ভারতীয় চিত্রশিল্পী রাজা রবিবর্মা।
ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় নবজাগরণের সময়কাল। এই সময় ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যান্য ক্ষেত্রেও যখন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক গোলকধাঁধায় ভারতীয়দের চেতনা বিভ্রান্ত। এই অস্থির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যেই রাজা রবিবর্মার আবির্ভাব। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ভারতের অন্যতম সফল চিত্রশিল্পী হিসেবে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। ১৮৪৮ সালে রবিবর্মা ত্রিবাঙ্কুর (ত্রিবান্দ্রম)-র এক ধনী জায়গীরদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিক সূত্রে ত্রিবাঙ্কুর রাজবাড়িতে তাঁর অবাধ যাতায়াত ছিল। তাঁর চিত্রাঙ্কনের প্রতিভার কারণে রাজাবাহদুরও স্বয়ং রবিবর্মাকে উৎসাহিত করেছিলেন।
১৮৬৮ সালে থিওডর জেনসন নামক এক ইংরেজ শিল্পী ইংল্যাণ্ড থেকে ভারতে আসেন এবং ত্রিবাঙ্কুরের রাজবাড়িতে উপস্থিত হন। রাজা তাঁর শিল্পচর্চার নমুনা দেখে বিস্মিত হন। জেনসনের প্রভাবেই রবিবর্মাও পাশ্চাত্য শিল্পের প্রতি অনুরক্ত হয়ে ওঠেন এবং তাঁর কাছে শিল্পচর্চা শুরু করেন।
তিনিই প্রথম ভারতীয় শিল্পীদের মধ্যে তৈলচিত্র ও মডেল সামনে রেখে চিত্রাঙ্কন শুরু করেন। ১৮৭৩ ও ১৮৭৪ সালে মাদ্রাজে রবিবর্মার প্রথম ও দ্বিতীয় চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম প্রদর্শনী দেখে মাদ্রাজের তদানীন্তন ব্রিটিশ গভর্নর তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং তাঁকে স্বর্ণপদকে ভূষিত করেন। দ্বিতীয়বার চিত্র প্রদর্শনীতেও তাঁর আঁকা অনবদ্য চিত্র ‘শকুন্তলার চিত্র লিখন’ চিত্রটি সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে বিবেচিত হয় এবং তিনি স্বর্ণপদক লাভ করেন। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তখন থেকে রবিবর্মা ‘রাজা রবিবর্মা’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
১৮৭৫ সালে ইংল্যাণ্ডের যুবরাজ সপ্তম এডওয়ার্ড ভারত-ভ্রমণে এসে ত্রিবাঙ্কুরের রাজবাড়িতে আসেন। রাজা-বাহদুর যুবরাজকে সম্মান প্রদর্শনের কালে অন্য উপহারের সঙ্গে রবিবর্মার আঁকা কয়েকটি ছবি তাঁকে প্রদান করেন। ১৮৮০ সালের চিত্র প্রদর্শনীতে গাইকোয়াড়ের রাজা তাঁর চিত্রাবলী দেখে অভিভূত হন এবং তাঁকে স্বর্ণপদক দিয়ে সম্মানিত করেন। এইসময় ত্রিবাঙ্কুর, গাইকোয়াড়, বরোদা, ভাবনগর প্রভৃতি রাজবাড়ির অন্দরমহলের একাধিক ফরমাইসি চিত্রাঙ্কন করে তিনি বিপুল খ্যাতিসহ প্রভূত অর্থ উপার্জন করেন।
রবিবর্মার ছবির বেশিরভাগই বিভিন্ন রাজপরিবারের ফরামাইসি ছবি। ভারতে তৎকালীন যুগে তাঁর সমতুল্য শিল্পী খুব কমই ছিলেন। রাজপরিবার ও ব্রিটিশ শাসকবর্গের পৃষ্ঠপোষকতার কারণে তিনি স্বদেশে ও বিদেশে বিপুল খ্যাতি অর্জনে সক্ষম হন। রবিবর্মার আঁকা অধিকাংশ ছবিগুলি, পুরাণ, মহাভারত, রামায়ণ ইত্যাদির কাহিনী ও তৎকালীন যুগের সামাজিক প্রেক্ষাপট অবলম্বনে অঙ্কিত হয়।
কিন্তু তাঁর ছবিতে প্রাচ্য অপেক্ষা পাশ্চাত্যের প্রভাব অধিক পরিলক্ষিত হয়। রবিবর্মার ছবিগুলিতে রঙের নির্বাচন, প্রয়োগ এবং আলোছায়াসহ পরিপ্রেক্ষিতের রীতি বলিষ্ঠভাবে প্রতিফলিত হয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর চিত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন।
রবিবর্মার আঁকা ছবিগুলির মধ্যে ‘শকুন্তলার পত্রলিখন’, ‘সীতাহরণ’, ‘গঙ্গা অবতরণ’, ‘সমুদ্রশাসন’ খুবই বিখ্যাত। এছাড়াও ‘সীতা’, ‘দশরথের শোক’, ‘শকুন্তলা’, ‘হরধনু ভঙ্গ’, ‘কৌরব সভায় শ্রীকৃষ্ণ’, ‘গণপতি’, ‘সীতার পাতাল প্রবেশ’, ‘জটায়ুর পক্ষচ্ছেদ’, ‘সরস্বতী’, ‘লক্ষ্মী’ ইত্যাদি তাঁর বিখ্যাত ছবি ছিল। পোর্ট্রেট অঙ্কনে রবিবর্মার দক্ষতা ছিল উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন রাজদরবারে রাজা-মহারাজা ও গণমান্য ব্যক্তিদের প্রতিকৃতি আজও তাঁর শিল্পসত্ত্বার সাক্ষর বহন করে। তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠতম শিল্পকর্ম রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতীক চিহ্ন অঙ্কন)
রবিবর্মা শুধু শিল্পী হিসেবেই বিখ্যাত ছিলেন না, ব্যক্তি হিসেবেও তিনি নিরাহঙ্কারী, বিনয়ী, নম্র ও পরোপকারী। তিনি প্রত্যক্ষভাবে পরম্পরার পথ গড়ে তোলেননি ঠিকই, তবে তাঁর শিল্পকর্ম পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের অনুপ্রাণিত করেছিল এবং আজও করে। ১৯০৭ সালে এই মহান শিল্পীর দেহাবসান ঘটে।