প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় অর্থশাস্ত্রের গুরুত্ব।
মহীশূরের পণ্ডিত ডু. শ্যাম শাস্ত্রী ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত ভাষায় লেখা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি আবিষ্কার করেন। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। মূল গ্রন্থটির প্রায় ২৫ শতাংশ পাওয়া যায়নি। গ্রন্থটিতে মোট ১৫টি অধ্যায় ছিল।
মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মন্ত্রী কৌটিল্য বা চাণক্য খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি রচনা করেন বলে মনে করা হয়। গ্রন্থটিতে আদর্শ রাষ্ট্রনীতি বা রাষ্ট্রদর্শন, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনব্যবস্থা, রাজস্বব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, ভারতীয় সমাজজীবন, নারীদের অবস্থা প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনা রয়েছে।
রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে শাসককে কেমন নীতি গ্রহণ করা উচিত তার ব্যাখ্যাও এতে রয়েছে।রাজাকে কূটনীতিপরায়ণ হতে হবে। তাঁর মতে, রাষ্ট্রে বা শাসনব্যবস্থায় রাজাই একমাত্র সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। রাজাই রাজ্য। রাজা দুর্বল হলে রাষ্ট্র দুর্বল হতে বাধ্য।
অর্থশাস্ত্রে মৌর্য মন্ত্রীপরিষদ ও রাজকর্মচারী নিয়োগের উল্লেখ রয়েছে। রাজার সর্বোচ্চ রাজকর্মচারী ছিলেন মন্ত্রীগণ। তার নীচে ছিল মন্ত্রীপরিষদ। রাজা মন্ত্রীদের মতামত বা পরামর্শ গ্রহণ করতে বাধ্য ছিলেন না। যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষার দ্বারা শাসন ও বিচার বিভাগে অমাত্য, সমাহত্রী, সন্নিধাত্রী প্রভৃতি কর্মচারী নিয়োগ করা হত।
‘অর্থশাস্ত্রে’ বলা হয় যে, সমৃদ্ধ রাজকোষ ছাড়া সুষ্ঠু শাসন পরিচালনা করা সম্ভব নয়। কৌটিল্য তাঁর গ্রন্থে তিন প্রকার রাজস্বের কথা বলেছেন—সীতা, ভাগ ও বলি। সীতা : রাজার খাসজমি ‘সীতা’ থেকে রাজার ভালোই আয় হত। ভাগ: ‘ভাগ’ অর্থাৎ প্রজার ব্যক্তিগত জমি থেকে উৎপন্ন ফসলের ১/৬ অংশ কর আদায় করা হত। বলি: ‘বলি’ নামে একপ্রকার বাধ্যতামূলক কর আদায় করা হত। এ ছাড়া বন, খনি, শিল্প, আমদানি-রপ্তানি, পশুচারণ, পানশালা, কসাইখানা, জল, প্রভৃতি থেকেও কর আদায় হত।
চতুর্বর্ণ : অর্থশাস্ত্র অনুসারে, সমাজে পূর্বের মতো চারটি বর্ণের (ব্রাক্ষ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র) অস্তিত্ব থাকলেও এই সময় বৈশ্য ও শূদ্রদের অবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটে। বিবাহ: অর্থশাস্ত্রে আট প্রকার বিবাহের উল্লেখ আছে।
অনুলোম (উচ্চবর্ণের পুরুষ ও নিম্নবর্ণের নারীর মধ্যে বিবাহ) ও প্রতিলোম (নিম্নবর্ণের পুরুষ ও উচ্চবর্ণের নারীর মধ্যে বিবাহ) বিবাহের ফলে সমাজে মিশ্রজাতির সৃষ্টি হয়। সমাজে উচ্চবর্ণের সঙ্গে শূদ্রদের বৈবাহিক সম্পর্ককে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। 3 দাস: দাসদের প্রতি কৌটিল্য সহানুভূতি দেখিয়েছেন।
কৌটিল্য রাষ্ট্রশাসন সম্পর্কিত বাস্তব বিধিব্যবস্থার নীতিগুলি লিপিবদ্ধ করতেই তাঁর ‘অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থটি রচনা করেন।
প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রনীতি চর্চায় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হল কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র। অর্থশাস্ত্রে কৌটিল্য সুদূর প্রাচীন কালে রাষ্ট্রনীতি বিষয়ক আলোচনায় যে উৎকর্ষের পরিচয় দিয়েছেন তা বিস্ময়কর। আধুনিক রাষ্ট্রনীতির চর্চায় ইতালির ম্যাকিয়াভেলির যে স্থান, প্রাচীন যুগের রাষ্ট্রনীতির চর্চায় কৌটিল্যের স্থান অনুরূপ।