মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের কারণ
আনুমানিক ২৩২ খ্রিস্টপূর্ব-এ অশোকের মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যে এক ক্রমিক অবক্ষয় শুরু হয় এবং ১৮৭ খ্রিস্টপূর্ব-এ এর সম্পূর্ণ বিনাশ ঘটে। ২০৫ খ্রিস্টপূর্ব-এ অর্থাৎ অশোকের মৃত্যুর ২৫ বছরের মধ্যেই যবন বা গ্রিকরা মৌর্য সাম্রাজ্যের সীমা হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।
যে-মৌর্য সাম্রাজ্য হিন্দুকুশ পর্বতের পাদদেশ থেকে অন্ধ্রপ্রদেশের পেনার নদী পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল তার পতন অশোকের দেহাবসানের মাত্র অর্ধ শতকের মধ্যেই কীভাবে দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হল সে-বিষয়ে কৌতূহল জাগা খুবই স্বাভাবিক। বিভিন্ন পণ্ডিত এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তবে বৈদেশিক আক্রমণের তুলনায় অভ্যন্তরীণ সংকটকেই প্রধানত দায়ী করা হয়েছে। কোনো কোনো পণ্ডিত সাম্রাজ্যের পতনের জন্য কেবল অশোককে দায়ী করেছেন।
ব্রাহ্মণ বিপ্লব সৃষ্টির বিষয়টিকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যুক্তির নিরিখে বিশ্লেষণ করেছেন। ব্রাহ্মণ বিপ্লবের প্রেক্ষাপট তৈরিতে তিনি মূলত অশোকের নীতিগুলিকে দায়ী করেছেন। এইচ. পি. শাস্ত্রী মনে করেন যে, অশোকের নীতি ছিল বৌদ্ধদের অনুরাগী ও ব্রাহ্মণদের বিরোধী। তাঁর প্রথম যুক্তি হল মৌর্যরা ছিলেন শূদ্রবংশজাত। সর্বশ্রেষ্ঠ মৌর্য সম্রাট অশোক যুদ্ধনীতি ত্যাগ করে ধর্মবিজয়ের নীতি গ্রহণ করেন এবং এই কাজকে সফলতা দানের জন্য তিনি কিছু সুনির্দিষ্ট নীতি নেন। উল্লেখ্য খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল এবং তখন থেকেই ব্রাহ্মণদের প্রভাব প্রতিপত্তি ব্যাপারে একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এরপর অশোক যখন তাঁর নতুন হ্রাসের নীতিকে কার্যকরী করতে গিয়ে পশুবলি বিরোধী বিধানের কথা ঘোষণা করলেন তখন ব্রাহ্মণরা বিপন্ন বোধ করেন এবং মৌর্য শাসনব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধা হারান।
মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি এইচ. সি. রায়চৌধুরী আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি মনে করেন যে মগধের শাসকদের চিরাচরিত দিগ্বিজয়ী আদর্শ (ভেরী ঘোষ)-কে জলাঞ্জলি দিয়ে তিনি যে ধর্মনীতি (ধৰ্ম্মঘোষ) অনুসরণ করেছিলেন সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব রক্ষার পক্ষে তার ফল হয়েছিল অশুভ। কেননা, এর ফলে সামরিক শক্তি বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অথচ মৌর্য সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল মূলত চন্দ্রগুপ্তের সামরিক শক্তির ওপর ভিত্তি করে। সুতরাং অশোক মৌর্য শাসকদের সামরিক শক্তির ভিত্তিকে দুর্বল করে ফেলেছিলেন বলে এইচ. সি. রায়চৌধুরীর মনে হয়েছে। তার এই চুক্তিটি কে সমর্থন করেছেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।
