ভারতীয় শিল্পকলায় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান

ভারতীয় শিল্পকলায় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান


ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে যখন ভারতীয় শিল্প সংস্কৃতি পাশ্চাত্য প্রভাবে অতিমাত্রায় প্রভাবিত, তখন ভারতীয় শিল্পীদের মধ্যে রাজা রবিবর্মার পরেই যিনি সমাদৃত হতেন তিনি হলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।তাঁর পিতা ছিলেন দ্বারকানাথের পৌত্র গুণেন্দ্রনাথ।


কিছুকাল সংস্কৃতি কলেজে অধ্যয়ন করার পর প্রথমে ইটালিয়ান শিল্পী সিগনোর গিলার্ডি এবং ইংরেজ শিল্পী সরকারি আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ চার্লস পামারের কাছে তিনি অল্পকালের জন্য চিত্রাঙ্কনবিদ্যা শিক্ষা করেন। এইসময় তিনি কালি-কলমের ড্রয়িং এবং পেনসিল ড্রয়িং অঙ্কনে পারদর্শীতা অর্জন করেন। পামার সাহেবের কাছে তিনি পরিপ্রেক্ষিত (Perspective) ও অনুপাত (Proportion) বিষয়ে ফলিত জ্ঞান লাভ করেন। পাশ্চাত্যের চিত্রশৈলীর প্রতি তাঁর অপরিসীম আকাঙ্খা থাকলেও এই রীতিতে চিত্রাঙ্কন করে তিনি তৃপ্তি পাননি। এরপর শুরু হয় তাঁর ভারতীয় চিত্রাঙ্কনের রীতির পুনরুদ্ধারের সাধনা।


অবনীন্দ্রনাথ ভারতীয় শিল্পশৈলীর সাথে পাশ্চাত্যের শিল্পশৈলী মিশিয়ে এক নতুন আঙ্গিকের শিল্পরীতির প্রবর্তন করেন এবং প্রথমে এই আঙ্গিকেই পরপর ছবি আঁকতে থাকেন। এইসব ছবিগুলির বিষয়বস্তু ভারতীয় সনাতনী আদর্শের উৎস থেকে উৎসারিত হলেও সেগুলিতে প্রাচ্যের তুলনায় পাশ্চাত্যের প্রভাব ছিল অনেকটাই বেশি। ১৮৯৭ সালে কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলের তৎকালীন অধ্যক্ষই.ভি.বি. হ্যাভেলের সাথে তাঁর পরিচয়ের পর তিনি ভারতীয় চিত্রকলার উৎস সন্ধানে রত হন। 


 ১৯০৫ সালে হ্যাভেল তাঁকে সরকারি আর্ট স্কুলের সহাধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত করেন। ১৯১৬ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সরকারি আর্ট স্কুলে তাঁর অন্যতম প্রিয় ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন—নন্দলাল বসু, অসিত কুমার হালদার প্রমুখ। পরবর্তী অধ্যক্ষ পার্সি ব্রাউনের সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণে তিনি সরকারি পদ ত্যাগ করেন। ১৯১২ সালে অবনীন্দ্রনাথ C.IE উপাধিতে ভূষিত হন। তিনিও গগণেন্দ্রনাথ ইণ্ডিয়ান সোসাইটি অফ্ ওরিয়েন্টাল আর্ট’ প্রতিষ্ঠায় প্রধান উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। ১৯২১ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বাগেশ্বরী অধ্যাপক’ পদ অলঙ্কৃত করেন এবং রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর কিছুদিন বিশ্বভারতীর আচার্য হিসেবে কাজ করেন।


