নাট্যকার হিসেবে সফোক্লিসের অবদানের মূল্যায়ন করো ।
গ্রীক সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ট্র্যাজিক কবি সফোক্লিস এথেন্সের নিকটবর্তী কলোনাস নামক স্থানে আনুমানিক খ্রিস্ট পূর্ব ৪৯৫ অব্দে (মতান্তরে ৪৯৬/৪৯৭/৪৯৮) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সোফিল্লস নামক জনৈক ধনী অস্ত্রব্যবসায়ীর পুত্র ছিলেন।
কিশোর সফোক্লিস স্যালামিস বিজয় উৎসবে অনুষ্ঠিত একটি সঙ্গীতানুষ্ঠানে বালকদের নেতৃত্বে ছিলেন। ৪৬৮ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে ইস্কাইলাসকে এক নাট্য প্রতিযোগিতায় পরাস্ত করে পুরস্কার লাভ করেন এবং এথেন্সের শিল্প-রসিক মহলে দারুণভাবে সমাদৃত হন। এথেনীয়রা তাঁকে নিয়ে গর্ব অনুভব করত এবং ভালবেসে নাম রেখেছিল “অ্যাটিকার মক্ষিকা” (Attic bee)। নাট্যপ্রতিভায় মুগ্ধ হয়েই এথেনীয়রা তাঁকে সেনাপতি নির্বাচিত করেছিলেন। শৈশবে সফোক্লিস দেখেছেন এথেন্সেশান্তি, পূর্ণতা ; যৌবনে দেখেছেন ঐশ্বর্যময় এথেন্সকে, পৌঢ়ত্বে দেখেছেন যুদ্ধের উন্মাদনা, আর বার্ধক্যে দেখে গেলেন এথেন্সের গৌরবসূর্যের অস্তরাগ। আনুমানিক ৪০৫ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে (মতান্তরে ৪০৬) প্রায় নব্বই বছর বয়সে তিনি মারা যান। তখন এথেন্সের পরাজয় এবং এথেনীয় গণতন্ত্রের বিপর্যয় আসন্ন প্রায়।
সফোক্লিস ১১৩টি (মতান্তরে ১২০টি) নাটক রচনা করেছিলেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, মাত্র সাতটি নাটক পরবর্তী প্রজন্মের হাতে এল। অন্যান্য রচনার নিদর্শন বিচ্ছিন্নভাবে ঈজিপ্ট এবং প্রাচীন বাইজেনটাইন শহরে পাওয়া গেছে। তাঁর যে সাতটি নাটক পাওয়া গেছে, সেগুলি হলঃ (১) আন্তিগোনে, (২) এলেকট্রা (৩) ব্রাখিনিয়ায়, (৪) ওয়দিপৌস তুরান্নুস, (৫) আয়াক্স, (৬) ফিলোত্তেতেস্ এবং (৭) ওয়দিপৌস্ কোলোনেউস। এইগুলির মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয়, চতুর্থ এবং সপ্তম নাটকটি সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। সফোক্লিসের নাটকগুলির রচনাকাল নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে।উক্ত সাতটি নাটক ছাড়াও তাঁর আর একটি রচনা ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে পাওয়া গেছে। এটি ইজিপ্টে প্রায় প্যাপাইরাসের উপর লিখিত ৪০০ পক্তির একটি ‘স্যাটার প্লে’ (Satyr play)
