। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে যে সব মাটির তৈরি মূর্তি ও পাত্র, ইমারত, ধাতু ও প্রস্তর নির্মিত বিভিন্ন উপকরণ আবিষ্কৃত হয়, সেগুলি পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের নির্দিষ্ট যুগের আর্থ-সামাজিক ইতিহাস রচনা করা সম্ভব। বস্তুত, সেই সুদূর প্রাচীনকালে আমাদের দেশের মানুষ কীভাবে জীবনযাপন করত, নারীজাতির সামাজিক মর্যাদা কেমন ছিল, কৃষিব্যবস্থা কেমন ছিল, পরিবহন ব্যবস্থা কেমন ছিল, গ্রামের উত্থান, নগর সভ্যতার বিবর্তন ও পরিণতি—এই সমস্ত যাবতীয় বিষয়ের সাক্ষাৎ পরিচয় মেলে প্রত্নবস্তুগুলিতে।
সাধারণভাবে বলা যেতে পারে, পুরাতন বস্তুরাজি হল প্রত্নতত্ত্বের বিষয়বস্তু। সুদূর অতীত থেকে প্রায় আধুনিক যুগ (১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ বা তার কিছুকাল আগে অবধি) এর গোড়া পর্যন্ত প্রত্নবস্তুর ব্যাপ্তি।
একশো বছরের বেশি পুরানো যে কোনো বস্তু বা স্থাপত্যকে প্রচলিত সরকারি নিয়ম অনুযায়ী প্রত্নতত্ত্বের মর্যাদা দেওয়া হয়। অনুসন্ধান ও খননকার্যের ফলে আবিষ্কৃত এবং মাটির তলা থেকে প্রাপ্ত বস্তু, এমনকি এখনও ব্যবহৃত হয় এমন স্থাপত্যরাজি প্রত্নতত্ত্বের আওতাভুক্ত। উল্লেখ্য, কোনো এক জায়গায় একসঙ্গে অনেক প্রত্নবস্তুর সন্ধান পাওয়া গেলে সেই স্থানটি প্রত্নস্থল বলে গণ্য হয়। ঐ ধরনের প্রত্নস্থল থেকে আবিষ্কৃত প্রত্নবস্তু বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের এবং সাধারণভাবে সেই বিশেষ যুগের ইতিহাস রচনার উপাদান হিসাবে বিবেচিত হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য ছাড়াও কৃষিকার্যকালীন সময়ে অথবা বাড়ি তৈরির প্রয়োজনে মাটি খুঁড়তে গিয়েও প্রত্নবস্তুর সন্ধানপ্রাপ্তি বিরল নয়। প্রত্নতাত্ত্বিকের কাজ হল প্রত্নবস্তু সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করে ঐতিহাসিককে সরবরাহ করা। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে ইতিহাসের সৌধ। কেননা ইতিহাস আর কিছু নয়—তা হল কেবল মানুষ ও তার কর্মকাণ্ড। এই কর্মকাণ্ড জানার অন্যতম হাতিয়ার হল প্রত্নবস্তু।