পাশ্চাত্য চিত্রশৈলী ছাড়াও গগণেন্দ্রনাথ চিনা ও জাপানী শিল্পী তাইওয়ান ও ওকাকুরার কাছে ‘ওয়াশ পেইন্টিং’ এবং তৈলচিত্রের অঙ্কনশৈলী বিষয়ে তালিম নেন। অবনীন্দ্রনাথের প্রথম দিকের আঁকা রাধাকৃষ্ণের লীলা সমৃদ্ধ ছবিগুলি ভারতীয় ভাবধারা যুক্ত ছিল ঠিকই,কিন্তু এরপরে চণ্ডীদাসের পদাবলী অবলম্বনে রাধাকৃষ্ণের চিত্রের যে নতুন সিরিজ তিনি অঙ্কন করেন তা তাঁর শিল্পভাবনা বিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। তাইওয়ান ও ওকাকুরার সান্নিধ্য লাভের পর তিনি যেসব ছবি আঁকেন তার মধ্যে ‘শাহজাহানের মৃত্যু’, ‘কয়েদি’, ‘বাহাদুরশাহ’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। উড়িষ্যা ভ্রমণকালে কোনারকের মন্দিরসহ উড়িষ্যার বিভিন্ন স্থাপত্য-ভাস্কর্য তাঁর জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। এই সময়ের ছবিগুলির মধ্যে ‘দেবদাসী’, ‘কাজোরী নৃত্য’, ‘কথক ঠাকুর ইত্যাদি বিখ্যাত। এছাড়াও ‘পথিক ও পথ’, ‘পুষ্পধারা’, ‘কবিকঙ্কন’, ‘কৃষ্ণমঙ্গল’, ‘গান্ধিজী’, ‘রবীন্দ্রনাথ’ (প্যাস্টেল রঙে আঁকা) ইত্যাদি ছবি যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিল।


  ‘ভারতমাতা’ ছাড়াও ‘গণেশ জননী’ তাঁর একটি অতি বিখ্যাত ছবি। এছাড়াও ‘ঔরঙ্গজেব বাদশা’, ‘শেষ বোঝা’, ‘কচ ও দেবযানী’ (ক্রেস্কো পদ্ধতিতে আঁকা), ‘অভিসার’, ‘শাস্তির পারাবার’ ইত্যাদি তাঁর বিখ্যাত চিত্রমালার অন্তর্গত। তাঁর জলরঙ, তেলরঙ ও প্যাস্টেল রঙে আঁকা প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলি ‘Landscape’ ভারতীয় চিত্রকলায় এক নতুন মাত্রা সংযোজন করে। ‘আরব্য রজনী’-র কাহিনী অবলম্বনে রচিত চিত্রগুলি অবনীন্দ্রনাথকে ভারতীয় শিল্পী সমাজে স্বতন্ত্র পরিচিতি দান করে।


 সঙ্গীত ও সাহিত্যের অঙ্গনেও অবনীন্দ্রনাথের বিচরণ ছিল সাবলীল। তাঁর রচিত ‘শকুন্তলা’, ‘বুড়ো আংলা’, ‘রাজকাহিনী’, ‘ক্ষীরের পুতুল’ খুবই বিখ্যাত। তিনি বহু কবিতা ও ছোটোগল্প রচনা করেন। তাঁর প্রদত্ত বক্তৃতা ‘বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী’ গ্রন্থে মুদ্রিত আকারে সংকলিত আছে।


 অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশী-বিদেশী শিল্পশৈলীকে নিজের বিবেচনা সাপেক্ষে গ্রহণ করে স্বাধীনভাবে নিজের মন মত কাজ করতে বেশি পছন্দ করতেন। তাঁর একমাত্র পরিচয় ছিল তিনি শিল্পী, বিধাতা তাঁর হাতে তুলি ও বর্ণের ভাণ্ডার দিয়ে পাঠিয়েছিলেন, তাঁর প্রবন্ধে ও নিবন্ধেও সেই রঙের ছোঁয়া লক্ষ্য করা যায় | রূপসৃষ্টিই ছিল এই ‘রূপদক্ষ’-র প্রধান লক্ষ্য। শিল্প বিচার প্রসঙ্গে তিনি যেভাবে প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতবর্ষে পদচারণা করেছেন, যেভাবে তাঁর পরিক্রমণ ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস লিখেছেন তাতে তথ্য, তত্ত্ব, রস ও চিত্ররূপ স্বচ্ছভাবে ফুটে উঠেছিল। এই কারণেই ভারতীয় শিল্পীদের মধ্যে অবনীন্দ্রনাথকে ‘ভারতীয় শিল্পের জনক’ বা ‘শিল্পের গুরু’ বলে অভিহিত করা হয়। ভারতীয় তথা বাংলা চিত্রকলার ইতিহাসে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান অনস্বীকার্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *