হর্ষবর্ধনের কৃতিত্বের মূল্যায়ন।
সিংহাসনে আরোহণের সময় তাঁর পিতৃবংশ পৃষ্যভৃতি এবং ভগিনীর সূত্রে প্রাপ্ত কনৌজের মৌখরী রাজবংশে এক জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল।একদিকে বাবা-মার মৃত্যু, দাদা রাজ্যবর্ধনের নিহত হবার ঘটনা এবং একমাত্র ভগ্নী রাজ্যশ্রীর স্বামীহারা অবস্থা। তাঁর হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করে তুলেছিল।এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মাত্র ষোলো বৎসর বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করে তিনি সাম্রাজ্যকে বিস্তৃত রূপ দিয়েছিলেন তাই নয়, আনুমানিক ৬৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আমৃত্যু বলিষ্ঠতার সঙ্গে শাসন চালিয়ে গিয়েছিলেন।
পূর্ব পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশের এক বৃহৎ অংশ, পরবর্তীকালে মগধ, পশ্চিমবাংলা, কঙ্গোেদ ও উড়িষ্যাকে কেন্দ্র করে জটিল আবর্তের মধ্যেও সাম্রাজ্যকে যে বৃহত্তর গণ্ডীর মধ্যে তিনি প্রসারিত করেছিলেন তা তার গৌরবের স্মারক। আসলে পরিস্থিতি ছিল জটিল। তাকে নিজ পক্ষে এনে নিজ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার কাজে তিনি সফল হয়েছিলেন। শশাঙ্কের মতো অসীম মনোবল ও বীরত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব সত্ত্বেও সাম্রাজ্যকে যে তিনি অটুট রেখেছিলেন তা তাঁর অপরিসীম কৃতিত্বের সাক্ষ্য বহন করে। হর্ষবর্ধন নিশ্চিতভাবে সমকালীন উত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে একজন প্রভাবশালী শাসকে পরিণত হয়েছিলেন। তা যদি না হতেন তাহলে পরবর্তী চালুক্য শাসকদের লেখমালায় তিনি ‘সকলোত্তরপথেশ্বর’ বা ঐ জাতীয় অভিধায় ভূষিত হতেন না।
হর্ষ এক অর্থে ভাগ্যবান। কেননা, বাণভট্ট ও হিউয়েন সাঙ-এর মতো জীবনীকার তিনি পেয়েছিলেন। যদিও এঁদের কেউই তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবনী রেখে যাননি। তাঁর সম্পর্কে জীবনীকারদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসার সূত্র ধরেই আধুনিক কিছু ঐতিহাসিক তাঁকে এমন কিছু মর্যাদায় ভূষিত করেছেন, যা অতিরঞ্জন দোষে দুষ্ট বলে মনে হয়।
হর্ষবর্ধন ছিলেন একজন মহান ..শাসক, একজন সাহসী সামরিক নেতা এবং শিক্ষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক। সর্বোপরি, তিনি ছিলেন এক মহৎ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তাঁর সিংহাসনে আরোহণের বছর (৬০৬ খ্রিস্টাব্দ) থেকেই একটি অব্দ (হর্ষাব্দ)-র প্রচলন ঘটে, যা তার মৃত্যুর পরেও বহুকাল চালু ছিল বলে সাধারণভাবে মনে করা হয়। হিউয়েন সাঙ হর্ষবর্ধনকে একজন কর্মচঞ্চল শাসক হিসাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন যে শাসক হিসাবে হর্ষ ছিলেন সদাব্যস্ত। কখনও তিনি সামরিক পরিকল্পনা বা সামরিক অভিযান প্রেরণে ব্যস্ত। আবার কখনো বা বিশাল সাম্রাজ্যের কোথাও বিচারের ক্ষেত্রে ঘাটতি হচ্ছে কিনা, সম্মানীয় ব্যক্তিকে সম্মান প্রদর্শন করা হচ্ছে কিনা অথবা কোথাও কোনো অনিয়ম ঘটছে কিনা—এইসব কাজে তিনি সাম্রাজ্য প্রদক্ষিণ করতেন।
হর্ষর এক স্থায়ী সেনাবাহিনী ছিল। সেনাবাহিনীর যে বিবরণ তিনি দিয়েছেন তা খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। তিনি লিখেছেন যে প্রথম দিকে কম থাকলেও রাজত্বকালের শেষ দিকে হস্তীবাহিনীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৬০,০০০ এবং অশ্বরোহীর সংখ্যা ছিল এক লক্ষ। এছাড়া পদাতিক বাহিনী ছিল ৫০,০০০ বা ততোধিক। হিউয়েন সাঙ প্রদত্ত হর্যের এই সেনাবাহিনীর বিশালতা সম্পর্কে সন্দেহ থাকতেই পারে। তবে সাম্রাজ্য বিস্তারের ব্যাপারে হর্ষর যে একটি সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালী সামরিক বাহিনী ছিল সে বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ কম।
বৌদ্ধধর্ম ছাড়াও অন্যান্য ধর্মের প্রতি যে তিনি সহানুভূতিশীল ছিলেন তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হিউয়েন সাঙ প্রতি পাঁচ বৎসর অন্তর গঙ্গা ও যমুনা নদীর সংগমস্থলে অবস্থিত প্রয়াগে হর্ষ কর্তৃক আয়োজিত বিখ্যাত উৎসব বা মেলার বর্ণনা দিয়েছেন।
হর্ষবর্ধনের কর্মকাণ্ডের মূল্যায়নের সারবস্তু হল এই যে বাস্তবে তাঁর কৃতিত্ব যতটা না ছিল, তাঁর জীবনীকার ও গুণগ্রাহীরা তাকে তার বেশি মর্যাদায় ভূষিত করার চেষ্টা নিয়েছেন।বিন্ধ্যপর্বতের উত্তরাংশে ভারতের সমস্ত এলাকা তাঁর ছত্রছায়ায় না এলেও নিজ ক্ষুদ্র রাজ্যকে তিনিসাম্রাজ্যের মর্যাদা দিয়েছিলেন এবং উত্তর ভারতের সমস্ত না হলেও বৃহত্তর এলাকা তাঁর অধিকারে এসেছিল। সাম্রাজ্যে সুশাসন ও শৃঙ্খলা তিনি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। সর্বোপরি, তিনি ছিলেন শিক্ষা ও সংস্কৃতির একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর রাজত্বকালেই সমৃদ্ধির চূড়ায় পৌঁছেছিল। পরিশেষে বলা যায় হর্ষবর্ধনের কোনো প্রত্যক্ষ উত্তরসূরি ছিল না। তাঁর মৃত্যু হয়েছিল আনুমানিক ৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে পৃষ্যভূতি রাজবংশ তথা হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে।