ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি ।
আকবর থেকে ঔরঙ্গজেব পর্যন্ত প্রত্যেক মুঘল সম্রাটের দাক্ষিণাত্যে সম্প্রসারণের তাগিদ, নির্দিষ্ট কারণ ছিল । সাম্প্রতিক একটি গবেষণা প্রবন্ধে ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্র মুঘলদের নীতির পিছনে জটিল কারণ থাকার যুক্তি দেখিয়েছেন । শিরীণ মুসভির মতে, সাম্রাজ্যের সম্প দীর্ঘ ও স্বল্প মেয়াদী, এক্ষেত্রে নির্দেশক ছিল । এটা কোনো মুঘল সম্রাটের নিজস্ব পছন্দের ব্যাপার ছিল না , ছিল মুঘল শাসক শ্রেণীর গঠন প্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে বাধ্যবাধকতার ফল।
সিংহাসনে বসার পর দাক্ষিণাত্যে ঔরঙ্গজেবের দুটি সমস্যা একটি ছিল শিবাজীর উত্থানের ফলে উদ্ভুত সমস্যা এবং দুই শিয়া অধ্যুষিত রাজ্য বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা কেন্দ্রিক । ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্র ১৬৫৮ থেকে ১৬৮৭ খ্রীঃ পর্যন্ত বিজাপুর ও গোলকুন্ড দখলের পথকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন । প্রথম পর্যায়ে ছিলঐ পর্যায়ে ছিল ১৬৬৮ খ্রীঃ পর্যন্ত এসময় ১৬৩৬-এর চুক্তি অনুযায়ী বিজাপুরের কাছ থেকে জায়গা দখল করা। দ্বিতীয় পর্যায়ে ছিল ১৬৮৪ খ্রীঃ পর্যন্ত যখন মারাঠাদের বিরুদ্ধে বিজাপুর ও গোলকুন্ডাকে মুঘল সহযোগী রাজ্যে পরিণত হতে বাধ্য করা হয় । তৃতীয় পর্যায়ে ছিল ১৬৮৪ থেকে ১৬৮৭ খ্রীঃ যখন ওরঙ্গজেব গোলকুণ্ডীর মারাঠাদের বিরুদ্ধ বিজাপুর ও গোলকুন্ডীর দুইটি রাজ্য জয়ের সিদ্ধান্ত নেন । ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতির উদ্দেশ্য বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে সতীশচন্দ্র লিখেছেন যে, “It destroyed for all times confidence in the Mughal treaties and promises, and made immpossible A Union of Hearts against the Marathas” তবে এই নীতির সাফল্য ছিল সামান্য।
সিংহাসন লাভের পর ওরঙ্গজেব জয় সিংহকে আদেশ দেন শিবাজী ও বিজাপুরকে শাস্তি দেওয়ার জন্য । জয় সিংহ হতেন দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলিতে বিভেদ বাধিয়ে রাখতে, যাতে তারা মারাঠাদের কোনো সাহায্য করতে না পারে । বিজাপুর ও গোলকুন্ডা মুঘলদের দাক্ষিণাত্য জয় সম্পর্কে সচেতন ছিল বলে শিবাজীর মিত্র জোট গঠনে তারা সচেষ্ট ছিল । অন্যদিকে জয় সিংহের নীতি ছিল বিজাপুর ও বিভেদ তৈরী করা ।
এই উদ্দেশ্যে পুরন্দরের সন্ধিতে শিবাজীকে বিজাপুর উপকূল এলাকা দেওয়া হয় ২ কোটি টাকার বিনিময়ে । বিজাপুরের মন্ত্রী ও আমলাদের দলে টানারও চেষ্টা করা হয় । বিজাপুরের মোল্লা আহম্মদকে ১৬৬৫ তে ছয় হাজারী মনসব দেওয়া হয় এবং মিত্রতার ভান করে জয় সিংহ আদিল শাহকে যুদ্ধের প্রস্তুতিই নিতে দেন নি । বিজাপুরের সঙ্গে প্রথম যুদ্ধে (১৬৬৫ খ্রীঃ ২৫ ডিসেম্বর) মুঘলদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দিলির খান ও শিবাজী । বিজাপুর আক্রমনের ফলে দক্ষিণী রাজ্যগুলির একতা বেড়ে যায় । গোলকুন্ডা বুঝতে পারে তাদের টিকে থাকতে গেলে বিজাপুরকে সাহায্য করা দরকার । সামরিক দিক থেকে মুঘলদের মর্যাদার হানি হয়, কারণ কোনো স্থান দখল করা যায় নি । ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতিও হয়েছিল । ১৬৬৭ তে জয় সিংহের মৃত্যু ঔরঙ্গজেবকে হতাশ করে ।
১৬৭২ এ দ্বিতীয় আলি আদিল শাহের মৃত্যুর পর বিজাপুরের গৌরব ম্লান হয়ে যায় । ১৬৭২ থেকে ১৬৮৬ পর্যন্ত সময়পর্বে উজীরদের অধীনে অভিজাতদের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে এবং শিবাজীও উচ্চাকাঙ্খী হয়ে ওঠেন । ১৬৭৫-এ ঔরঙ্গজেব খাওয়াস খনের সঙ্গে চুক্তি করেন বীজাপুরের আফগান গোষ্ঠীকে দমন করে যৌথভাবে শিবাজীকে আক্রমন করার জন্য । ১৬৬৭ এর মধ্যে মুঘলরা কালিয়ানিং, বিদর, পারেন্দা, শোলপুর, পলদুর্গ ও গুলবর্গা দখল করে বিজাপুরের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল এবং একই সঙ্গে গোলকুন্ডার সীমান্তেও পৌঁছে যায় ।
