StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

হর্ষবর্ধনের প্রশাসনিক ব্যবস্থা আলোচনা করো ।

 হর্ষবর্ধনের প্রশাসনিক ব্যবস্থা আলোচনা করো।


  হর্ষবর্ধন যথার্থই অনুভব করেছিলেন যে সাহিত্য চর্চা ও সাম্রাজ্য বিস্তারের পাশাপাশি ঐ সাম্রাজ্যকে সুসংগঠিত করা প্রয়োজন, যার জন্য অপরিহার্য ছিল সুদৃঢ় প্রশাসনিক ব্যবস্থা। তবে তাঁর শাসনব্যবস্থার মধ্যে মৌর্য আমলের অতি কেন্দ্রীভূত চরিত্রের প্রয়োগ ঘটেনিহর্ষবর্ধনের প্রশাসনিক ব্যবস্থা সংক্রান্ত তথ্যের জন্য আমাদের অনেকটাই নির্ভর করতে হয় বাণভট্টের হর্ষচরিত এবং হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণমূলক গ্রন্থ সি-ইউ-কি’র ওপর।


  মৌর্য শাসনব্যবস্থার অতি কেন্দ্রীকরণ গুপ্ত আমলে যে অনেকটাই শিথিল হয়ে গিয়েছিল এবং বিকেন্দ্রীকরণের চেহারা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলহর্ষবর্ধনের সময়ে ঐ বিকেন্দ্রীকরণ বিশেষভাবে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। প্রতিবেশী কিছু ছোট ছোট রাজ্য জয় করে হর্ষবর্ধন সাম্রাজ্য গঠন করলেও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় বিকেন্দ্রীকরণের ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। মৌর্য সম্রাট অশোকের সঙ্গে তুলনীয় না হলেও হিউয়েন সাঙের বিবরণের ওপর নির্ভর করলে বলা যায় যে তিনি ছিলেন একজন প্রজাহিতৈষী শাসক। শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনিই ছিলেন সর্বেসর্বা। এককথায় তাঁর সাম্রাজ্যের বেসামরিক শাসনব্যবস্থা তিনি নিজেই তত্ত্বাবধান করতেন।


  প্রশাসন ব্যবস্থার কেন্দ্রে হর্ষবর্ধন বিরাজ করলেও তিনি স্বৈরাচারী ছিলেন না। তাঁকে সাহায্য করার জন্য কেন্দ্রীয় স্তরে খুব সম্ভবত একটি মন্ত্রীপরিষদ ছিল। অর্থাৎ প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল যথেষ্ট সংগঠিত। মন্ত্রীপরিষদের স্পষ্ট উল্লেখ না থাকলেও হর্ষবর্ধনের থানেশ্বরের সিংহাসনে আরোহণ সংক্রান্ত যে তথ্য হিউয়েন সাঙের বিবরণে লিপিবদ্ধ হয়েছে তার থেকে এই বিষয়ে ধারণা লাভ করা সম্ভব।

   কেবল শাসনভার গ্রহণকালে বা শাসনকার্যের প্রারম্ভে হর্ষবর্ধন মন্ত্রীপরিষদের পরামর্শ গ্রহণ করেছিলেন মনে করলে ভুল হবে। বস্তুত, সমগ্র শাসনকাল ধরেই মন্ত্রীপরিষদের বা ঐ জাতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব ছিল। শাসনকার্যের সমস্ত খুঁটিনাটি দিক সম্পর্কে তিনি সজাগ ছিলেন। রাজ্য পরিভ্রমণের সূত্র ধরে তাঁর জনসংযোগ বৃদ্ধি পেয়েছিল এসবই ঠিক। কিন্তু সংকটকালে বিশেষ করে অন্য রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধ সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণের ব্যাপারে অথবা অভ্যন্তরীণ কোনো জটিল পরিস্থিতির মোকাবিলায় তিনি মন্ত্রীপরিষদের পরামর্শ ও সাহায্য নিতেন।


   হর্ষবর্ধন যে এককভাবে রাজকার্য চালাতেন না—অমাত্য ও উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের সাহায্য নিতেন তার প্রমাণ মেলে সেই সময়ের শিলালৈখিক ও সাহিত্যিক উপাদানে। হর্ষবর্ধনের বাঁশখেরা ও মধুবন তাম্রশাসনে উদ্ধৃত উচ্চপদ ও পদস্থ ব্যক্তিদের কথা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। এই সমস্ত পদ তথা পদাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলি হল মহাসামন্ত, মহারাজ, মহাপ্রমাতার, দুঃসাধ্য-সাধনিক (‘দুঃসাধ্যসাধনিক’), উপরিক, বিষয়পতি। প্রসঙ্গত বলা যায় ঐ তাম্রশাসনগুলিতে মহারাজ, সামন্ত, মহাসামন্ত প্রভৃতি শব্দগুলি বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন মহাক্ষপটলাধিকরণাধিকৃত-সামন্ত মহারাজ, মহাক্ষপটলিক-সামন্তমহারাজ এবং মহাপ্রমাতার-মহাসামন্ত।


