গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী কৃতিত্ব।
গৌতমীপুত্র সাতকর্ণির সামগ্রিক কর্মকাণ্ড জানার জন্য নাসিকে প্রাপ্ত তিনটি শিলালেখ অপরিহার্য। এর মধ্যে প্রথম দুটি তাঁর রাজত্বকালের। একটি তাঁর রাজত্বের অষ্টাদশ বৎসরে এবং অপরটি রাজত্বের চতুর্বিংশ বৎসরে রচিত। এই দ্বিতীয় লেখটি তিনি তাঁর মায়ের সঙ্গে যুক্তভাবে রচনা করেছিলেন।
গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী কর্মকাণ্ড জানার জন্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল হল গৌতমীপুত্রের মৃত্যুর উনিশ বছর পরে তাঁর মাতা গৌতমী বলশ্রী কর্তৃক প্রচারিত নাসিক প্রশস্তি। সাতবাহন বংশের অতীত ইতিহাসের কথা বলতে গিয়ে এই প্রশস্তিটিতে গৌতমী বলশ্রী গৌতমীপুত্র সাতকর্ণির অসাধারণ কার্যকলাপের এক সুন্দর চিত্র তুলে ধরেছেন। মুদ্রাগত তথ্য থেকেও শকদের বিরুদ্ধে তাঁর জয়লাভের স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যা পরবর্তী আলোচনা থেকে বোঝা সম্ভব হবে।
গৌতমীপুত্র সাতকর্ণি কতদিন শাসন করেছিলেন সে সম্পর্কে ঐতিহাসিক মহলে এক সময় যথেষ্ট দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। যুক্তিসঙ্গতভাবে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদরা দেখিয়েছেন যে ঐ বর্ষগুলি গৌতমীপুত্রের রাজত্বের যথাক্রমে অষ্টাদশ ও চতুর্বিংশ বৎসর। এরই সূত্র ধরে এবং শক ক্ষত্রপ নহপানের রাজত্বের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের বিষয়টির ভিত্তিতে গৌতমীপুত্রের তারিখ নির্ণয় করা হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, তাঁর রাজত্বের অষ্টাদশ বৎসরে রচিত লেখটি থেকে জানা যায় যে গৌতমীপুত্র ঐ বৎসরে ক্ষহরাত বংশীয় শকদের ওপর আঘাত হানেন এবং নহপানকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেন।
ঐতিহাসিকগণ কর্তৃক মোটামুটিভাবে স্বীকৃত এই ঘটনার তারিখ যেহেতু ১২৪ খ্রিস্টাব্দ এবং ঐ সময়টি যেহেতু গৌতমীপুত্রের রাজত্বের অষ্টাদশ বৎসর সেহেতু প্রায় নিঃসংশয়ে বলা চলে যে এর আঠারো বছর আগে অর্থাৎ ১০৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর শাসন শুরু হয়েছিল। এখনো পর্যন্ত গৌতমীপুত্রের জ্ঞাত তারিখ তাঁর রাজত্বের চতুর্বিংশ বৎসর। সুতরাং অষ্টাদশ বৎসর অর্থাৎ ১২৪ খ্রিস্টাব্দের সঙ্গে আরো ছয় বছর যোগ করলে ১৩০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর শাসন শেষ হয়েছিল, একথা মোটামুটিভাবে বলা যেতে পারে। এই তত্ত্বের ভিত্তিতে গৌতমীপুত্র সাতকর্ণির সামগ্রিক সময়কাল হল ১০৬-১৩০ খ্রিস্টাব্দ।
ক্ষহরাতদের ওপর গৌতমীপুত্র সাতকর্ণির জয়লাভ এবং মহারাষ্ট্র ও সংলগ্ন অঞ্চলে সাতবাহনদের পূর্ব ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার অকাট্য প্রমাণস্বরূপ তাঁর মাতা মহাদেবী গৌতমী বলশ্রীর নাসিক প্রশস্তিতে উদ্ধৃত বিবরণ উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় হবে। এই প্রশস্তিতে তাঁকে শক, যবন ও পহ্লব বা পার্থিয়ানদের ধ্বংসকারী বলে বর্ণনা করা হয়েছে। যখন (গ্রিক বা ইন্দো-গ্রিক) ও পার্থিয়ানদের সঙ্গে তিনি কোনো সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলেন কি না এবং তার স্বরূপই বা কী ছিল সে সম্পর্কে অন্য কোনো উপাদান থেকে তথ্য না পাওয়ায় এ বিষয়ে স্পষ্টভাবে কিছু জানা যায় না।
