মৌখিক বা কথ্য উপাদানের গুরুত্ব।
ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকগণ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের কথ্য ভাষ্য বা বিবরণকে ইতিহাস রচনায় আদিকাল থেকেই ব্যবহার করে আসছে একে ইতিহাসের মৌখিক উপাদান বা কথ্য উপাদান বলা হয়। ইংরেজিতে কথ্য উপাদান ‘oral history’ বা ‘oral traditions’ নামে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। যদিও উভয়ের মধ্যে সামান্য কিছু পার্থক্য রয়েছে। সেহেতু আধুনিক ইতিহাস চর্চায় মৌখিক উপাদানের ব্যবহার কিছুটা হলেও সীমিত ও প্রথা বহির্ভূত।
মৌখিক উপাদানের দুটি আঙ্গিক রয়েছে প্রথমত সতস্ফুর্ত এবং অন্যটি কিছুটা যান্ত্রিক। প্রথমটি উদাহরণ হল স্বাভাবিক প্রবণতা অনুযায়ী কিছু গোষ্ঠী বা সমাজে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা কথ্য পরম্পরা যেগুলিকে ‘oral traditions’ বলা হয়। যেমন 1855 খ্রিষ্টাব্দের হুল বা বিদ্রোহের সময় ছোটনাগপুরের বিদ্রোহী সাঁওতালদের মুখে মুখে গান শোনা যেত যেগুলি তাদের পরবর্তী প্রজন্মে বাঁচিয়ে রেখেছে। এই প্রকার কথ্য পরম্পরা থেকে অতীতের ইতিহাসের অনেক ঘটনা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অন্যদিকে আধুনিককালে পাশ্চাত্য দুনিয়ায় সৃষ্ট যে ‘oral history’ পদ্ধতিতে অতীতের স্মৃতি কে জাগ্রত করে বিশেষ ব্যক্তি বা সামাজিক গোষ্ঠীর মৌখিক ভাষ্য রেকর্ড করা হয়ে থাকে এবং তার ভিত্তিতে ইতিহাস লেখা হয়ে থাকে সেই পদ্ধতি অনেকটাই যান্ত্রিক। এই যান্ত্রিক পদ্ধতির মাধ্যমে ইতিহাস চর্চার প্রবণতাটিকে প্রথমে দেখা দরকার।
মৌখিক ইতিহাসের সংজ্ঞা নিরূপণ বেশ দুরূহ। পল থমসন তার ‘The voice of the past’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, মৌখিক বা কথ্য ইতিহাসই হলো প্রথম ইতিহাস। তার বক্তব্য অনেকাংশেই ঠিক কারণ উপাদানের উপর ভিত্তি করে ইতিহাস রচনার সূচনা ইতিহাসের জনক হেরোডোটাস। তিনি গ্রিকদের সঙ্গে পারসিকদের যুদ্ধের ইতিহাস এর অনেক তথ্যই প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। বিখ্যাত ঐতিহাসিক থুকিডিডিস তার পেলোপনেসীয় যুদ্ধ ইতিহাস রচনার সময় প্রত্যক্ষদর্শীদের মৌখিক যুদ্ধের উপর নির্ভর করে ছিলেন।
মৌখিক উপাদান হলো অলিখিত ইতিহাসের একটি ভাগ। এখানে সাক্ষাতকারের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। আধুনিককালে মৌখিক উপাদানের ক্ষেত্রে অডিও টেপ বা রেকর্ড এর মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। যান্ত্রিক মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করার পর তাকে যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করা হয়। ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ আছে এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে এখানে সাক্ষাতকারের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। আধুনিক বিজ্ঞান ভিত্তিক ইতিহাস চর্চায় লিখিত উপাদান এবং পরে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান প্রাধান্য বিস্তার করে। এবং মৌখিক সূত্র নির্ভর ইতিহাস রচনায় ভাটা পড়ে। পরে পাশ্চাত্য দুনিয়ায় বিংশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে থেকে নতুন করে ইতিহাস রচনায় কথ্য উপাদানের গুরুত্ব আরোপিত হতে থাকে। মৌখিক উপাদানের উপর ভিত্তি করে দুটি উৎকৃষ্ট ইতিহাস গ্রন্থ রচিত হয়েছিল রিচার্ড সি ওয়েবের সম্পাদনায় 1967 সালে প্রকাশিত ‘urban life in America series’ এবং 1970 সালে প্রকাশিত ‘harvard studies in urban history’ । 1960 ও1970 এর দশকে উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের পৌর জীবনের ইতিহাস, মার্কিন মুলুকে অন্তবর্তী নির্বাচনের ইতিহাস, এবং সাধারণভাবে নৃতাত্ত্বিক গণের গোষ্ঠী সংক্রান্ত চর্চার উপাদান বা কথ্য উপাদান ব্যবহৃত হতে থাকে ।
প্রথমদিকে ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে সকল শ্রেণীর মানুষকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হতো না। ঐতিহাসিকরা সামাজিক সকল শ্রেণীর পরিবর্তে কেবল মুষ্টিমেয় কিছু শ্রেণীর চিত্রই তুলে ধরতেন কিন্তু সাম্প্রতিককালে ইতিহাস চর্চায় সকল শ্রেণীর সমানভাবে গুরুত্ব বেড়েছে। এর সাথে তাল রেখে বৃদ্ধি পেয়েছে সার্বিক আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস চর্চার প্রবণতা এক্ষেত্রে মৌখিক উপাদান ভীষণ ভাবে সাহায্য করে।
অনেক ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ইতিহাসের আড়ালে সামগ্রিকভাবে বহু মানুষের অভিজ্ঞতা চাপা পড়ে যায়। সেগুলি তুলে ধরার জন্য প্রয়োজন মৌখিক উপাদান। মৌখিক উপাদান এর সাহায্যে কোন অঞ্চলের প্রান্তিক নিম্নোক্ত মানুষের জীবনযাত্রা, বিশ্বাস, কুসংস্কার ,মূল্যবোধ সম্পর্কে অজানা নানান তথ্য পাওয়া যায়। কৃষক অর্থনৈতিক ইতিহাস এর আলোচনায় মৌখিক ঐতিহ এর সাহায্য একান্ত প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় কুপার তার শেয়ার প্রপিং এন্ড শেয়ার প্রপারস স্টাগল ইন বেঙ্গল গ্রন্থে মৌখিক উপাদানের উপর ভিত্তি করে বাংলার কৃষি গত দ্বন্দ্বের ইতিহাস কে ব্যাখ্যা করেছেন।
শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস রচনায় সরকারি নথির সমর্থনে মৌখিক উপাদানের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। শ্রমিক আন্দোলনের সাংগঠনিক দিক এর পাশাপাশি শ্রমিকদের মধ্যে গড়ে ওঠা সাম্প্রদায়িক ও সংস্কৃতিক চেতনার ইতিহাস অনুধাবন করতে মৌখিক ইতিহাসের প্রয়োজন। যেমন দীপেস চক্রবর্তীর রিং থিংকিং ওয়ারকিং ক্লাস হিস্টির বেঙ্গল গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে বাংলার চটকল শ্রমিকদের আন্দোলনের তৎকালীন অর্থনৈতিক দাবির সঙ্গে ধর্মের দাবির প্রশ্নটিও জড়িয়ে ছিল। সরকারি নথিপত্রে নারী শ্রমিকদের ইতিহাসের উপর বিশেষ আলোকপাত করা হয় না। সুকুমরি চৌধুরী ও সন্তশ কুমারী দেবী মতো নেত্রৃরা ইতিহাসের প্রাদপ্রদূরে এলএও সেই সকল নারীদের ভূমিকা পর্যালোচনা করতে মৌখিক উপাদান প্রয়োজন।
স্বাধীনতা পূর্ববর্তী কৃষক বিদ্রোহ গুলিতে মেয়েরা যেভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল সে সকল তথ্য অনেক ক্ষেত্রে সরকারি নথিপত্র এরিয়ে গেছে। আগস্ট আন্দোলনের মেদিনীপুরের নারীদের দুঃখ বর্ণ অত্যাচারিত হওয়ার কোন সরকারি দলিল নেই কিভাবে নারীরা সাহসের সাথে মাথা উঁচু করে লড়াই করেছিল। জাতীয় আন্দোলনের অংশ নিয়েছিল সে সব কথা সরকারি নথিপত্রে নেই তা আছে স্মৃতিকথা ও মৌখিক ঐতিহ্যে। সরকারি ও প্রতিষ্ঠানিক ইতিহাস চর্চায় এক লিঙ্গগত বৈষম্য থাকে। তা মৌখিক উপাদানই এ ক্ষেত্রে সত্য জানতে সাহায্য করে।
দেশভাগের ইতিহাস রচনার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান এর অভাব নেই এবং এ বিষয়ে বহু রচিত ও হয়েছে। তবে তার অধিকাংশ রাজনৈতিক ইতিহাস। এ বিষয়ে কোনো সামাজিক ইতিহাস নেই। নেই কোনো সাংস্কৃতিক মনোবৈজ্ঞানিক বা নারীদের ইতিহাস। লিখিত উপাদান এক্ষেত্রে অপ্রতুল বলে মৌখিক সূত্রে গুরুত্ব অসীম। দেশভাগের সাথে সম্পর্কযুক্ত মানুষের মুখের কথায় সমসাময়িক এমন অনেক আর্থসামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিষয় জানা গেছে যে আমাদের নতুনভাবে ইতিহাস লিখতে সাহায্য করে। সর্বোপরি বলা যায় ইতিহাস রচনায় বা গবেষণায় মৌখিক বা কথ্য উপাদানের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।