  হর্ষের রাজদরবারে উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের মধ্যে মহাসন্ধিবিগ্রহাধিকৃত, মহাবলাধিকৃত ও মহাপ্রতিহারের উল্লেখ আছে হর্ষচরিতে।গুপ্ত, এমনকি মৌর্য আমলেও এগুলির অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। যাই হোক না কেন, মহাসন্ধি-বিগ্রহাধিকৃত ছিলেন বিদেশনীতি অর্থাৎ যুদ্ধও শান্তিবিভাগের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী ; মহাবলাধিকৃত ও মহাপ্রতিহাররা ছিলেন যথাক্রমে সামরিক বিভাগের প্রধান এবং প্রধান প্রাসাদরক্ষী। এগুলি ছাড়াও হর্ষচরিতে ক্ষুদ্র পদ তথা পদাধিকারীদের উল্লেখ আছে। এঁরা হলেন সেনাপতি, বৃহদশ্ববার (অশ্ববিভাগের প্রধান) ও কটুক (অপরাধীর বিচার সংক্রান্ত দায়িত্ব প্রাপ্ত)। হর্ষবর্ধনেরমধুবন ও বাঁশখেরা তাম্রশাসন এবং হর্ষচরিতে উল্লেখিত কোনো কোনো পদ বা পদাধিকারীর সঙ্গে সামন্ত মহারাজ, মহাসামন্ত প্রভৃতি অভিধা সংযুক্ত থাকার বিষয়টি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

  হর্ষবর্ধনের প্রশাসনিক ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান দিক হল সামরিক সংগঠন। থানেশ্বরের একটি ক্ষুদ্র রাজবংশকে যেহেতু তিনি বিস্তৃত রূপ দিয়েছিলেন এবং পরাভূত হলেও দাক্ষিণাত্যের বিখ্যাত চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, সেহেতু তাঁর যে সুদক্ষ সামরিক বাহিনী ছিল, সেই বিষয়ে কোনো সংশয় নেই।প্রায় সমগ্র ভারতের অধীশ্বর মৌর্যদের রণহস্তীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৯ হাজার এবং অশ্বারোহী সৈন্য ছিল ত্রিশ হাজার। এই দিক থেকে বিচার করলে হর্ষের সামরিক বাহিনীর বিশালতা স্বীকার করতেই হয়।


   হর্ষবর্ধন যুদ্ধ যাত্রাকালে নিজ সেনাবাহিনীর মধ্যে রাজাদের প্রেরিত সৈন্য ও অশ্বসমূহ দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন, এমন কথা বলা হয়েছে হর্ষচরিতে। সামরিক তথা সামগ্রিক শাসনব্যবস্থায় গুপ্ত আমলের কিছু ধারা হর্ষের সময় বজায় ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় গুপ্তযুগের ন্যায় হর্ষের আমলেও কিছু পদ ছিল বংশানুক্রমিক।গুপ্তযুগের ন্যায় এই যুগেরও একটি বৈশিষ্ট্য ছিল যে উচ্চপদাধিকারীদের বেতন নগদ অর্থে প্রদান করা হত না—কোনো কোনো ক্ষেত্রে জমি বন্দোবস্তও করে দেওয়া হত। ২৪ অবশ্য সামরিক বাহিনীকে সাধারণভাবে নগদ অর্থে বেতন দেওয়ার রীতি ছিল।


  খনি, বাণিজ্য প্রভৃতি থেকে রাজস্ব সংগৃহীত হলেও রাজকোষে অর্থ জমা পড়ত প্রধানত ভূমি বা জমি থেকে। রাজকীয় এবং ব্যক্তিগত মালিকানাভুক্ত জমি—উভয় ধরনের জমিই ছিল। উর্বর ও অনুর্বর জমির মধ্যে একটা পার্থক্য করা হত এবং উভয় জমির মধ্যে দামের তফাতও ছিল। উর্বর জমিতে যে ভালো ফসল হত তার প্রমাণ মেলে হিউয়েন সাঙের বিবরণে।উত্তর-পশ্চিম ভারতে আখ ও গমের চাষ হত। মগধ ও আরো পূর্বদিকের এলাকাগুলিতে ধান চাষও ভালো হত। এছাড়া, বিভিন্ন রাজ্যে ডাল, নানা রকমের ফল বিশেষ করে আখ ও সব্জীর উল্লেখ পাওয়া যায় তাঁর বিবরণে।