শকদের যে তিনি পরাজিত করে সাতবাহনদের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করেছিলেন তা এই প্রশস্তিতেই উল্লেখিত অন্যান্য বিবরণ এবং অপরাপর কিছু উপাদান থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়। এর এক জায়গায় বলা হয়েছে যে তিনি খখারত (ক্ষহরাত) বংশের উচ্ছেদ ঘটিয়েছিলেন এবং সাতবাহন বংশের গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এই প্রশস্তিতে গৌতমীপুত্রের কর্মপ্রতিভার কথা বলতে গিয়ে মা গৌতমী বলশ্রী বলছেন যে তাঁর মুখমণ্ডল ছিল সূর্যের রশ্মি বিচ্ছুরিত পদ্মফুলের ন্যায় সৌন্দর্যপূর্ণ। পূর্ণচন্দ্রের সঙ্গেও গৌতমীপুত্রের মুখমণ্ডলকে তিনি তুলনা করেছেন। এই সমস্ত বিষয়গুলি গৌতমীপুত্র সাতকর্ণির আমলে সাতবাহন বংশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের ইঙ্গিত বহন করে সন্দেহ নেই।
গৌতমীপুত্র সাতকর্ণি সম্পর্কে নাসিক প্রশস্তিতে ঐ সমস্ত গৌরবসূচক উক্তি ছাড়াও তাঁর সময়ে সাতবাহন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত কতকগুলি অঞ্চলের একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। এই তালিকায় উল্লেখিত অঞ্চলগুলি হল আসিক বা ঋষিক ( সম্ভবত গোদাবরী ও কৃষ্ণা নদীর মধ্যবর্তী কোনো অঞ্চল), অসক (গোদাবরী জেলায় পূর্বতন হায়দ্রাবাদ রাজ্যের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত), মূলক (সাতবাহনদের রাজধানী পৈথানের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল), সুরথ (দক্ষিণ কাথিয়াবাড়), কুকুর (পশ্চিম রাজস্থান), অপরান্ত (উত্তর কোঙ্কন), অনুপ (নর্মদা উপত্যকার মাহিষমতী অঞ্চল), বিদর্ভ (বৃহত্তর বেরার) এবং আকর-অবন্তী (পূর্ব ও পশ্চিম মালব)। এই তালিকা প্রসঙ্গে আরো বলা হয়েছে যে গৌতমীপুত্র ছিলেন বিন্ধ্য, চবত (সাতপুরা), পারিযাত্র (পশ্চিম বিন্ধ্য পর্বতমালা), সহ্য (নীলগিরির উত্তরে পশ্চিমঘাট পর্বতমালা), মলয় (নীলগিরির নিচে পশ্চিমঘাট পর্বতমালা) এবং মহেন্দ্র (পূর্বঘাট পর্বতমালা) –এই বিস্তৃত অংশের অধিপতি।
বিশাল এলাকা জুড়ে বিভিন্ন পর্বতমালার অধিপতি বলে যে গৌতমীপুত্রকে অভিহিত করা হয়েছে তা কতখানি যুক্তিসঙ্গত সে-বিষয়ে ঐতিহাসিক মহলে সংশয় আছে। দীনেশচন্দ্র সরকার মন্তব্য করেছেন যে বিন্ধ্য পরবর্তী সমগ্র ভূখণ্ডের ওপর গৌতমীপুত্র সাতকর্ণির সার্বভৌমত্ব স্থাপনের ইঙ্গিত পাওয়া যায় এর মাধ্যমে। অপরদিকে অশোক কুমার মজুমদার সহ অপর কিছু পণ্ডিত মনে করেন যে অসিক, মূলক, অপরান্ত প্রভৃতি অঞ্চলগুলির ওপর গৌতমীপুত্রের যে ধরনের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, পর্বতমালাগুলির ওপর ঠিক সেই ধরনের সার্বভৌমত্ব সম্ভবত ছিল না। তবে পূর্বঘাট পর্বতমালা থেকে পশ্চিমঘাট পর্বতমালা এবং বিন্ধ্য থেকে মলয় বা ত্রিবাঙ্কুর পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় যে তাঁর আধিপত্য এবং কিছুটা সার্বভৌম কর্তৃত্ব বজায় ছিল তা অস্বীকার করা যাবে না।
