পল্লব যুগের প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করো।
পল্লব রাজতন্ত্র সাধারণভাবে ছিল বংশানুক্রমিক। পিতার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সিংহাসনে বসবেন এই ছিল নিয়ম। কিন্তু কখনো কখনো পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির দরুন এই নিয়মের ব্যতিক্রমও ঘটত। যেমনটি ঘটেছিল দ্বিতীয় পরমেশ্বরবর্মণের মৃত্যুর পর। বৈকুণ্ঠপেরুমল মন্দির লেখর বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে এই সময় পল্লব রাজ্যের বিশৃঙ্খলার অবসান ঘটাতে রাজ্যের উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা পল্লবদেরই আর একটি শাখার প্রভাবশালী ব্যক্তিহিরণ্যবর্মণের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল হন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে তাঁর প্রথম তিন পুত্র ঐ পদ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন এবং শেষপর্যন্ত কনিষ্ঠ পুত্র পল্লবমল্ল দ্বিতীয় মহেন্দ্রবর্মণ ১২ বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন। নন্দিবর্মণের সিংহাসনে আরোহণের বিষয়টিতে নির্বাচনের তুলনায় তাঁর নিজের প্রতি আস্থার বিষয়টি প্রতিভাত হয়ে উঠেছে।
শাসন কাজে রাজাকে সাহায্য করার জন্য সম্ভবত একটি মন্ত্রীপরিষদ ছিল। পল্লব আমলের শেষ দিকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতি নির্ধারণে মন্ত্রীপরিষদ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এর প্রমাণ মেলে পূর্বে উল্লেখিত দ্বিতীয় পরমেশ্বরবর্মণে মৃত্যুর পর রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়টি থেকে।
পল্লব আমলের বেশ কিছু উচ্চপদস্থ কর্মচারীর নাম পাওয়া যায় লেখসমূহে। একজন উল্লেখযোগ্য কর্মচারী হলেন ‘রহস্যাধিকৃত’, যাঁকে রাজার ব্যক্তিগত সচিবের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করা হয়। এঁরা রাজার মৌখিক আদেশ লিপিবদ্ধ করে। রাখতেন। পল্লব যুগের লেখতে মণিক-পণ্ডারম (মূল্যবান রাজকোষ)-এর উল্লেখ আছে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি যে বজায় ছিল এটি তার প্রমাণ। রাজকোষের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন কর্মচারীর নাম জানা যায়। এঁদের মধ্যে প্রধান দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন ‘কোষাধ্যক্ষ’। ‘কাপ্পার’ (রক্ষক) নামে একজন কর্মচারীর নাম পাওয়া যায়, যিনি সম্ভবত রাজার হীরক ও মূল্যবান রত্ন রক্ষার দায়িত্বে ছিলেন। ‘কোডুকপিল্লাই’ নামধারী কর্মচারীরা উপহার সামগ্রী রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। এছাড়া, সমাজের মর্যাদাশীল আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন পুরোহিতরা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মন্ত্রীদের মধ্যে প্রধান এবং পুরোহিত হতেন একই ব্যক্তি। এই সমস্ত উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা ছাড়াও পল্লব রাজাদের আমলে স্বর্ণকার, প্রস্তর নির্মাতা বা ভাস্কর প্রভৃতি কর্মচারীদের অস্তিত্ব উত্তরাধিকার সূত্রে বংশপরম্পরায় চলত।