কুতব শাহ সীমান্তে প্রচুর সৈন্য জড়ো করেছিলেন । দিলির খান ও বাহলাল খান গোলকুন্ডা আক্রমনে বেরোন । গোলকুন্ডায় মদন্না ও তার ভাই আকন্নার শক্তি বৃদ্ধি ঘটনার নতুন মোড় নেয় । তারা চেয়েছিল শিবাজী ও বিজাপুরের সঙ্গে ত্রিশক্তি জোট গড়ে তুলতে । ১৬৮৩ তে মুঘল সম্রাট আহমদনগর আসেন বিজাপুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য । গোলকুন্ডা প্রথমে দখল করতে না পারলেও তা মুঘলদের নিয়ন্ত্রনেই ছিল । সেখানকার হীরে ও লোহার খনি এবং পূর্ব উপকূলের সমৃদ্ধ বন্দরগুলি থেকে রাজ্যের আয় ছিল প্রায় ৩ কোটি টাকা । এটাই গোলকুন্ডার পতনের প্রধান কারণ হয়ে ওঠে । তবে গোলকুন্ডা মুঘলদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে যায় নি । গোলকুন্ডা নিয়মিত ভাবে পেশকাশ (কর)গোলকুন্ডা আসছিল । ঔরঙ্গজেব ১৬৮৫ এর ৩০ অক্টোবর গোলকুন্ডার দিকে রওনা হন এবং ১৬৮৭ মুঘলদের নিয়ন্ত্রনে চলে আসে ।
বিজাপুর ও গোলকুন্ডাকে মোঘল সাম্রাজ্যের প্রদেশে পরিণত হয়েছিল তা নিয়ে বিতর্ক আছে । সম্ভবত মুঘল সাম্রাজ্যের জাগীরদারী সংকট নিরসনের ঔরঙ্গজেব এধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন । তবে এটাই প্রধান কারণ তা বলা যায় না আকবরের বিদ্রোহ ও সোমভূজির যোগাযোগও এর কারণ ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে যুবরাজ করা যায় না । শিবাজীর পরবর্তীকালে মারাঠাদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হলেও তাদের গেরি আক্রমন মুঘলদের ব্যাতিব্যস্ত করে তুলেছিল । একান্ত প্রয়োজন না হলে তারা সম্প।
ঔরঙ্গজেব ভেবেছিলেন মারাঠা শক্তির, ঘটে, গৈছে । সাম্প্রতিক গবেষনায় দেখা গেছে ঔরঙ্গজেব বিজাপুর ও গোলকুন্ডায় যথার্থভাবেই শাসনত ক পুনর্বিন্যাস করেছিলেন । ১৬৯৯ সালে মারাঠারা নর্মদা পেরিয়ে উজ্জয়িনীর আশেপাশের লুঠপাঠ চালায় । ১৭০৬ সাল নাগাদ মারাঠাদের প্রায় সব দুর্গ দখল করলেও প্রকৃত অর্থে ছিল অর্থহীন উত্তরসুরীদের জন্য রেখে গিয়েছিলেন “সাম্রাজ্যের ১৭০৭ সালে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তিনি তার বিশাল সমস্যা ।
মূল্যায়ন:
মুঘল পতনে সাম্রাজ্যের জন্য ঔরঙ্গজেবের নীতি কতটা দায়ী তা নিয়ে বিতর্ক আছে । তার মৃত্যুর ৩০ বছরের মধ্যে মুঘল “সাম্রাজ্য ভাঙতে শুরু করে। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, হিন্দুদে । বিরোধী র মুঘল সাম্রাজ্য মতাদর্শ ও কার্যকলাপের মোকাবিলা কারা জন্য তিনি সব মুসলমানদের সমর্থন পেতে চেয়েছিলেন । কিন্তু মারাঠী ও দাক্ষিণাত্যের শিয়ারা একযোগে এই প্রচেষ্টা ব্যাহত করে দেয় । দ্বিতীয়ত, তিনি এই দুই শিয়া রাজ্যকে দখল করে মুঘল সাম্রাজ্য সম্প্রসারিত করায় সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে মারাঠা হানা সহজ হয়ে যায়। তিনি যদি এই দুই রাজ্যকে অঙ্গীভূত না করে “BufferState” হিসাবে রাখতেন তাহলে এই ঘটত না ।
তৃতীয়ত, দীর্ঘ ২৬ বছর দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধে ব্যস্ত থাকায় উত্তর ভারতের প্রতি হয়ে সমস্যার তিনি সঠিকভাবে নজর দিতে পারেন নি, আবার দাক্ষিণাত্যেও সাফল্য পান নি । চতুর্থত, তিনি মারাঠাদের সঠিকভাবে বুঝতে পারেননি, শিবাজীর উত্তরাধিকারীদের বন্ধুত্বের সুযোগ নিতে পারেন নি। এমনকী দাক্ষিণাত্যের শাসকদের মানসিকতাও বুঝতে পারেন নি । দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধের ফলে মুঘল শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্তনিহিত দ্বন্দ ও দুর্বলতাগুলি বাইরে প্রকট হয়ে যায় । “দাক্ষিণাত্য ক্ষত” ঔরঙ্গজেবের রাজনৈতিক জীবনকে পীড়িত করলেও তাকে এককভাবে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য দায়ী করা যায় না ।