আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধের সবচেয়ে বড় ঘটনা হলো ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। আগের দেড়শ বছরের বাংলার ইতিহাসে এমন ব্যাপক ও ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ নেই। স্বল্পকাল স্থায়ী খাদ্যাভাব দেখা দিত বড় ধরনের দুর্ভিক্ষ ছিলনা। ইংরেজ,ফরাসি ,ও ওলন্দাজদের নথিপত্রে বাংলার দুর্ভিক্ষের কথা নেই। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সবচেয়ে বড় কারন হলো দীর্ঘস্থায়ী অনাবৃষ্টি। 1768 খ্রিস্টাব্দে আগস্ট মাস থেকে 1769 খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বাংলা ও বিহার অস্বাভাবিক ঘটনা ও শস্যহানী ঘটেছিল । গোটা 76 এর দুর্ভিক্ষ চলেছিল। প্রধানত এটি ছিল এক বছরের দুর্ভিক্ষ কিন্তু ব্যাপক ও ভয়ঙ্কর পরিণতিতে এই দুর্ভিক্ষ পূর্বের ও পরের সব দুর্ভিক্ষকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। দুর্ভিক্ষ চলাকালীন বিভিন্ন রোগ মহামারী আকারে দেখা দিয়েছিল। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের প্রধান কারণ ছিল খাদ্যভাব।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে বাংলার অর্থনৈতিক ওপর গভীর প্রভাব রেখেছিল। বাংলার এক কোটি লোক প্রাণ হারিয়েছিল। এক-তৃতীয়াংশ জমি অনাবাদি হয়ে যায়। কৃষি উৎপাদন কমেছিল। খাদ্যশস্যের দাম বেড়েছিল। হোন্ডার জানিয়েছেন যে, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর থেকে বাংলার অভিজাতদের অবক্ষয় শুরু হয়েছিল। 1775 খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস লিখেছেন যে, বাংলার জমিদারদের কেউই অবস্থাপন্ন নন। নাটোরের রানী ভবানী নিয়মিত রাজস্ব দিতে না পারায় তারা জমিদারি কেড়ে নেওয়া হবে বলে ভয় দেখানো হয়। বীরভূম ও বিষ্ণুপুরের রাজারা সময়মতো রাজস্ব না পারায় কারারুদ্ধ হন। অনেক সময় মত রাজস্ব দিতে না পারায় ইজারা পাননি। ঠিক এই সময় কম্পানির জমিদার নিলামে জড়িয়ে পাঁচ বছরের জন্য রাজস্বের বন্দোবস্ত করেছিল। জমির পরিমাণ ছিল বেশি, চাষের লোক ছিল কম এজন্য কৃষকের দেয় খাজনার হার কমে ছিল। বাংলার কৃষি অর্থনীতি কে প্রাধান্য স্থাপিত হয়েছিল।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে বাংলার শিল্পী ও কারিগরদের একাংশ ধ্বংস হয়ে যায়। তাঁতী,রেশম শিল্পী,গুটি পোকার পালক, স্বর্ণকার, চুনের মজুর ও লবণ শ্রমিকদের একাংশ ধ্বংস হয়। নৌকার মাঝি গাড়িচালক ও অন্যান্য শ্রেণীর শ্রমিকদের অনেক প্রাণ হারিয়েছিল। দুর্ভিক্ষের পরবর্তী বছরগুলোতে রেশম ও বস্ত্র উৎপাদন হ্রাস পেয়েছিল। এই সব পণ্যের দাম বেড়েছিল। সাধারণভাবে বাংলায় খাদ্যশস্যের দাম ও শ্রমিকের মজুরি বেড়েছিল। বিশাল সংখ্যক কুশলী কারিগরের মৃত্যু হওয়াই বাংলায় উৎপন্ন শিল্প পণ্যের গুণগতমানের অবনতি দেখা দেয়। বাংলায় উৎপন্ন সব ভোগ্যপণ্য চিনি,লবণ,তেল,সুপারি পান,তামাক ইত্যাদির দাম বেড়েছিল। ইংরেজি অন্যান্য বিদেশি কোম্পানির কাগজপত্র এর উল্লেখ আছে। এসব কারণে বাংলার বাণিজ্যেও কমেছিল। বিদেশি কোম্পানিগুলো বাংলা থেকে সময় মতো রপ্তানি পণ্য সংগ্রহ করতে পারেনি।