পদাতিক, ঘোড়সওয়ার ও রণহস্তীর সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল পল্লব সেনাবাহিনী। তবে রথের ব্যবহার ছিল কম। আসলে পার্বত্য অঞ্চলে যুদ্ধের জন্য রথের প্রয়োজন ছিল না। পার্বত্য অঞ্চলে যুদ্ধের পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত ছিল অশ্বারোহী বাহিনী। পল্লব শাসকরা এই বিষয়টি বেশ ভালোই অনুভব করেছিলেন। তবে তা ছিল বেশ ব্যয়বহুল। কেননা অশ্বের সরবরাহ বিশেষ ছিল না। পশ্চিম এশিয়া থেকে ঘোড়ার আমদানি হত ঠিকই, কিন্তু তা ছিল যথেষ্ট ব্যয়সাধ্য। সেনাবাহিনীকে প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে রাখার দিকেই পল্লব শাসকদের ঝোঁক ছিল বেশি। তাঁরা প্রয়োজনে সামরিক কর্মচারীদের অসামরিক কাজেও নিযুক্ত করতেন। স্থলবাহিনী ছাড়াও পল্লব রাজাদের আগ্রহে নৌবাহিনীও গঠিত হয়েছিল। এমনকি মহাবলীপুরম ও নাগপত্তনম-এ দুটি নৌবন্দরও নির্মিত হয়েছিল। নৌবাহিনী যে শুধু যুদ্ধবিগ্রহের কাজে ব্যবহৃত হত তাই নয়, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সামুদ্রিক বাণিজ্যেও এর ভূমিকা ছিল। উল্লেখ্য, সামরিক বাহিনীর প্রয়োজনে রাজকোষের একটা বড় অংশ ব্যয় হত।
পল্লব আমলের শাসনব্যবস্থায় বিচার-বিভাগ সংক্রান্ত বিশেষ তথ্য পাওয়া যায় না লেখমালা থেকে। লেখসমূহে কেবল ‘ধর্মাসন’-এর উল্লেখ আছে, যা খুব সম্ভবত বিচার বিভাগীয় আদালতের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে হয়। কিন্তু প্রথম মহেন্দ্রবর্মণ রচিত ব্যঙ্গাত্মক নাটক মত্তবিলাস প্রহসনে বিচার সংক্রান্ত কিছু পদ্ধতির ইঙ্গিত মেলে।
পল্লব রাজ্য সাধারণভাবে কতকগুলি ‘বিষয়’ এবং ‘বিষয়’গুলি পুনরায় কতকগুলি ‘রাষ্ট্রে’ বিভক্ত ছিল। তবেপল্লব রাজ্যের তামিল অংশে বিভাগগুলি ছিল একটু ভিন্ন প্রকৃতির। সেখানের ভাগগুলি হল যথাক্রমে কোট্টম, নাড়ু (জেলা) ও ঊর বা গ্রাম। গ্রামগুলি ছিল প্রধানত দুধরনের—(১) এমন গ্রাম, যেখানে বহু বর্ণের মানুষ বাস করত। এই ধরনের গ্রামই ছিল সর্বাধিক। এইসব গ্রামের অধিবাসীরা ভূমি রাজস্ব প্রদানের মাধ্যমে রাজাকে কর দিত এবং (২) ব্রহ্মদেয় গ্রাম।
রাজস্ব আসত ভূমি, খনি, বাণিজ্য এবং বিভিন্ন ধরনের কারিগরদের কাছ থেকে। গাঙ্গেয় উপত্যকার ন্যায় পল্লবদের শাসনাধীন এলাকা তথা দক্ষিণ ভারতে সুবিস্তৃত চাষযোগ্য জমি ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই জমি থেকে রাজস্ব বাবদ অর্থ খুব বেশি পাওয়া যেত না। তাম্রশাসনের বর্ণনার ভিত্তিতে অনুমান করা হয় যে গ্রামের মানুষ উৎপন্ন ফসলের এক-ষষ্ঠাংশ থেকে এক-দশমাংশ কর হিসাবে রাজাকে প্রদান করত। ব্যক্তিগতভাবে কর প্রদানের পরিবর্তে সমগ্র গ্রামের রাজস্ব একসঙ্গে সংগ্রহ করে কর্মচারীদের মাধ্যমে তা পাঠিয়ে দেওয়া হত।
পল্লব শাসনব্যবস্থার একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল জমি জরিপ করা। উল্লেখ্য, পল্লব রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত সমস্ত জমি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নিরীক্ষণ করা হত। শুধু তাই নয়, গ্রামের এবং জেলার কর্মচারীগণ কর্তৃক জমির অধিকার ও করমুক্ত জমি সংক্রান্ত যাবতীয় বিবরণ লিপিবদ্ধ করে রাখা হত। এমনকি জমির মালিকানার কোনো বদল ঘটলে তাও যথাযথভাবে নথিভুক্ত করে রাখা হত। জমি জরিপ সংক্রান্ত পল্লব রাজাদের গৃহীত এই ব্যবস্থা নিশ্চিতভাবে সুশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থার পরিচয় বহন করে।
ভূমি রাজস্ব প্রদান ছাড়াও গ্রামের মানুষ এক ধরনের স্থানীয় কর দিত এবং তা ব্যয় হত মন্দিরের সাজসজ্জা, সেচ খালের সংস্কারের কাজে। আরও বিভিন্ন উৎস থেকে রাজস্ব বা শুল্ক আদায় হত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় তাড়ি বা মদ, ভারবাহী পশু, বিবাহ সংক্রান্ত অনুষ্ঠানের ওপর থেকে শুল্ক নেওয়া হত। এছাড়া, কুমোর, স্বর্ণকার বা স্যাকরা, ধোপা, তাঁবু বা তাঁবুতে বসবাসকারী নিরন্তর ভ্রমণরত ব্যক্তি বা যাযাবর, খেয়ামাঝি, শস্য বিক্রেতা, ক্রয়-বিক্রয়ের দালাল, তাঁতী, তেলের ঘানী, জেলে এবং বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র নির্মাতাদের কাছ থেকে শুল্ক গৃহীত হত।
