চীনে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার পটভূমি আলোচনা কর।
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ চিনে মার্কসবাদের চর্চা শুরু হয়েছিল, মিন পাও পত্রিকা কার্ল মার্কসের জীবনী প্রকাশ করেছিল। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে নৈরাজ্যবাদী পত্রিকা তিয়েন-ই-পাও ফ্রেডারিক এঙ্গেলসের ইন্ট্রোডাকশন টু কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো ও তাঁর রচিত দ্য অরিজিন অব দ্য ফ্যামিলি চিনা ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিল। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে চিনা বুদ্ধিজীবীরা জেনেছিলেন যে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মার্কস ও এঙ্গেলস কিন্তু সামগ্রিকভাবে বুদ্ধিজীবী মহলে এর প্রভাব ছিল খুবই সীমিত।
বলশেভিক বিপ্লব সমাজতন্ত্রের মর্যাদা বৃদ্ধি ঘটিয়েছিল, মে ফোর্থ আন্দোলনের সময় বুদ্ধিজীবীরা মার্কসবাদ সম্পর্কে আগ্রহ দেখাতে থাকেন। সেন্ট সাইমো, ক্রোপটকিন, বাকুনিন ও মার্কস আলোচনার বিষয় হন। বুদ্ধিজীবীরা দেখলেন এই তত্ত্ব দিয়ে চিনের ঐতিহ্য-নির্ভরতা যেমন কমানো যায় তেমনি পশ্চিমকে বাধা দেওয়া যায় (lt provided a practical philosophy with which to reject both the traditions of the Chinese past and the Western domination of the present)। এই আদর্শ ইউরোপ ও আমেরিকা গ্রহণ করেনি, চিন একে গ্রহণ করলে পুঁজিবাদী দেশগুলি থেকে অন্তত আদর্শের ক্ষেত্রে এগিয়ে যাবে (Its acceptance in China would put it ideologically ahead of the cpitalist states)।
লেনিনের সাম্রাজ্যবাদের ব্যাখ্যা এবং সোভিয়েত রাশিয়ার পক্ষ থেকে চিনে জার আমলের অবৈধ সুযোগসুবিধা ত্যাগের প্রতিশ্রুতি সমাজতন্ত্রের মর্যাদা বাড়িয়েছিল। আরও দুটি সামাজিক পরিবর্তন মার্কসবাদের উত্থানের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল। একটি হল চিনে আধুনিক শিল্প-নির্ভর শ্রমিকশ্রেণীর উদ্ভব, অপরটি হল বুদ্ধিজীবীদের বিপ্লবের হাতিয়ার হিসেবে একটি শক্তিশালী দল গঠনের ইচ্ছা।
জাঁ শোনো জানাচ্ছেন যে ১৯১৯-২০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মার্কসবাদী চিন্তাধারা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো, এঙ্গেলসের ইউটোপিয়ান এ্যান্ড সায়েন্টিফিক সোসালিজম এবং কাউটস্কির দ্য ক্লাস স্ট্রাগল চিনা ভাষায় অনূদিত হয়। অনেকগুলি পাঠচক্র তৈরি হয়েছিল, এগুলির নাম হল – সোসাইটি ফর দ্য স্টাডি অব সোসালিজম, সোসাইটি ফর দ্য স্টাডি অব মার্কসিস্ট থিয়োরি, তিয়েনসিনে ছিল অ্যায়োকেনিং সোসাইটি, ক্যান্টনে নিউ স্টাডি সোসাইটি, সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিল পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থগারিক মার্কসবাদী লি-তা চাও ও তাঁর অনুগামীদের গোষ্ঠী। এরা নিউ টাইড সোসাইটি ও নিউ ইয়ুথ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর অনুগামীদের মধ্যে ছিলেন চু চিউ পাই, চ্যাং কুয়ো তাও ও মাও সে-তুং। আর একটি মার্কসবাদী গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দেন চেন তু শিউ, তিনি সাংহাই শহরে গঠন করেন মার্কসিস্ট স্টাডি সোসাইটি ও সোসালিস্ট ইয়ুথ কোর (Socialist Youth Corps)।