বস্তুত, মৌর্য যুগের প্রারম্ভিক পর্বের সচ্ছল অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছিল এর শেষদিকে। উপরিউক্ত বিষয়টি ছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন দিক থেকে এই অর্থনৈতিক সংকটের ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে। মৌর্য সম্রাট অশোকের সময় ধম্ম প্রচারেরবিষয়টি নিঃসন্দেহে উচ্চ আদর্শের ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু এই কাজটিকে বাস্তবায়িত করে তোলার জন্য অশোক বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করেছিলেন। অথচ এই নতুন নীতিকে কার্যকরী করার জন্য নতুন কোনো আয়ের পথ সৃষ্টি হয়নি। এর ফলস্বরূপ অশোকের আমল থেকে ধর্মপ্রচার জনিত ব্যয় রাজকোষের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং পরবর্তী শাসকদের সময় রাষ্ট্রীয় খরচের এই ঊর্ধ্বগতি বহমান থাকে।
প্রসঙ্গত বলা যায়, ব্যাপক দানকার্যের ফলে এবং জনকল্যাণ-মূলক কাজ করতে গিয়ে অশোক বহু অর্থ খরচ করেছিলেন, যা রাজকোষের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল। এইভাবে দেখা যাচ্ছে যে মৌর্য অর্থনীতির ক্রমিক দুর্বলতা সাম্রাজ্যের পতন সূচিত করেছিল।
মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের উপরি-উক্ত বিভিন্ন তত্ত গুলি আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে উঠছে যে কোনো একটি বিশেষ তত্ত্ব এ ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। অর্থাৎ কোনো তত্ত্ব এককভাবে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের উপযুক্ত ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। সম্ভবত বিভিন্ন দিক থেকে মৌর্য সাম্রাজ্যের ওপর আঘাত এসেছিল। আগেই বলা হয়েছে যে বৈদেশিক আক্রমণ বা চাপের তুলনায় অভ্যন্তরীণ সংকটই ছিল প্রধানত দায়ী। অভ্যন্তরীণ সংকট সৃষ্টির ক্ষেত্রে অশোক দায়ী নন—প্রখ্যাত ইতিহাসবিদদের যুক্তির নিরিখে তা বিশ্লেষিত হয়েছে। কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোকের ব্রাহ্মণ বিদ্বেষী নীতির প্রতিক্রিয়াস্বরূপ মৌর্য সাম্রাজ্যের ভাঙন শুরু হয়েছিল বলে যে অভিযোগ করা হয়ে থাকে তা খুব বেশি যুক্তিপূর্ণ বলে মনে হয় না। তবে ‘ধৰ্ম্ম’-র প্রচার ঘটাতে গিয়ে অশাক এমন’ কিছু নীতি নিয়েছিলেন যেগুলি ব্রাহ্মণদের বিরাগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণস্বরূপ পূর্বে উল্লেখিত ‘দণ্ড সমতা’ ও ‘ব্যবহার সমতা’ নীতির মাধ্যমে সকলের মধ্যে সমতা রক্ষার কথা উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় হবে।
প্রকৃতপক্ষে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের কারণ ছিল অন্যত্র নিহিত। সাম্রাজ্যের অন্তর্নিহিত শক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের ওপর দাঁড়িয়েছিল বিশাল এই সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও অশোক ছিলেন দক্ষ ও প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি। অশোকের পর সাম্রাজ্যের শক্ত মুঠি শিথিল হয়ে পড়ে—এর ধস শুরু হয় যা এড়ানো যাবে না। কেননা, ‘ধৰ্ম্ম’-র প্রয়োগ ঘটাতে গিয়ে এমন কিছু কাজ তিনি করেছিলেন যেগুলি আপাতদৃষ্টিতে শুভপ্রদ বলে মনে হলেও পরিণামে তা সাম্রাজ্যের পক্ষে ক্ষতিকর হয়। এরপরেও সাম্রাজ্য কিছুকাল টিকে থাকে এবং এর ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানেন পুষ্যমিত্র শুঙ্গ (১৮৭ খ্রিস্টপূর্ব)।