সেযুগে বহু সংখ্যক কুয়ো, পুষ্করিণী বা পুকুর ও সেচখাল (ক্যানাল) নির্মিত হয়েছিল। ভাবলে অবাক হতে হয়। পল্লব আমলের এই ধরনের বড় কিছু পুকুর ও কুয়ো আজও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সেচ ব্যবস্থার উন্নতি ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য একটি পুষ্করিণী কমিটি থাকত, যদিও এর গঠন প্রণালী কেমন ছিল তা আমাদের জানা নেই। তবে প্রতি বছর এই কমিটির সদস্যরা যে বদল হতেন তা বোঝা যায়। কৃষি জমি, ধান ও সোনা প্রভৃতি দানের সূত্র ধরে সেচ সংক্রান্ত কাজকর্ম পালন করা হত। এই ধরনের দান পল্লব রাজারা করতেন, আবার কখনো কখনো ব্যক্তিগত বা যৌথ উদ্যোগেও গ্রামবাসীরা তা করতেন।
সেচ সংক্রান্ত কাজকর্মের সামগ্রিক গঠন কৌশল কিন্তু ছিল কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীনে। এমনকি একজন ব্যক্তি যদি নিজ প্রচেষ্টায় পুকুর খনন করে তাঁর জমিতে সেচের জল সরবরাহ করতে ইচ্ছুক হতেন তাহলেও তাঁকে গ্রাম্য প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তির কাছ থেকে অনুমতি নিতে হত। আবার যদি কোনো একটি গ্রামের চাষীরা প্রধান সেচ খাল বা নদী থেকে তাদের জমিতে জল সরবরাহের সুযোগ গ্রহণ করতে আগ্রহী হতেন তাহলে তাঁদের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন করার নিয়ম ছিল।
পল্লব শাসকদের আমলেই তামিল জেলাগুলিতে অন্ততপক্ষে কুড়িটি সভা কাজ করত। প্রসঙ্গত বলা যায় বড় সভা (মহাসভা) বসত বছরে একবার। তবে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতি নির্ধারণের ব্যাপারে ছোট সভা প্রায়ই ডাকা হত। সভার কাজ কী ছিল তারও উল্লেখ রয়েছে লেখমালায়। এগুলি হল যথাক্রমে গ্রামে মন্দির রক্ষণাবেক্ষণ, জলসেচ ব্যবস্থার পর্যবেক্ষণ, কৃষি জমির দেখাশোনা করা, জনগণনা, নথিপত্র সযত্নে রাখা। স্থানীয় বিচার সংক্রান্ত বিষয় ছিল সভার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ছোটোখাটো অপরাধের বিচার হত গ্রামেই। গ্রামের ওপরের স্তরে অর্থাৎ শহর বা জেলায় বিচারের দায়িত্ব ছিল রাজকর্মচারীদের ওপর। এছাড়া, আগেই বলা হয়েছে, রাজা ছিলেন সর্বোচ্চ বিচারক।
গ্রামের শাসন পরিচালনার জন্য স্পষ্টতই কিছু কমিটি ছিল। এর মধ্যে একটি কমিটি পরিচিত ছিল ‘ভারিয়াম’ নামে। তবে পল্লব আমলে এদের কাজ সম্পর্কে বিস্তৃত তথ্য পাওয়া যায় না। ‘আলুঙ্গাত্তর’ নামে আরো একটি গ্রাম্য কমিটির পরিচয় মেলে। পল্লব লেখসমূহে উল্লেখিত ‘গণ’ বলতে বোঝায় প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত একদল মানুষকে। কিন্তু পরবর্তীকালের পল্লব শাসকদের লেখয় যেভাবে ‘আলুঙ্গণত্তর’ শব্দটি উল্লেখিত হয়েছে তার ভিত্তিতে পণ্ডিতেরা মনে করেন এই কমিটির সদস্যরা ছিলেন উচ্চশিক্ষিত ব্রাহ্মণ।
পশ্চিমী চালুক্য ও অন্যান্য শক্তির সঙ্গে অবিরাম সংঘাতে লিপ্ত থাকা সত্ত্বেও পল্লবরা দক্ষিণ ভারতে এক সুগঠিত ওসুশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থার সৃষ্টি করেছিলেন। মৌর্য ও গুপ্তদের তুলনায় এই শাসনব্যবস্থায় কিছুটা অভিনবত্ব ছিল। একদিকে ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ। অপরদিকে ছিল স্থানীয় সংগঠনগুলির উদ্যোগ। পল্লব শাসকরা শাসনব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্র যেমন— কৃষি, জলসেচ, বাণিজ্য ও গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসনে কড়া নজর রাখতেন। আবার সাথে সাথে স্থানীয় উদ্যোগকেও সমর্থন জানাতেন। অবাধ স্বাধীনতার সুযোগে যাতে স্থানীয় কর্তাব্যক্তিরা প্রজাসাধারণের ওপর অত্যাচার চালাতে না পারেন সেই বিষয়টি তারা বিশেষভাবে যত্ন রাখতেন।