সোলনের সংস্কার:
সোলনের অর্থনৈতিক সংস্কার:
1 ) গরীব নাগরিকরা জমি পুনর্বণ্টনের যে দাবি জানিয়েছিল, তা সোলন মেনে নেননি ঠিকই কিন্তু গরীব নাগরিকদের সমস্ত ঋণভার মকুব করে দিয়েছিলেন। তাঁর এই প্রথম বিধানের নাম ‘Seisachtheia’ বা ‘বন্ধন মোচন’। সোলনের কবিতা ও অ্যারিস্টলের রচনা থেকে জানা যায় যে, সোলন ‘হেকটেমোরস’ প্রথা বিলোপ করেন।
2) ‘হেকটেমোরয়’-রা উৎপাদিত শস্যের এক-ষষ্ঠাংশ জমির মালিককে দিতে না পারলে তাদের দাসে পরিণত করা হত। মহাজনের ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে ক্রীতদাস হিসাবে ঋণগ্রস্তকে এথেন্সের. বাইরে বিক্রি করে দেওয়া হত। সোলন তাদেরকে নাগরিক মর্যাদা দিয়ে ফিরিয়ে আনলেন। জাম বন্ধক রেখে ঋণ দেওয়ার প্রথাও তিনি তুলে দিলেন। আইন করলেন, ভবিষ্যতে কোন এথেনীয়কেই ঋণের জন্য দাসে পরিণত করা চলবে না।
3) মুষ্টিমেয় ধনী ব্যক্তির দখলে যাতে দেশের যাবতীয় ভূমি-সম্পত্তি চলে না যায়, সেজন্য সোলন আইন করে প্রত্যেক ব্যক্তি কী পরিমাণ ভূ-সম্পত্তি রাখতে পারবে তা নির্দিষ্ট করে দেন।
4) Solon খাদ্যশস্য রপ্তানী বন্ধ করলেন। অ্যাটিকায় উৎপন্ন জলপাইয়ের তেল কৃষ্ণসাগরীয় অঞ্চলে বিক্রি করে সেখানে থেকে গম এনে খাদ্য সমস্যার সমাধানের চেষ্টা চেষ্টা করেন। তবে তিনি আর্থিক লেনদেনের উপর কোন বিধিনিষেধ জারি না করায় সুদের সবোচ্চ পরিমাণও নির্দিষ্ট করে দেন।
5)এতদিন এথেন্সের নিজস্ব মুদ্রা না থাকায় এথেনীয়রা ইজিনার মুদ্রাই ব্যবহার করত। আইয়োনিয়ার অন্যান্য দেশে প্রচলিত মুদ্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে সোলন সর্বপ্রথম এথেনীয় মুদ্রার প্রবর্তন করেন। এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এথেনীয়দের যাবতীয় অসুবিধা দূর হল এবং এথেন্সের বাণিজ্য সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেল ।
6) এথেন্সের শিল্প-বাণিজ্যের প্রসারের উদ্দেশ্যে সোলন বিদেশী বণিক ও কারিগরদের এথেন্সে আহ্বান করে এনে নাগরিক অধিকার পর্যন্ত দিয়েছিলেন। আর যে-সব বিদেশী কারিগর এথেন্সে বসবাস করছিল, তাদেরও নাগরিক অধিকার দিলেন। তিনি প্রত্যেক পিতাকে তাঁর পুত্রের জন্য একটি শিল্পকার্য শেখানোর নির্দেশ দেন। এইভাবে এথেন্সের ভবিষ্যৎ শিল্পসমৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করলেন।
7)ব্যয় সংকোচ করার জন্য পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান যেমন–বিবাহ, শ্রাদ্ধ ইত্যাদিতে সর্বোচ্চ ব্যয়ের পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেন, কিন্তু রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে তিনি কতটা ব্যয় সংকোচ করার চেষ্টা করেন, তা আমরা জানি না।
সোলনের রাজনৈতিক সংস্কার:
1)অভিজাতদের একচেটিয়া রাজনৈতিক প্রাধান্যকে খর্ব করার জন্য পূর্বেকার আর্থিক ভিত্তিতে বিভক্ত তিন শ্রেণীর নাগরিক বাদে থিটিস (Thetes) নামে আর একটি শ্রেণী করে,সাধারণ চাষী, শ্রমিক ও গরীর কারিগরদের কিছু রাজনৈতিক অধিকার দিয়ে তাদের বঞ্চনার কিছুটা অবসান করলেন।
2)সোলন গণপরিষদের অধিকার বৃদ্ধি করে যেন গণতন্ত্রের ভিত্তিটাকে তৈি করলেন। গণপরিষদকে আর্কন ও অন্যান্য ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করবার একচ্ছত্র অধিকন দিলেন। ম্যাজিস্ট্রেটদেরকে তাদের কাজকর্মের জন্য গণপরিষদকে জবাবদিহি করতে হলে হির হল। কোন কর্মচারী, এমনকি আর্কন যদি দেশদ্রোহিতার কাজ করে, তবে তার দণ্ডবিধান এর দায়িত্ব গণপরিষদ কে দেওয়া হল।
