হর্ষবর্ধন কে সকলোত্তরপথনাথ বলা হয় কেন

 হর্ষবর্ধন কে সকলোত্তরপথনাথ বলা হয় কেন



  দাক্ষিণাত্যের চালুক্য লিপিতে হর্ষকে ‘সকলোত্তরপথনাথ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। চালুক্য রাজা দ্বিতীয় পুলকেশীর আইহোল শিলালিপিতে হর্ষকে পরাজিত করার কথা বলা হলেও ‘সকলোত্তরপথনাথ’কথাটির উল্লেখ নেই। পরবর্তী চালুক্য শাসক প্রথম বিক্রমাদিত্য ও দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্যের নিরপান, করনুল তোগড়চেদু শিলালেখতে দাবি করা হয়েছে, তাদের পূর্বপুরুষ ‘সকলোত্তরপথনাথ’ হর্ষকে পরাজিত করেন। তবে নিরপান লেখতে হর্ষকে উত্তরাপথাধিপতি’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে।


  পূর্ব পাঞ্জাবের একটি ছোট রাজ্যকে উত্তর ভারতের বৃহত্তর সীমানায় সম্প্রসারিত করে হর্ষবর্ধন যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। উত্তর ভারতে তাঁর এই সাম্রাজ্য বিস্তৃতির বিষয়টিকে কিছু ঐতিহাসিক বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। এঁরা হলেন যথাক্রমে এম. এল. এট্রিনহাউজেন, কে. এম. পানিক্কর, আর. এস. ত্রিপাঠী প্রমুখ। এঁরা হর্ষবর্ধনকে সমস্ত উত্তর ভারতের প্রভু (‘সকলোত্তরপথনাথ’) বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু প্রকৃত অর্থে তিনি সমগ্র উত্তর ভারতের প্রভু ছিলেন কিনা সে বিষয়ে গভীর সংশয় রয়েছে।

  হর্ষবর্ধনের তরফে কোনো সূত্র বা উপাদানে তাঁকে সকলোত্তরপথনাথ বা ঐ জাতীয় কোনো অভিধায় অভিহিত করা হয়নি। তিনি ঐ অভিধায় চিহ্নিত হয়েছেন দাক্ষিণাত্যের চালুক্যদের লেখমালায়। দ্বিতীয় পুলকেশীর পরবর্তী চালুক্য শাসকরা যথা প্রথম বিক্রমাদিত্য ও দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্যের নিরপান, করনুল ও তোগরচেদু, শিলালেখতে দাবি করা হয়েছে যে, তাঁদের পূর্বপুরুষ খ্যাতিমান দ্বিতীয় পুলকেশী সমগ্র উত্তর ভারতের প্রভু (‘সকলোত্তরপথেশ্বর’) হর্যকে পরাজিত করে ‘পরমেশ্বর’ অভিধা ধারণ করেছিলেন। ঐ লেখগুলির মধ্যে নিরপান লেখতে হর্ষকে ‘উত্তরাপথাধিপতি’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। 


  হর্ষবর্ধনের সমসাময়িক কোনো লেখ বা সাহিত্যিক উপাদানে তিনি ঐ অভিধাপ্রাপ্ত হননি। হর্ষের নিজস্ব শিলালৈখিক উপাদান মধুবন ও বাঁশখেরা তাম্রশাসন এবং নালন্দা ও সোনপাত তাম্ৰসীল লেখ কোথাও তাঁর সম্পর্কে ঐ ধরনের কথা বলা হয়নি। এমনকি যে দ্বিতীয় পুলকেশী হর্ষবর্ধনকে পরাজিত করেছেন তিনিও আইহোল প্রশস্তিতে তাঁকে ‘সকলোত্তরপথনাথ’ বলে উল্লেখ করেননি।

 

  হর্ষবর্ধনের গুণগ্রাহী ও তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ পর্যন্ত হর্ষকে তাঁর বিস্তারিত বিবরণের কোথাও ‘সকলোত্তরপথেশ্বর’ বা ঐ জাতীয় কোনো অভিধা প্রদান করেননি। হর্ষ যে দ্বিতীয় পুলকেশীর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন তার ইঙ্গিত অবশ্য তিনি দিয়েছেন। মো-হ-ল-চ বা মহারাষ্ট্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি এক জায়গায় লিখেছেন, “অধুনা শিলাদিত্য মহারাজ পূব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত সব জাতিকে জয় করে নিয়েছেন।…কিন্তু একমাত্র এই রাজ্যের লোকেরাই তাঁর অধীনতা মেনে নেয়নি।” 


    দ্বিতীয় পুলকেশীর পরবর্তীকালের অপেক্ষাকৃত দুর্বলচেতা শাসকেরা নিজেদের সাম্রাজ্যেরপূর্ব গৌরব বা মাহাত্ম্যকে উচ্চে তুলে ধরার জন্য হর্ষবর্ধনের ওপর দ্বিতীয় পুলকেশীর জয়লাভকে ঐভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। অর্থাৎ তাঁদের পূর্বপুরুষ দ্বিতীয় পুলকেশী সামরিক দিক থেকে এতই ক্ষমতাশালী ছিলেন যে সকল উত্তরপথের প্রভু হর্ষবর্ধনকেও তিনি পরাজিত করেছিলেন।


  উত্তর ভারতের এক বিশাল অঞ্চলে হর্ষের সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। থানেশ্বর বা পূর্ব পাঞ্জাব কনৌজ বা উত্তরপ্রদেশের দোয়াব, মগধ বা বিহার, পশ্চিম বাংলা, উড়িষ্যা, কঙ্গোদ বা গঞ্জাম অঞ্চলে হর্ষের সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল বলে মনে করা হয়। পরবর্তী চালুক্য রাজাগণ তাদের পূর্বসূরীদের কৃতিত্বকে মহিমান্বিত করতে গিয়ে হৰ্ষকে চালুক্য লিপিতে সকলোত্তরপথনাথ’ বলে অভিহিত করেছিলেন। 

   

    

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *