ইতিহাসের সাথে দর্শনের সম্পর্ক
ইতিহাসের মতো দর্শনও একটি স্বতন্ত্র বিষয় যা মূলত জ্ঞানের প্রকৃতি, বাস্তবতা, অস্তিত্ব, নৈতিকতা ইত্যাদি নিয়ে চর্চা করে থাকে। দর্শনচর্চার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায় জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রতি ভালোবাসা। বৈজ্ঞানিক চর্চা ও গবেষনার মাধ্যমে যা কিছু প্রত্যক্ষ করা যায় না বা ব্যাখ্যা করা যায়না সেই সকল বিষয়ের উপরেই দর্শনচর্চা আলোকপাত করতে থাকে, অন্যভাবে বললে সাধারণভাবে অজ্ঞাত বিষয়ে জ্ঞান আরোহন করাই দর্শনের লক্ষ্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতেই যুক্তি সাজিয়ে দার্শনিক প্রকল্প রচনা করে স্নাত থেকে অজ্ঞত তথ্যে উপনীত হওয়ার চেষ্টা চালান।
বিজ্ঞান যখন একদিকে প্রকৃতি, উদ্ভিদ, মানুষ, জীবজগত, যন্ত্র, প্রযুক্তি ইত্যাদি প্রত্যক্ষগোচর বিষয় নিয়ে চর্চা চালায়,তেমনই দর্শন মানব আত্মা, ঈশ্বরের অস্তিত্ব, চূড়ান্ত সত্য, সৌন্দর্য, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ইত্যাদি দৃষ্টিগোচর নয় এমন বিষয়ের উপর আলোকপাত করে থাকে। এই কারণে দর্শনকে সকল জ্ঞানের মাতা বলে মনে করা হয় যা উপরোক্ত অপ্রত্যক্ষগোচর বিষয়ে সমন্বয়মূলক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করে থাকে।
দর্শন নামক বিষয়ের মধ্যে একদিকে যেমন যুক্তিবিজ্ঞান, নৈতিকতা ইত্যাদি বিষয়গুলি আলোচিত হয়, তেমনই আবার মনোবিজ্ঞানের মতো বিষয়েরও চর্চা হয়। ইতিহাসের চর্চার একজন ইতিহাসবিদ ক্রমাগত অবরোহ বা আরোহ যুক্তির ব্যবহার করে সামান্য সিদ্ধান্তে বা সূত্রে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করেন। যেমন, একাধিক যুদ্ধের প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ঐতিহাসিক দেখেন যে অর্থনৈতিক কারণ অন্যতম তাহলে তিনি আরোহ যুক্তিকে কাজে লাগিয়ে অন্য যুদ্ধের ক্ষেত্রেও সামান্যীকরণ করে বলবেন যে অর্থনৈতিক কারণ সংশ্লিষ্ট যুদ্ধটির একটি গুরুতপূর্ণ কারণ।
বিপরীতভাবে ঐতিহাসিক তাঁর উপাদান থেকে তথ্য আরোহণ করতে গিয়ে অবরোহ পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটান এবং যে কোনো ঘটনার পশ্চাতে অপ্রয়োজনীয় বা তাৎপর্যহীন কারণগুলিকে বাদ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বা সম্পর্কযুক্ত কারণটিকেই গ্রহণ করেন। যেমন, গুপ্তযুগীয় ব্রাহ্মী হরফে খোদিত মেহরৌলি লৌহডস্ত লেখতে উল্লেখিত ‘চন্দ্র’ নামক রাজাটিকে শনাক্ত করতে গিয়ে ঐতিহাসিকগণ অবরোহ পদ্ধতিতে তাদের যুক্তি সাজান।
ইতিহাসচর্চায় নৈতিকতা বা মূল্যবোধের দিকটিকেও বিশ্লেষণ করা হয়। বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শনের ইতিহাসচর্চা করতে গেলে একজন ঐতিহাসিককে সমকালীন মূল্যবোধ ও নৈতিকতার মানদন্ড সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে তবেই তিনি ভগবান গৌতম বুদ্ধের অষ্টাঙ্গিক মার্গ মধ্যপন্থার মতো তত্ত্বগুলিকে বুঝতে পারবেন। বস্তুত বৈদিক দর্শন, বৌদ্ধ বা জৈন দর্শন সাংস্কৃতিক ইতিহাস চর্চার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রূপে চিহ্নিত।
প্রায় একইভাবে মনস্তত্বের চর্চাও ইতিহাসচর্চার সঙ্গে সম্পৃক্ত। ২৬১ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে মৌর্য সম্রাট অশোক কলিঙ্গ জয়ের পর কেন যুদ্ধনীতি ত্যাগ করলেন, সত্যিই যুদ্ধের ভয়াবহতা তাকে শোকে কাতর করে তুলল কিনা এই বিশ্লেষণ যখন ঐতিহাসিকগণ করে থাকেন তখন তিনি আদতে ঐতিহাসিক চরিত্রটির মনস্তত্বের দিকটি নিয়ে আলোচনা করেন মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে এখানে ইতিহাসের যোগ স্থাপিত হয়।
বস্তুত মানব মন যে ঐতিহাসিক আলোচনার বিষয়বস্তু হতেপারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ১৯৪৩ এর ববাংলার দুর্ভিক্ষ যেখানে কলকাতার ফুটপাথে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যায় কিন্তু ক্ষুদার্থ মানুষ কোনো দোকান লুঠ করেনি, কেন করেনি তার আলোচনা যখন ঐতিহাসিক করবেন তখন তা মনস্তাত্ত্বিক চর্চার মাধ্যমেই করতে হবে। এই দৃষ্টান্ত থেকে স্পষ্ট যে ইতিহাসচর্চার সঙ্গে দর্শন চর্চার সম্পর্ক যথেষ্ট।