লি-তা-চাও বলশেভিক বিপ্লবকে ফরাসি বিপ্লবের মতো যুগান্তকারী ঘটনা বলে উল্লেখ করেন (He hailed the Bolshevik Revolution as a great, universal, and elemental force comparable in importance to the French Revolution)। চিনের বুদ্ধিজীবীরা তখনই মার্কসবাদকে পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে দেখেননি, তাঁরা মনে করেছিলেন মার্কসবাদের উপযোগিতা নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে আলাপ-আলোচনা চালাতে হবে। এই মানসিকতাসম্পন্ন মার্কসবাদীদের জ্যঁ শোনো বলেছেন আইনানুগ মার্কসবাদী (legal marxists)। এদের জন্য চিনের কমিউনিস্ট পার্টির গোড়ার দিকে কাজকর্ম ছিল বেশ মন্থর, গতিহীন।
রাশিয়া সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর চিনের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনে আগ্রহ দেখিয়েছিল। পশ্চিমি ও জাপানি সাম্রাজ্যবাদীদের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য এর প্রয়োজন ছিল। রাশিয়া থেকে প্রতিনিধিদল কমিন্টার্নের সদস্যরা চিনে এসেছিল। সোভিয়েত প্রতিনিধি দলের প্রধান ভয়েতিনস্কি (Voitinsky) লি-তা-চাও চেন তু সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এর ফলে কমিন্টার্নের একটি অফিস খোলা হয় ইরকুটস্কে। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে লি-তা-চাও এখানে তাঁর অনুগামীদের পাঠিয়েছিলেন, এই শাখা অফিস চিনা কমিউনিস্টদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে। চলেছিল।
জ্যঁ শ্যেনো মনে করেন ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্মকালে চিনে মার্কসবাদী গোষ্ঠীগুলি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল গঠনের কথা ভেবেছিল (The decisive) passage from Marxist study groups to militant political organization may be said to have taken place in the summer of 1920)। এটি হল। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক প্রক্রিয়ার পরিণতি। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মতবাদ ক্রমশ চরম পন্থার দিকে ঝুঁকতে থাকে, অপরদিকে বাইরে সোভিয়েত বিপ্লব অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। সোভিয়েত ঐতিহাসিকরা গুরুত্ব দিয়েছেন কমিন্টার্ন প্রতিনিধিদের কাজকর্মের ওপর। অপরদিকে চিনা ঐতিহাসিকরা মনে করেন ৪ মে থেকে যে বৌদ্ধিক আলোড়ন শুরু হয়েছিল তারই পরিণতি হল চিনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্মকালে সাংহাই-এর কমিউনিস্ট গোষ্ঠী নিজেকে প্রথম পার্টি হিসেবে উল্লেখ করেছিল, একটি কমিটিও গঠন করেছিল। চিনা ঐতিহাসিকরা এসব কমিটিকে বলেছেন সেল, পার্টি নয়, এদের সদস্যসংখ্যা ছিল খুবই কম।
এদের মতে, চিনের কমিউনিস্ট পার্টি ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে সাংহাই শহরে গঠিত হয়। এরকম কমিউনিস্ট সেল পিকিং, চাংসা, জিনান, তিয়েনসিন ও ক্যান্টনে ছিল। এসব গোষ্ঠীর লোকেরা সকলে মার্কসবাদী ছিলেন না, এদের মধ্যে সমাজতন্ত্রী, নৈরাজ্যবাদী বা কুয়োমিনটাং দলের বামপন্থীদেরও পাওয়া যায়। সাংহাই কমিউনিস্ট সেল একটি বামপন্থী পত্রিকা ‘দ্য কম্যুনিস্ট পার্টি’ প্রকাশ করেছিল। দলের আদর্শ ব্যাখ্যা করেছিল, আক্রমণ করেছিল নৈরাজ্যবাদীদের। রাশিয়া ও আমেরিকায় প্রকাশিত সমাজতত্ত্ব ও সমসাময়িক ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা অনুবাদ করে প্রকাশ করা হত। টোকিও ও প্যারিসেও দুটি কমিউনিস্ট গোষ্ঠী ছিল, প্যারিস দলের নেতা ছিলেন চৌ এন-লাই ও লি-লি-শান।