  সাধারণভাবে কৃষকেরা তাদের উৎপাদিত ফসলের এক-ষষ্ঠাংশ ভূমিকর হিসাবে প্রদান করত। কখনো কখনো নগদ অর্থে রাজস্ব প্রদান করা হত। রাজস্ব দফতর জাতীয় কোনো প্রতিষ্ঠান নিশ্চয়ই ছিল, তবে তা কি নামে পরিচিত ছিল নিশ্চিত করে বলা শক্ত। যদিও হিসাবরক্ষা বিভাগ (অক্ষপটল) নামে একটি বিভাগের অস্তিত্ব ছিল,রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত মূল দায়িত্ব ছিল হর্ষবর্ধনের নিজের হাতেই। সমকালীন উপাদান থেকে জানা যায় যে বণিকরা ফেরী পারাপার সংক্রান্ত অল্প শুল্ক দিয়েই দেশের প্রায় সর্বত্র বাণিজ্য করতে পারত। এছাড়া পণ্য বিক্রির জন্যও তারা সরকারকে শুল্ক দিত।

  হর্ষবর্ধন রাজকোষে জমা পড়া অর্থ তথা জাতীয় আয় চার ভাগে ভাগ করে খরচ করতেন। একটি ভাগ বরাদ্দ করেছিলেন সরকারি ব্যয় নির্বাহের জন্য। একটি ভাগ নির্দিষ্ট ছিল রাজকর্মচারীদের বেতনের জন্য। তৃতীয় ভাগটি বরাদ্দ করা হয়েছিল পণ্ডিত ও গবেষক তথা শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্যের জন্য এবং চতুর্থ ভাগটি নির্দিষ্ট ছিল ধর্মীয় সম্প্রদায়সমূহকে তাদের গুণাবলী জনিত কারণে দান-ধ্যানের জন্য।

   

  হর্ষবর্ধনের আমলে শাসক তথা সরকারের প্রতি কাজকর্মের বিশেষ স্বীকৃতি স্বরূপ পুরোহিত তথা ব্রাহ্মণদের ভূমিদানের প্রথা প্রচলিত ছিল। এর সুবাদে পুরোহিত শ্রেণীসমস্ত রকম কর প্রদান থেকে রেহাই পেতেন। হর্ষর সময়ে ভূমিদান প্রথার ক্ষেত্রে একটি নতুন ব্যবস্থা চালু হয় এবং তা হল শুধু ব্রাহ্মণ নয় রাজকর্মচারীদের ক্ষেত্রেও ভূমিদান প্রথার সূত্রপাত।


  যাঁরা দস্যুদের ধরার কাজে লিপ্ত থাকতেন এবং প্রমাতার, যিনি বিচার বিভাগীয় শাসন পরিচালনার সঙ্গে কোনোভাবে যুক্ত ছিলেন। হর্ষবর্ধনের আমলে দুঃসাধ্যসাধনিকরা যে অপরিহার্য ছিলেন তা সমকালীন বিদেশীদের চোখেও ধরা পড়েছে।চোর ডাকাতের উপদ্রব ছিল। এমনকি একবার ডাকাতের হাতে পড়ে তাঁকে সর্বস্ব হারাতে হয়েছিল। সুতরাং হর্ষবর্ধনের শাসনব্যবস্থায় আইন-শৃঙ্খলার খুব বেশি উন্নতি হয়েছিল তা বলা যাবে না।


  ফৌজদারি আইন তথা বিচারব্যবস্থার বেশ কড়াকড়ি ছিল। দণ্ডবিধি আগের তুলনায় কঠোর ছিল। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, নির্বাসন প্রভৃতি দণ্ডের প্রচলন ঘটেছিল। ডাকাতি বা লুণ্ঠন দেশদ্রোহিতার সমকক্ষ বলে বিবেচিত হত এবং এর শাস্তিস্বরূপ অপরাধীর ডানহাতটি কেটে নেওয়া হত। তবে অপরাধ লঘু হলে সাধারণ অর্থদণ্ড চালু ছিল। অপরাধীর নির্দোষিতা পরীক্ষা করার জন্য কখনো কখনো অগ্নি, জল প্রভৃতির মাধ্যমে দৈব পরীক্ষা করা হত। দণ্ডবিধির এই কঠোরতা পরোক্ষভাবে প্রমাণ করে যে গুপ্তযুগের তুলনায় এই যুগে অপরাধের সংখ্যা বেড়েছিল।

  


  


  

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top