গৌতমীপুর সাতবর্ণির সাম্রাজ্য বিস্তারে সফলতার পরিমাণ নির্ণয় করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই অন্ধ্রের ওপর তাঁর অধিকার ছিল কি না সে প্রসঙ্গ আসবে। নাসিক লেখ, প্রশস্তি বা কোনো মুদ্রায় অন্ধ্রদেশের ওপর তাঁর অধিকার ছিল এমন কথা সরাসরি বলা হয়নি। অথচ মুদ্রা, লেখমালা ও হিউয়েন সাঙের বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হয় যে অন্ধ্রদেশ (অন্ধ্রাপথ) কোনো একসময় সাতবাহন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
উত্তরে বলা যায় যে গৌতমীপুত্র বা তাঁর মায়ের লেখতে কোথাও অন্ধ্রের উল্লেখ না থাকলেও নাসিক প্রশস্তিতে দাবি করা হয়েছে যে গৌতমীপুত্রের ‘যুদ্ধাশ্ব বা যুদ্ধমান ঘোড়াগুলি তিনটি সমুদ্রের জল পান করেছিল। এখানে তিনটি সমুদ্র বলতে আরবসাগর, বঙ্গোপসাগর ও ভরত মহাসাগরকে বোঝানো হয়েছে। এই দাবি আপাতদৃষ্টিতে অতিরঞ্জিত বলে মনে হতে পারে, কিন্তু এর থেকে বিন্ধ্য পরবর্তী বিস্তৃত অঞ্চল (যার মধ্যে নিশ্চিতভাবে অন্ধ্র অন্তর্ভুক্ত)-এর ওপর তাঁর যে সাধারণ আধিপত্য বজায় ছিল তা বোধহয় অস্বীকার করা যাবে না।
গৌতমীপুত্র সাতকর্ণি সাতবাহন বংশের গৌরব পুনরুদ্ধারের কাজে সফল হয়েছিলেন সত্য। কিন্তু এই সাফল্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। অর্থাৎ এক্ষেত্রে সাতবাহনরা শেষপর্যন্ত জয়ী হতে পারেনি। পশ্চিম ভারতের শক বংশের কাদমক শাখার শাসকরা ১৩০ খ্রিস্টাব্দে অথবা এরপর কোনো এক সময়ে সাতবাহন সাম্রাজ্যের ওপর মারাত্মক আঘাত হেনেছিলেন এবং একে পুনরায় বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন।
নাসিক প্রশস্তিতে গৌতমীপুত্র সাতকর্ণির সাম্রাজ্যভুক্ত অঞ্চলগুলির তালিকা এবং রুদ্রদামনের জুনাগড় শিলালেখ (১৫০ খ্রিঃ)-য় উদ্ধৃত অঞ্চলগুলির তুলনামূলক আলোচনা করলে দেখা যাবে, উভয় তালিকার মধ্যে অনেকাংশে মিল আছে। সুতরাং রুদ্রদামন যে অল্পকালের মধ্যেই সাতবাহনদের যুদ্ধে পরাজিত করে কিছু অঞ্চল অধিকার করে নিয়েছিলেন সে-বিষয়ে কোনো সংশয় নেই।
রুদ্রদামন দাবি করেছেন, ‘দক্ষিণাপথপতি‘ সাতকর্ণিকে তিনি দুবার পরাজিত করেছিলেন ; কিন্তু সম্পর্কের নৈকট্য হেতু তাঁকে হত্যা করেননি। সম্পর্কের এই নৈকট্য যে দেশীয় ও বিদেশীয় উভয় রাজবংশের মধ্যে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা বোঝা যায় কানহেরি (বোম্বাইয়ের ৫০ মাইল দক্ষিণ-পূর্ব এবং পুনার৩০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত)-তে প্রাপ্ত একটি লেখ থেকে।
গৌতমীপুত্র সাতকর্ণির পুত্র বাশিষ্ঠীপুত্র সাতকর্ণির বিবাহ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। জুনাগড় প্রশস্তিতে উল্লেখিত পরাজিত ‘দক্ষিণাপথপতি’ সাতকর্ণির শনাক্তকরণের ব্যাপারে ঐতিহাসিকমহলে মতভেদ আছে।
কিন্তু দক্ষিণদিকে তাঁর রাজনৈতিক সম্প্রসারণের প্রয়াস স্থায়িত্ব লাভ করেছিল। দাক্ষিণাত্য ও দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে সাতবাহনদের সুদৃঢ় পরিচিতি ঘটেছিল এর সূত্র ধরে। গৌতমীপুত্র সাতকর্ণির সময় সাতবাহনদের পুনরর্জিত গৌরব পরে ম্লান হয়ে গিয়েছিল, এই সত্যকে স্বীকার করে নিয়েও তাঁর পক্ষে একটা কথা অবশ্যই বলতে হবে যে, তিনি ছিলেন সেই মহান শাসক, যিনি প্রথম দাক্ষিণাত্যকে একটি বৃহৎ শক্তির মর্যাদা দান করেছিলেন।