অন্যদিকে বাংলার আইন শৃঙ্খলা অবনতি ঘটেছিল। উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে উচ্চবিত্ত ও লুটপাটের ঘটনা অস্বভাবিক বেড়ে যায়। কোচবিহার ত্রীহুত ও মোরাং অঞ্চলে নতুন গজিয়ে ওঠা বনাঞ্চলে আশ্রয় নিতে ফকির ও সন্ন্যাসী দস্যুরা দলবদ্ধভাবে দস্যুবৃত্তি করতে থাকে। উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে অনেক কৃষক দস্যুদলের যোগ দিয়েছিল কোন কোন অঞ্চলে ডাকাতি ও লুটতরাজ কৃষক বিদ্রোহের রুপ নিয়েছিল।
সম্প্রতিকালে অধ্যাপক অতীশ দাশগুপ্ত, কৃষক ও শ্রমিক মানুষের প্রতিবাদী আন্দোলন বলে উল্লেখ করেছেন। দিনাজপুর,পূর্ণিয়া,বর্ধমান,হুগলি ও যশোর,জেলার লুটপাট রাজ এর প্রকোপ বেশি ছিল। গ্রামের পাইক ও জানা দরকার এদের বাধা দিতে পারেনি। ওয়ারেন হেস্টিংস, সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে এদের দমন করেন। মন্মন্তর বাংলার সমাজ জীবনকে শুধু আঘাত করেনি। বিভিন্ন অঞ্চলে প্রথাগত সামাজিক ও পারিবারিক জীবন ভেঙ্গে দিয়েছিল। ভাগলপুর ও রাজমহলের লোকেরা পাহাড়ি অঞ্চলে গিয়ে দস্যুবৃত্তি গ্রহণ করেছিল। দুর্ভিক্ষের পর ফিরে এলে এদের জাত যায়। দুর্ভিক্ষ সহ ও ভদ্র মানুষদের অশোক অন্যায় পথে জীবন যাপন করলে বাধ্য করেছিল। পারিবারিক জীবন বিপর্যস্ত হয়েছিল। পুত্রকন্যা বিক্রি করা ছিল অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা। বিক্রেতা ছিল বেশি ক্রেতা পাওয়া যেত না। তবে সামাজিক কাঠামো একেবারে ভেঙে যায় নি প্রবল ধাক্কা খেয়েছিল। অল্প মাল পড়ে সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর কোম্পানির শাসনের ওপর দু’রকমের প্রভাব রেখেছিল। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ধাক্কায় দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটেছিল। 17 71খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির দিরেক্টর সভা ডেপুটির নবাব রেজা খান এর নিন্দা করে তার শাসনের অবসান ঘোষণা করেছিল। কোম্পানির নিজের হাতে বাংলার শাসনভার তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের বাংলার কৃষি ও অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছিল তা পূরণের জন্য কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরিকল্পনা করেন। অনাবাদি জমিতে চাষ বসানো এবং বাংলার নব্য ধনীদের জমিতে আকৃষ্ট করা ছিল তার অন্যতম লক্ষ্য।
বিনয় চৌধুরীর মতে, 1770 এর দুর্ভিক্ষ অর্থনীতিকে আরো বেশি আর ভঙ্গ করেছিল (the fomine of 1769-70 was a far greater disarler for the economy the earlier process of decline was reinforced and under the whdihom created by formine it widened and deepend .) তিনি দেখেছেন যে দুর্ভিক্ষে কালিম মৃত্যুর জন্য এবং এলাকা পরিত্যাগ করে চলে যাওয়ার জন্য কৃষির পরিমাণ বাংলাদেশ 1-3 অংশ হ্রাস পেয়েছিল । যে সকল জেলায় সোম এর ঘাটতি ছিল সেখানে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। নদীয়া জেলায় যে এলাকা পরিত্যাগ হয়েছিল যেখান থেকে নির্ধারিত রাজস্বের 15% অ খন্ড । রাজবিহারী জেলার 4v গ্রামীণ ওপর গবেষণা 1768 69 এর জনসংখ্যা 1076 1770 থেকে 71 এর হ্রাস পেয়ে মাত্রা 343 জন দুর্ভিক্ষের প্রভাব তদন্ত করার জন্য 1770 এ নিযুক্ত কমিশনার তাদের প্রতিবেদনে লিখেছিলেন প্রদেশের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট অঞ্চলগুলি দুর্ভিক্ষের ফলে জ্ঞানহীন হয়ে পড়েছে। 1778 আমিনী কমিশনের রিপোর্ট কমিশনের সদস্য সংখ্যা কয়টি জেলা পরিষদ করেছিলেন।