কৈবর্ত বিদ্রোহের কারণ
1170-71 খ্রিস্টাব্দে কৈবর্ত বিদ্রোহ সংঘটিত হয়, পাল রাজা দ্বিতীয় মহিপাল এর রাজত্বকালে। এই বিদ্রোহের কারণ ও প্রকৃতি সম্পর্কে ঐতিহাসিক মহলে মতভেদ রয়েছে ।
পালবংশীয় রাজা দ্বিতীয় মহিপাল এর রাজত্বকালে বাংলাদেশ কৈবর্ত বিদ্রোহ হয় । এই বিদ্রোহের নায়ক ছিলেন কৈবর্ত নেতা দিব্যক । দীব্যক ছিলেন বারেন্দ্রীর কৈবর্ত সামন্ত নেতা। তিনি পাল রাজা দ্বিতীয় মহীপালকে পরাজিত করে বারেন্দ্রীতে স্বাধীন শাসনের সূচনা করেন। ভীম ছিলেন কৈবর্ত বিদ্রোহের নেতা দিব্যকের ভাই রুদোকের পুত্র। তাকে পরাজিত করেই রামপাল বারেন্দ্রী পুনরুদ্ধার করেন।
সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত এই বিদ্রোহের বর্ণনা পাওয়া যায় । রামচরিত ছাড়া সমকালীন আরো তিনখানি লেখককে এই ঘটনার উল্লেখ আছে কুমারপালের মন্ত্রী বৈদ্যদেবের কামাউয়লি পট্টে মদনপাল এর মানাহালি দানপত্রে এবং পূর্ববঙ্গের বর্মন বংশীয় ভোজ বর্মনের বেলদা দানপত্র এই ঘটনার উল্লেখ আছে।
কৈবর্তদের এক শ্রেণি কৃষিজীবী। তাই এই বিদ্রোহ কখনও কখনও কৃষক বিদ্রোহ নামেও অভিহিত হয়ে থাকে । এটা আমরা জানতে পারি রামচরিত কাব্যে দিব্যকে ‘উপব্রিতী’ বলা হয়েছে। রামচরিতের টীকায় দিব্যকে ‘ছদ্মনিব্রতী’ রূপে বর্ণনা করা হয়েছে।
পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এর মতে , দিব্য মহিপাল কে হত্যা করে তার স্বজাতীয়দের অপশাসন থেকে মুক্ত করেন। এমন কথাও বলা হয়েছে যে, এই মহৎ কাজের জন্য জনসাধারণকে রাজা নির্বাচিত করেছিল। সন্ধ্যাকর নন্দী ও তার পিতা প্রজাপতি নন্দী পাল রাজাদের কর্মচারী ছিলেন। বাংলার পাল বংশের প্রতিবাদের আনুগত্য ও পক্ষপাতিত্ব স্বাভাবিক। সেজন্য রামচরিত এর বর্ণনা কে সকলে নির্দ্বিধায় গ্রহণ করতে পারেননি।
রামচরিতকার এর মতে দিব্য দোস্যু ছিলেন ,দেশহীতের ভান করে তিনি রাজা কে হত্যা করেন। মহীপালের শাসনকালে বাংলায় এক সামন্ত বিদ্রোহ হয়েছিল। এই বিদ্রোহের দিব্য মহীপালের সঙ্গে ছিলেন। যুদ্ধের রাজা পরাস্ত হলে তিনি তাকে হত্যা করে বরেন্দ্রভূমি বা উত্তরবঙ্গ অধিকার করে নেন।
রামচরিত 14 জন সামন্ত রাজার নাম পাওয়া যায় । এই চৌদ্দজন সামন্ত রাজা মহীপালের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। তার সৈন্য বাহিনী প্রস্তুত ছিল না অমাত্যদের উপদেশ আগ্রহ করে তিনি যুদ্ধ করেন পরাস্ত নিহত হন । তার অনুগামীদের অনেকে এই বিদ্রোহকে কৃষক বিদ্রোহ বলে উল্লেখ করেছেন। তাদের মতে এই কৈবর্তরা ছিল কৃষক, কৃষকের ওপর অত্যাচার হলে সামন্ত প্রভু নেতৃত্বে তারা রাজ শক্তির বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল।
অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায় মনে করেন ,উত্তরবঙ্গের কৈবর্ত ছিল জেলে, মৎস্যজীবী। অন্য মতে এরা হলো চাষী কৈবর্ত, জেলেদের একাংশ বৃত্তি পরিবর্তন করে চাষী কৈবর্ত হয়ে যায়। অধ্যাপক ডি . সি সেন মনে করেন মৎস্যজীবী কৈবর্তদের ওপর পাল রাজাদের উৎপীড়ন হলো এই বিদ্রোহের একটি কারণ। পাল রাজারা বৌদ্ধ ছিলেন , প্রাণীহত্যা পছন্দ করতেন না তা নিয়ে বিরোধ। অধ্যাপক আব্দুল মতিন চৌধুরী এই মতের বিরোধিতা করে বলেছেন যে পাল রাজারা বৌদ্ধ হলেও খুব সহিষ্ণু ছিলেন।
অনেকেই এই বিদ্রোহকে দ্বিতীয় মহীপালের উৎপীড়নমূলক নীতির বিরুদ্ধে কৈবর্ত জাতির | স্বতঃস্ফূর্ত সশস্ত্র অভ্যুত্থান বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁদের অভিমত, দ্বিতীয় মহীপালের দমনমূলক ক্রিয়াকলাপে নির্যাতিত ও অতিষ্ঠ কৈবর্তগণ দিব্যের নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং পালরাজকে পরাজিত ও নিহত করে বরেন্দ্রী তথা উত্তর বাংলায় কৈবর্ত রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। | হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, যদুনাথ সরকার, রমাপ্রসাদ চন্দ, উপেন্দ্রনাথ ঘোষাল প্রমুখ ঐতিহাসিকেরা এরূপ অভিমতই পোষণ করেন।
রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, দ্বিতীয় মহীপালের বিরুদ্ধে দিব্যের বিদ্রোহ কৈবর্ত জাতির বিদ্রোহ নয়। ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধির জন্য পালরাজ্যের পদস্থ রাজপুরুষ দিব্য বিদ্রোহী হয়েছিলেন। দ্বিতীয় মহীপাল তখন ঘোর সংকটে। ভায়েরা তাঁর বিরুদ্ধে সামন্তরাও তাঁর বিপক্ষে। এই সুযোগে দিব্য বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। তাঁর লক্ষ্য উত্তর বাংলায় এক স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা। করবার বিষয়, সন্ধ্যাকর নন্দী দিব্যের বিদ্রোহকে কৈবর্ত বিদ্রোহ আখ্যা দেননি, বরেন্দ্রীতে কৈবর্ত রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথাও বলেননি। যে রাজ্যটি জন্ম নিল সেটি দিব্যের রাজ্য, কৈবর্তদের নয়। এ কারণে দিব্যের বিদ্রোহকে কৈবর্ত বিদ্রোহ আখ্যা দেওয়া সমীচীন নয়।
ড. বি. সেন এই বিদ্রোহের সামাজিক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। তাঁর মতে, বৌদ্ধধর্মে মৎস্য হত্যা নিষিদ্ধ ছিল। ফলে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পাল রাজাদের আমলে কৈবর্তদের সামাজিক অসুবিধা হচ্ছিল। দ্বিতীয় মহীপাল কঠোরভাবে এই সিদ্ধান্ত কার্যকরী করতে চাইলে কৈবর্তরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
ড. উপেন্দ্রনাথ ঘোষাল, যদুনাথ সরকার প্রমুখ এই বিদ্রোহের গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এঁদের মতে, কৈবর্ত – শ্রেণীভুক্ত দিব্য নেতৃত্ব দিলেও এটি কেবলমাত্র কৈবর্তদের বিদ্রোহ ছিল না। বাংলার কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতা এবং রাজপরিবারের অন্তর্বিরোধের সুযোগে উত্তরবঙ্গের সামন্তরাজাগণ একত্রে রাজনৈতিক বিদ্রোহ এই বিদ্রোহে সামিল হয়েছিলেন। দক্ষতা ও যোগ্যতার দ্বারা দিব্য এর নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিল।
দিব্যের রাজত্ব সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে এই বংশের তিনজন রাজা বরেন্দ্রীতে পর পর রাজত্ব করেছেন। রামপাল রাজা হয়ে দিব্যের রাজত্বকালে বরেন্দ্রী পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন। কিন্তু সফলকাম হতে পারেননি। বরং দিব্যই একাধিকবার পালরাজ্য আক্রমণ করেছিলেন। এসব ঘটনা প্রমাণ করে, দিব্য একজন দক্ষ প্রশাসক ছিলেন। তিনি বরেন্দ্রীতে নিজ কর্তৃত্ব সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত করেন।
দিব্যের পর তাঁর অনুজ রুপোক বরেস্ত্রীর সিংহাসনে বসেন। রুদোকের মৃত্যুর পর তাঁর সুযোগ্য পুত্র ভীম রাজা হন। ভীমের পরাক্রম ও সুশাসনের প্রশংসা করেছেন সন্ধ্যাকর নদী। ভীম যখন বরেন্সীতে নিজের অধিকার সুদৃঢ় করছিলেন, তখন গঙ্গার অপর তীরে পালরাজ্যে রামপালের নেতৃত্বে বরেন্দ্রী পুনরুদ্ধারের প্রস্তুতি চলছিল। শেষে রামপালের নিকটই ভীম পরাজিত ও নিহত হন, তাঁর রাজ্য পালরাজ্যের অঙ্গীভূত হয়।
মূল্যায়ন:
পাল রাজা দ্বিতীয় মহীপালের আমলে বারেন্দ্রী অঞ্চলে কৈবর্ত বংশীয় দিব্য বিদ্রোহ করেন এবং দ্বিতীয় মহীপালকে পরাজিত ও নিহত করে বারেন্দ্রীতে একটি স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেন (১১৭০ ৭৭ খ্রিস্টাব্দ)। রামচরিতে দিব্যকে ‘দস্যু’ ও ‘উপাধিব্ৰতি’ (অন্যায় কৌশল কাজে পটু ব্যক্তি) এবং কৈবর্ত বিদ্রোহকে (‘অনিকম্ ধর্ম বিপ্লবম্) (অপবিত্র বিদ্রোহ) বলা হয়েছে। সম্ভবত দিব্য শুধু কৈবর্তদের নেতা ছিলেন না। তিনি বারেন্দ্রীতে উচ্চপদে নিযুক্ত ছিলেন। কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতা ও রাজপরিবারের মধ্যে বিরোধের সূত্রে তিনি বারেন্দ্রী দখল করেন।