মার্কসবাদী তত্ত্বে শ্রমিকদের ওপর নির্ভর করে বিপ্লবের কথা বলা হয়েছে। এজন্য চিনের তরুণ কমিউনিস্টরা শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। মে ফোর্থ আন্দোলনের সময় থেকে চিনে শ্রমিক ধর্মঘট ও আন্দোলনের ঘটনা বেড়ে চলেছিল। বস্ত্ৰ, সুতোকল, খনি, ডক ও যন্ত্র কারখানার শ্রমিকরা ধর্মঘট করেছিল, রেলপথের শ্রমিকরাও ধর্মঘটে যোগ দিয়েছিল। কমিউনিস্ট গোষ্ঠীগুলি শ্রমিকদের মধ্যে নিয়মিতভাবে প্রচারকার্য চালাতে থাকে, লেবার ওয়ার্ল্ড নামক পত্রিকা একাজে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। সাম্যবাদীরা নৈশবিদ্যালয় স্থাপন করে শ্রমিক শ্রেণীকে সচেতন করে তোলার কাজে মন দিয়েছিল, ইউনিয়ন স্থাপন ও আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে এদের ভূমিকা ছিল। চাংসার শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে মাও সে-তুং যুক্ত ছিলেন।
১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১ মে চিনে প্রথম মে দিবস পালিত হয়, সাতটি মধ্যপন্থী শ্রমিক ইউনিয়ন এতে যোগ দিয়েছিল, নিউ ইয়ুথ শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছিল। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্টরা সাংহাইতে মে দিবস পালন করেছিল। জুলাই মাসের ঠিক কত তারিখে কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয় সংরক্ষিত উপাদান থেকে তা জানা যায় না। ওই মাসে (১৯২১) বারোজন সদস্য সাতটি কমিউনিস্ট গোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে সাংহাই শহরে | মিলিত হন, একটি বালিকা বিদ্যালয়ে (পাউয়েন মিডল স্কুল ফর গালস) সন্তু। বসেছিল। এটি ছিল ফরাসি অধিকৃত অঞ্চল, পুলিশের তাড়া খেয়ে সদস্যরা। নৌকায় মিলিত হয়ে সভা শেষ করেন। লি-তা-চাও বা চেন তু শিউ কেউই এদের মধ্যে ছিলেন না। চ্যাং কুয়ো তাও, মাও সে-তুং ও চাউ-ফু-হাই উপস্থিত | বারোজনের মধ্যে ছিলেন। একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়, পিকিং ও সাংহাই নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছিল। সাংহাই হল সদর কার্যালয়, চেন তু শিষ্ট হলেন পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল। কমিন্টার্নের পক্ষে মারিং ওরফে ওলন্দাজ সাম্যবাদী এইচ স্নিভলিয়েট উপস্থিত ছিলেন। সাংহাইতে একটি সচিবালয় গঠন করা হয়, এর প্রধান হন চ্যাং কুয়ো তাও, হুনান অফিসের প্রধান হলেন মাও সে-তুং।
চিনের কমিউনিস্ট পার্টির জন্মলগ্নে অনুপ্রেরণা ছিল বলশেভিক বিপ্লব, আদর্শ ছিল মার্কসবাদ, আর লেনিনের তত্ত্বানুযায়ী বিপ্লবের হাতিয়ার হল পার্টি (The Chinese Communist party drew its inspiration from the October Revolution, Marxist ideology, and from the Leninist conception of the party as the vanguard of the revolution)। কমিউনিস্ট পার্টি শিল্প শ্রমিকদের বিপ্লবের হাতিয়ার হিসেবে দেখেছিল, চেন এই তত্ত্বে আস্থা রাখেন। কিন্তু লি চিনের কৃষকদের মধ্যে বিপ্লবী সম্ভাবনা লক্ষ করেছিলেন, এই নিয়ে চেন ও লি-র মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছিল। লির অনুগামী মাও সে-তুং লি-র চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত হন। ইউরোপের কমিউনিস্ট পার্টিগুলি সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য থেকে গড়ে উঠেছিল। চিনে সে সুযোগ ছিল না, এখানে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যে থেকে কমিউনিস্ট পার্টির উদ্ভব হয় (The Chinese communist party was heir to the May Fourth Movement and therefore associated from the start with the whole Chinese national movement)। এজন্য এই দলের প্রথম সমস্যা হল জাতীয়তাবাদী কুয়োমিনটাং দলের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণ করা।
