পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীদের অবস্থান কেমন ছিল।
ঋগ্বৈদিক যুগের তুলনায় পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীর অবস্থান ও মর্যাদার অবনতি ঘটেছিল। একথা অবশ্য সত্য যে, পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীর উচ্চ প্রশংসা করা হয়েছে। শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে যে স্ত্রী হলেন স্বামীর অর্ধাঙ্গিনী। এছাড়া, ব্রাহ্মণসমূহে স্ত্রী-র সঙ্গে ‘পত্নী’ শব্দটির নিয়মিত ব্যবহার লক্ষ করা যায়। এর থেকে অনুমান করা সম্ভব যে স্বামীর জীবনে সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে সমান অংশীদার ছিলেন স্ত্রী। ‘জায়া’ হিসাবে তিনি দাম্পত্য জীবনকে মধুময় করে তুলতেন।
তৎকালীন শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রগতিতে নারীদের যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। গার্গী ও মৈত্রেয়ীর মতো এমন কিছু নারীর আবির্ভাব এ যুগে ঘটেছিল যাঁরা দর্শনতত্ত্বের আলোচনায় অংশগ্রহণ করতেন। এসব কিছু সত্ত্বেও ব্রাহ্মণসমূহ ও অন্যান্য পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যগুলিতে নারী সম্পর্কে যে সমস্ত কথা উচ্চারিত হয়েছে তা মোটেই তার উন্নত অবস্থান প্রমাণ করে না। খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকে রচিত মৈত্রায়ণী সংহিতায় বলা হয়েছে যে নারী অশুভ, মিথ্যাচারিণী এবং সর্বোপরি সুরার মতো একটি ব্যসন মাত্র। প্রধানত পুত্রের জননী ও ভোগ্যবস্তু হিসাবেই নারীকে বিবেচনা করা হত। এই কারণেই আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকে রচিত তৈত্তিরীয় সংহিতায় বলা হয়েছে যে নারী সম্ভোগ নিয়ে আসে।
এছাড়াও অন্যত্র শাস্ত্রকাররা নারীর ভোগ্যরূপকে অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে বারে বারে উল্লেখ করেছেন। এমনকি, শাঙ্খায়ন শ্রৌতসূত্র সূত্রে দক্ষিণার তালিকায় নারীকে স্থান দেওয়া হয়েছে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে স্পষ্টতই বলা হয়েছে যে কন্যা হল অভিশাপ। এই কারণে সন্তান-সম্ভবা নারীর একটি আবশ্যিক অনুষ্ঠান ছিল পুংসবন। গর্ভস্থ সন্তানটিকে পুত্র হিসাবে পাবার জন্যই মূলত এই অনুষ্ঠানটির প্রচলন ছিল। আপস্তম্ব ধর্মসূত্রে লেখা হয়েছে হৃদয় দিয়ে নারীকে প্রার্থনা করা উচিত নয় (নারীং ন হৃদয়েন প্রার্থয়েৎ)। অথচ নারীকে যথেষ্টভাবে ভোগ করতে কোনো বাধা ছিল না। এই ধর্মীয় গ্রন্থটিতেই নারী হত্যার জন্য যে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় তাকে কালোপাখী, শকুনি ও কুকুর হত্যার প্রায়শ্চিত্তের সমকক্ষ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
সুতরাং একথা বলতে বাধা নেই যে, পরবর্তীকালের সাহিত্যে নারীকে পণ্য ও ভোগ্যবস্তু বলে যে উল্লেখ করা হয়েছে তার মূল নিহিত ছিল পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে। শতপথ ব্রাহ্মণে স্বামীর পরে তাঁর উচ্ছিষ্ট খাদ্যদ্রব্য স্ত্রীর আহারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। অথর্ববেদে প্রাচীন সতীদাহ প্রথার কথা উল্লেখিত হয়েছে, যদিও তার প্রচলন ব্যাপক ছিল না। উচ্চ সম্প্রদায়, বিশেষত রাজন্যবর্গের মধ্যে বহুবিবাহের প্রচলন থাকায় নারীর মর্যাদার হ্রাসপ্রাপ্তি ঘটেছিল স্বাভাবিকভাবেই। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নারীর ছিল না। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও সে ছিল পরাধীন। পুরুষের সঙ্গে কোনো সভায় যোগদান করার অধিকার থেকে সে বঞ্চিত ছিল।
ঋগ্বেদিক যুগের ন্যায় এ যুগেও সমাজের প্রধান ভিত্তি ছিল ‘কুল’ বা পরিবার। পিতা অথবা তাঁর অবর্তমানে পরিবারের বড় ভাই ‘কুল’ পরিচালনা করতেন। ফলে সমাজ হয়ে উঠেছিল পুরুষতান্ত্রিক। পিতা ও পুত্রের মধ্যে সম্পর্ক ছিল মমত্ববোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত। দত্তক গ্রহণের রেওয়াজ প্রচলিত ছিল। সমাজ পুরুষতান্ত্রিক হওয়ায় পুত্র-সন্তানের প্রতি কদর আগের তুলনায় অনেক বেড়েছিল। কন্যাসন্তান কাম্য ছিল না। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ও অথর্ববেদে কন্যার জন্য শোক এবং পুত্রের জন্য আনন্দ প্রকাশ করা হয়েছে। অথর্ববেদের একটি স্তোত্রে আতিথেয়তার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ঐতরেয় আরণ্যকেও আতিথেয়তার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বস্তুত তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় অতিথির প্রতি কর্তব্যপরায়ণতা পারিবারিক আচার-অনুষ্ঠানের একটা অন্যতম অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।