3) সোলন Boule নামে পরিচিত পরিষদের পুনর্গঠন করে এর ক্ষমতা বৃদ্ধি করলেন যে চারটি জাতি হিলে অ্যাটিকা ঐক্যবদ্ধ হয়, সেই চারটি জাতির প্রত্যেকটি দেশে একশ’জন প্রতিনিধি লটারীর মাধ্যমে নির্বাচিত করে মোট চারশ’জন সদস্য নিয়ে এ পরিষদ গঠিত হল। পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে এখানে আলোচনা হত। গণপরিষদে কোন কেন বিষয় নিয়ে আলোচনা চলবে তার কার্যক্রমও এই সভায় ঠিক হত।
4)ধনতান্ত্রিক আমলে থেকে এরিওপেগাস (Areopagus) বিভিন্ন ক্ষেত্রে অপ্রতিহত ক্ষমতা ভোগ করে আসছিল, সোলন সেই ক্ষমতার সংকোচন করলেন। আইন প্রণয়ন এবং শাসন কার্য সম্পর্কে এর যাবতীয় ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হলো।
5) সোলন যে হিলিয়া (Heliasa) আদালত প্রতিষ্ঠা করেন।সেমস্ত নাগরিক, এমনকি থিসিদের নিয়ে তিনি একটি আদালত গঠন করলেন। লটারীর মাধ্যমে বিচারক নির্বাচিত করার ব্যবস্থা করলেন, যার ফলে দরিদ্র ব্যক্তিও বিচারক হওয়ার সুযোগ পেলেন। হয় পরিষদে কর্মকর্তা নির্বাচিত হত, আর হিলিয়াতে হত কর্মকর্তাদের গর্হিত কাজকর্মের বিচার)
সোলনের সামাজিক সংস্কার:
1)সোলন নরহত্যা এবং রক্তপাত বিষয়ক ড্রেকনের আইন বহাল রেখে বাদবাকি সব আইন বাতিল করে দেন।
2) শিক্ষার প্রসার ঘটানোর জন্য সোলন নির্দেশ দিলেন যে, কার্যকরী কোন শিক্ষাসন্তানকে না শেখালে বৃদ্ধ বয়সে পিতার ভরণপোষণের জন্য সন্তান দায়ী থাকবে না।শরীরচর্চা, সঙ্গীত, কাব্য ও সাহিত্যে প্রত্যেক বালক-বালিকার শিক্ষালাভ বাধ্যতামূলক বলে ঘোষণা করলেন।
3) জনগণের আলস্য ও বিরুদ্ধেও তিনি আইন করেন । নিসন্তন ব্যক্তিকে ইচ্ছামত সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ধারণ করার অধিকার দিলেন।
4)জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য তিনি ঘোষণা করলেন যে,কোন নাগরিক সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশ না নিলে, তাকে রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে।
মূল্যায়ন:
সোলনের সংস্কারগুলি পর্যালোচনা করে একথা বললে অন্যায় হবে না যে, তিনি এমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি যাকে বিপ্লবাত্মক বলা যায়। আসলে তিনি মধ্যপন্থা অবলম্বন করে এথেন্সে সর্বত্র একটা ভারসাম্য রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। তিনি নিজেই বলেছেন— ‘Avoid excess’—’বাড়াবাড়ি এড়িয়ে চলো। তাঁর সংবিধান অভিজাততন্ত্রের পুকে। অ্যারিস্টট্ল বলেন, সংবিধান হল নগররাষ্ট্রের হৃদয়। ধনী-দরিদ্রের সংঘর্ষের শ্রুতি হল সংবিধান পরিবর্তন সংশোধন। সোলনের সাংবিধানিক সংস্কার একথার ব্যতিক্রম নয়।তিনি এমন একটি সাংবিধানিক কাঠামো তৈরি করেছিলেন যার পরিবর্তন পেইসিট্রেটাস ও তাঁর পুত্র হিপ্পিয়াসও করতে পারেননি। মোট কথা সোলন যে বীজ বপন করেছিলেন, ব্রেইস্থিনিস ও পেরিক্লিসের শাসন সংস্কারের ফলে পরবর্তীকালে তা গণতন্ত্রের বিশাল মহীরূহে পরিণত হয়েছিল। সুতরাং সোলন হয়ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী ছিলেন না, কিন্তু সংস্কারকার্যের মাধ্যমে সামান্য যে গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডল রচন করেছিলেন, তাতে তাঁকে এথেনীয় গণতন্ত্রের পথিকৃৎ বলতে দ্বিধা নেই।