কুয়োমিনটাং দলের প্রধান সান ইয়াৎ-সেন নানা সমস্যার মধ্যে পড়েছিলেন। তাঁর প্রধান সমস্যা ছিল তিনটি—সাম্রাজ্যবাদ, দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা এবং গৃহযুদ্ধ। এই পরিস্থিতিতে তিনি দেখলেন বলশেভিক দলের সাফল্য, চিনের প্রতি বন্ধুত্বের মনোভাব এবং অসম চুক্তির নিন্দা। তিনি সোভিয়েত দলের পূর্ণ গঠনে কথা ভেবেছিলেন, সোভিয়েত সাহায্য নেবার সিদ্ধান্ত নেন। ইতিমধ্যে চিনা কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়, কৃষক ও শ্রমিকের সঙ্গে এই দলের যোগাযোগ ছিল ঘনিষ্ঠ। মে ফোথ আন্দোলনের পর দেশের মধ্যে জাতীয়তাবাদী উদ্দীপনা প্রবল আকার ধারণ করেছিল। এই দুই নতুন শক্তিকে তিনি সাম্রাজ্যবাদ ও সমরনায়কদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সমস্যা হল সোভিয়েত রাশিয়া চিনে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। রাশিয়া পিকিং-এর সমরনায়কদের সঙ্গে আপস করার কথা ভেবেছিল, কিন্তু পশ্চিমিদের বাধাদানের জন্য তা সম্ভব হয়নি।
১৯২১ খ্রিস্টাব্দ থেকে সানইয়াং-সেন সম্পর্কে সোভিয়েত দৃষ্টিভঙ্গি পালটে যায়। কমিন্টার্ন সদস্য ওলন্দাজ সাম্যবাদী নেতা মারিং (স্লিভলিয়েট) সানের সঙ্গে দেখা করে চিনের কমিউনিস্ট দলের সঙ্গে বন্ধুত্বের প্রস্তাব দেন। মারিং মনে করেন চিনের প্রধান রাজনৈতিক দল হল কুয়োমিনটাং (কে. এম. টি.), এদের সঙ্গে আপস হলে কমিউনিস্ট দল (সি. সি. পি.) তার প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পাবে। বুর্জোয়া দল হলেও কুয়োমিনটাং শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যেও প্রভাব বিস্তার করেছে। কমিউনিস্ট পার্টির দুই নেতা লি ও চেন বাধ্য হয়ে এই আপসে সম্মতি দেন। কমিউনিস্ট সদস্যদের কুয়োমিনটাং দলের সদস্যপদ গ্রহণে পার্টির কোনো আপত্তি ছিল না।
সান নানা কারণে কমিউনিস্টদের সঙ্গে আপস করেছিলেন। তিনি মনে করেন চিনের জাতীয় বিপ্লবে সব দল ও মতের লোক যোগ দিলে আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে উঠবে। তিনি কমিউনিস্ট দলের শ্রমিক ও কৃষক শাখার গুরুত্ব অনুধাবন করেন, দলের পুনর্গঠনে সোভিয়েত সাহায্যের প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন। তাছাড়া তিনি মনে করেছিলেন সোভিয়েত নির্দেশে চিনের কমিউনিস্ট পার্টি যদি স্বাধীনভাবে চলতে থাকে তাহলে তাঁর জাতীয় বিপ্লব পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যাবে। সুতরাং ক্ষুদ্র কমিউনিস্ট দলকে তিনি তাঁর দলের মধ্যে গ্রহণ করে এর স্বাধীন অস্তিত্ব মুছে দিতে চেয়েছিলেন। সানের আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল, তিনি সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে সমরনায়কদের বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিলেন।
সমরনায়কদের সঙ্গে রাশিয়ার বন্ধুত্বের সম্ভাবনা তিনি এভাবে নষ্ট করে দেন। কমিন্টার্নের নির্দেশে এডল্ফ জোফ্ (Joffe) সানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কুয়োমিনটাং-কমিউনিস্ট বন্ধুত্বের ভিত্তিস্থাপন করেন। এই বন্ধুত্বের ভিত্তি হল সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে মৈত্রী ও কমিউনিস্টদের পার্টিতে গ্রহণ (Alliance with the Soviets, admission of the Communists) | চিনের কমিউনিস্টদের বলা হল কুয়োমিনটাং দলে যোগ দিয়ে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অংশীদার হতে। ১৯২২-২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কুয়োমিনটাং-কমিউনিস্ট সহযোগিতা পর্ব চলেছিল।
মাও ও চু-তে নিজেদের মতো চলতে থাকেন, পার্টির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতেন। গ্রামে জমি অধিগ্রহণ করে এরা ধনী ও দরিদ্র কৃষকদের শুধু মধ্যে বণ্টন করে দিতেন, কেন্দ্রীয় কমিটি তাঁর কাজকর্মকে অনুমোদন করেনি। মৌখিক ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে জুইচিনে ‘অল চায়না কংগ্রেস অব দ্য সোভিয়েতের অধিবেশন। বসেছিল। দলের নীতি নিয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি, কিন্তু মাও ক্রমশ দলের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তাঁর শক্তির উৎস ছিল পাঁচটি কৃষকদের সমর্থন, নিজের দল ও সরকার, সামরিক বাহিনী, নিরাপদ ঘাঁটি ও স্বয়ম্ভরতা। কিন্তু পলিটব্যুরোতে তখনও মাওয়ের প্রভাব ছিল না, ভূমি সংস্কার নিয়ে পলিটব্যুরোর সঙ্গে তাঁর মৌল পার্থক্য তৈরি হয়েছিল। তাঁর গেরিলা যুদ্ধ পদ্ধতি পলিটব্যুরোর সমর্থন লাভ করেনি। এদিকে চিয়াং কমিউনিস্টদের ধ্বংস করার পরিকল্পনা রচনা করেন, এব্যাপারে জার্মান সমর বিশারদদের সহায়তা তিনি পেয়েছিলেন। চিয়াং কাইশেক কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযান পরিচালনা করেন (১৯৩০- ৩৪)।
প্রথম চারটি ব্যর্থ হয়, পঞ্চমটি সফল হয়। কমিউনিস্ট দলের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব তীব্র আকার ধারণ করেছিল। চিয়াং কমিউনিস্টদের ঘেরাও করে ধ্বংস করার পরিকল্পনা নেন (Encirclement and Extermination)। মাওয়ের জীবনে এটা ছিল সবচেয়ে দুঃসময়। কুয়োমিনটাং আক্রমণের সঙ্গে ছিল পলিটব্যুরোর আক্রমণ, তিন মাস তিনি গৃহবন্দি ছিলেন। অক্টোবর (১৯৩৪) লং মার্চের সময় তিনি মুক্ত হন। কুয়োমিনটাং আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য একলক্ষ কমিউনিস্ট কিয়াংসি থেকে পাহাড়, পর্বত, খরস্রোতা নদী, বন্ধুর পথ পেরিয়ে ছ’হাজার মাইল দূরে শেনসি প্রদেশে পৌঁছেছিল (১৯৩৪-৩৫)। পৃথিবীর ইতিহাসে এধরনের ঘটনা বিরল। একলক্ষ লোকের মধ্যে মাত্র আট হাজার লোক প্রাণ নিয়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছেছিল, আর সকলে মারা যায়। সুন্যিতে পৌঁছে পলিটব্যুরো অধিবেশনে বসেছিল কিন্তু মাও সে-তুং তখনও প্রাধান্য লাভ করেননি, তবে সৈন্যবাহিনীর ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ স্থাপিত হয়। হোলুং, চ্যাং কুয়ো তাও ও চু-তে সৈন্যবাহিনী নিয়ে মাওয়ের সঙ্গে যোগ দেন।
১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে মাও তাঁর ঘাঁটি ও কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ইয়েনানে সরিয়ে নেন। এইসময় থেকে মাও হলেন কমিউনিস্ট পার্টি ও সৈন্যবাহিনীর প্রধান, তাত্ত্বিক নেতা। সোভিয়েত সরকার তাকে দলের প্রধান হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছিল, লি ও পো ক্ষমতাচ্যুত হন, মাও ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছে যান।
আরও পড়ুনঃ চীনা কমিউনিস্ট পার্টি কত সালের কত তারিখে প্রতিষ্ঠিত হয়?