মুর্শিদ কুলি খানের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা অথবা, মুর্শিদকুলি খানের ভূমি ও রাজস্ব প্রশাসনের পর্যালোচনা কর।
মুঘল বাদশা ঔরঙ্গজেব মুর্শিদকুলি খাকে ১৭০০ খ্রিঃ নভেম্বরে বাংলার দেওয়ান নিযুক্ত করেন । ১৭০৩ থেকেই মুর্শিদকুলি খাঁ কার্যত বাংলা সুবার শাসকে পরিণত হন । তবে এই পদে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন ১৭১৭-তে বাদশাহ ফরুকশিয়ার কর্তৃক । মুর্শিদকুলি যখন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ান হিসাবে দায়িত্ব নেন তখন দাক্ষিণাত্য যুদ্ধে মুঘল রাজকোষ প্রায় শূন্য, বাংলার ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থাতেও কিছু ত্রুটি দেখা গিয়েছিল । বাংলা সুবায় উর্বর খালসা জমি উচ্চপদস্থ রাজ্য ধর্মাচারীরা ক্রমশ গ্রাস করে চলেছিল । জাগীর হিসাবে অবশিষ্ট খালসা থেকেও নিয়মিত রাজস্ব আদায় হত না । এই ত্রুটি দূর করার জন্যই মুর্শিদকুলি খাঁ বাংলার বাদশাহের মনোনয়ন পেয়েছিলেন ।
১৭০২ সাল থেকে তিনি প্রতি বছর নিয়মিতভাবে বাংলা থেকে রাজস্ব হিসাবে বাদশাহকে ১ কোটি টাকা করে পাঠাতে থাকেন । মুর্শিদকুলি খানের সবচেয়ে স্মরণীয় কীর্তি ভূমি রাজস্ব বিভাগের আমূল সংস্কার। মুঘল ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার লক্ষ্য ছিল একদিকে ভূমি থেকে যতবেশী সম্ভব রাজস্ব আদায় অন্যদিকে কৃষকদের সন্তুষ্ট রাখা, আবাদি জমির পরিমাণ বৃদ্ধি ও কৃষি উৎপাদনের উন্নতি বিধান । মুর্শিদকুলি ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থায় এই দুই উদ্দেশ্য সিদ্ধির চেষ্টা হয়েছিল । সালিম উল্লার ‘‘তারিখ-ই-বাঙ্গালা’’ এবং জেমস্ গ্র্যান্টের “অ্যানালিসিস অফ দি ফিনানেন্স অফ বেঙ্গল’ এ বিষয়ে প্রধান ঐতিহাসিক উপাদান ।
বাংলা সুবা থেকে আদায়কৃত ভূমি রাজস্বের পরিমাণ কম ছিল একারণে যে, খালসার বেশীরভাগই বেতনের বদলে জাগীর হিসাবে সামরিক ও বেসামরিক রাজপুরুষদের দেওয়া হত। উদ্ধার করা জাগীরের ভূমি রাজস্বের পরিমাণ ছিল ১০ লক্ষ ২১ হাজার ৪১৫ টাকা। যাদের জাগীর কেড়ে নেওয়া হল তাদের বিকল্প জাগীর দেওয়া হয়েছিল উড়িষ্যার অনুন্নত, অনধিকৃত ও বিদ্রোহপ্রবন এলাকায়।
দ্বিতীয়ত, মুর্শিদকুলি বাংলার জমি জরিপ করে নতুন “হস্তবুদ” (ভূমি রাজস্ব সম্পর্কিত বিস্তারিত হিসাব) তৈরী করেন । জমিকে আবাদী, অনাবাদী ও বন্ধা এই তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয় । এই হস্তবুদের ভিত্তিতেই ১৭২২ সালে মুর্শিদকুলি খাঁ বাংলার নতুন ভূমি বন্দোবস্ত করেন যা “তোমর জমা” নামে পরিচিত । এই নতুন বন্দোবস্তে তিনি বাংলার ভূমি রাজস্ব বাড়িয়েছিলেন ১১ লক্ষ ৭২ হাজার ২৭৯ টাকা । আগের তুলনায় ভূমি রাজস্ব বৃদ্ধি পেয়েছিল শতকরা ১৩১/২ টাকা হারে ।
মুর্শিদকুলির সময়ে এই খাজনা বৃদ্ধি ছিল প্রথাগত ব্যাপার। তবে নবাব ব্যয় সংকোচ করতেন। প্রশাসনিক ব্যয় হ্রাস ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য খাজনা সংগ্রহের প্রয়োজনে তিনি একটা নতুন কাঠামো তৈরি করেন।৩৪ টি সরকার এবং ১৩৫০ টির মহলের পরিবর্তে বাংলাকে ১৩টি চাকলা ও ১৬৬০ টি পরগণায় বিভক্ত করেন চাকলা গুলি ছিল বন্দর বালশোর, হিজলী, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, হুগলী বা সপ্তগ্রাম, ভূষনা, যশোর, আকবর নগর, ঘোড়াঘাট, কুরিবাড়ি, জাহাঙ্গীর নগর, শ্রীহট্ট ও ইসলামাবাদ। জমি থেকে রাজস্ব আদায়ের ভার দেওয়া হয়েছিল ইজরাদারদের উপর পুরোনো কিছু জমিদার থাকলেও তাদের ইজরাদারদের কঠোর নিয়ন্ত্রনে রাখা হয়। কিছুদিনের মধ্যেই পুরোনো জমিদারদের বদলে ইজরাদাররাই হয়ে ওঠে আসল জমিদার ।
সালিমুল্লাকে উদ্ধৃত করে আচার্য যদুনাথ সরকার লিখেছেন, রাজস্ব আদায়ের জন্য মুর্শিদকুলি খা বাঙালী হিন্দুদের নিযুক্ত করতেন । খালসা ও জাগীর উভয় শ্রেণীর জমি থেকে জমিদাররা খাজনা আদায় করে আসছিল । এর বিনিময়ে তারা পেতেন আদায়কৃত রাজস্বের ১০ শতাংশ এবং কিছু নিষ্কর ‘নানকর’ জমি । আচার্য যদুনাথের মতে, মুর্শিদকুলি বাংলার ভূমি রাজস্বের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন । মালজামিনী বা ইজরা ব্যবস্থা চালু করেন । তাঁর মতে এই ইজরাদারদের চাপে প্রাচীন জমিদাররা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং পরবর্তীকালে লর্ড কর্ণওয়ালিসের সময় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে ইজরাদাররাই জমিদার হিসাবে স্বীকৃতি পান ।
ঐতিহাসিক আব্দুল করিমের মতে, মুর্শিদকুলি খাঁ পুরোনো জমিদারদেরও টিকিয়ে রেখেছিলেন । খালসা জমির কিছু অংশে বাজেয়াপ্ত করা জমিদারীতেই ইজরাদাররা খাজনা আদায় করতেন । এবং এজন্য তারা জমিদারদের মতই কমিশন পেতেন । ফলত জমিদার ও ইজরাদার – উভয়ই রায়তদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের দায়িত্ব পালন করতেন । সেই অনুযায়ী এই ব্যবস্থাকে মিশ্র ব্যবস্থা বলা যায় । আর যেসব জমিদার নিয়মিত খাজনা দিতে পারতেন না তাদেরই উৎখাত করা হয় জমিদারী থেকে ।
মুর্শিদকুলি ভূমিরাজস্বের ক্ষেত্রে অপর যে পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন তা হল দেওয়ানী বিভাগের – মুৎসুদ্ধি ও হিসাব রক্ষকের খাতে । জমিদারদের উপর এক বাড়তি ভূমিরাজস্ব বসিয়েছিলেন যা “আবওয়াব” নামে পরিচিত। তার সময় আবওয়াব বাবদ আয় হত ২ লক্ষ ৫৮ হাজার ৮৫৭ টাকা । তবে মুর্শিদকুলির উত্তরাধিকারীরা ক্রমশ এর পরিমাণ বাড়াতে থাকেন।
বাংলা সুবায় ভূমি রাজস্বের এই সংস্কারগুলির চরিত্র ফলাফল নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। কারো কারো মতে, এর আগে বাদশাহ যাদের দেওয়ান বা সুবাদার করে এখানে পাঠাতেন তাদের বেশীরভাগই নিজেদের জন্য যথাসম্ভব অর্থ সংগ্রহ করতেন, মুঘল রাজকোষ ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হত, আর রায়তরা শোষিত হত । মুর্শিদকুলি খা এর হাত বাংলার মানুষকে কিছুটা রেহাই দিয়েছিলেন। আবার অনেকের মতে, তিনি বাদশাহ ও নিজের কোষাগার পূর্ণ করার জন্য এত চড়াহারে খাজনা বাড়িয়েছিলেন যে তা আদায় করা শোষণ, নির্যাতনের নামান্তর ছিল।