সফোক্লিসের নাট্যশৈলী আলোচনা প্রসঙ্গে পণ্ডিতরা বলেন যে, ইস্কাইলাসের অনুকরণে তিনি নাটক রচনা শুরু করেছিলেন। পরে তিনি নিজস্ব রীতিতেই নাটক রচনা করেছিলেন। ট্র্যাজিক নাটক রচনায় সফোক্লিসের গভীর মনস্তাত্ত্বিক অন্তর্দৃষ্টি ও শিল্পকুশলতা তাঁকে শ্রেষ্ঠত্বের আসন দান করেছে। তিনি তার নায়ক-নায়িকাদের মধ্যে মানবতাবোধের সঙ্গে নীতির যে অন্তর্দ্বন্দু দেখিয়েছেন, তা-ই নাটকগুলিকে সর্বাধিক মহিমা দিয়েছে। তিনি জীবনকে আংশিকভাবে দেখেননি, সম্পূর্ণভাবে দেখেছেন। তাঁর নাটকগুলির মধ্যে ভাষার যে সৌন্দর্য এবং চরিত্রগুলির মধ্যে যে উজ্জ্বলতা, মহত্ত্ব ও মর্যাদা লক্ষ্য করা যায়, তা সত্যিই দুর্লভ। বিশেষ করে ‘এলেকট্রা’, ‘আন্তিগোনে’ ইত্যাদি স্ত্রীচরিত্র তাঁর সহানুভূতির স্পর্শে অপূর্ব মূর্তিতে ভাস্বর হয়ে উঠেছে।
ইস্কাইলাসের মতো বিশালতা হয়ত তাঁর নাটকে নেই, কিন্তু গভীরতা কম ছিল না। ইস্কাইলাস যেখানে মন ছড়িয়ে দিয়েছেন বিস্তীর্ণতায়, | সফোক্লিস সেখানে মনকে একটি বৃত্তে নিয়ে এসেছেন। ইস্কাইলাসের নাটকে রয়েছে বন্ধন ছিন্ন করার গান, মুক্তিকামী মানুষ। আর সফোক্লিসের নাটকে নেই বন্ধন ছিন্ন করার আর্তনাদ। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলি বন্ধন উপেক্ষা করে যায় তাদের চারিত্রিক মহিমায়। ইস্কাইলাসের নাটকে রয়েছে দুঃখের রহস্য-সন্ধান, মানুষের অনিঃশেষ শক্তি মানুষের বিদ্রোহ। সফোক্লিসের নাটকে রয়েছে মানুষের সহাক্ষমতা, দুঃখজয়ের শক্তি। আর ইউরিপিদিসে রয়েছে বিদ্রোহ নয় সমালোচনা, মানুষের অসহায়তা।
সফোক্লিস স্পষ্টভাবে এথেনীয় গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা ও সমস্যাবলী উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। থিবসকে কেন্দ্র করে সফোক্লিস যে তিনটি নাটক রচনা করেন, (‘আন্তিগোনে’, ‘ওয়দিপৌস তুরান্নুস’ এবং ‘ওয়দিপৌস কোলোনেউস’) তাতে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। ইস্কাইলাসের নাটক থেকেই পরিবার ও সম্পত্তিকে কেন্দ্র করে যে সংঘাত স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সফোক্লিসের নাটকেও সেই সংঘাত বা দ্বন্দ্ব স্পষ্ট। তাঁর নাটকে ‘ব্যক্তিত্ববাদ’-এর স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। তাই কেউ কেউ তাঁকে ব্যক্তিত্ববাদের জনক বলতে চেয়েছেন।
সফোক্লিস নাটকের মধ্যে নতুন নতুন রীতির অবতারণা করে ট্র্যাজেডি ও গ্রীক থিয়েটারের যথেষ্ট উন্নতি করেছিলেন। তিনি প্রথম ট্রাজেডির মধ্যে তৃতীয় চরিত্রের’ (থার্ড অ্যাক্টর সিসটেম) প্রবর্তন করে প্রচলিত যৌথদল অপেক্ষা অভিনেতার গুরুত্ব বৃদ্ধি করলেন। নাটকে সমবেত সংগীতও বারোটি থেকে পনেরোটি তিনিই প্রথম বাড়িয়ে দেন। তাঁর রচিত অপূর্ব গানগুলি নাটকগুলির উৎকর্ষ বৃদ্ধির সহায়ক হয়েছিল। তিনিই নাটকের মধ্যে সর্বপ্রথমে চরিত্র ও ঘটনার ক্রমবিকাশের উপর জোর দেন। এর ফলে অভিনয় শিল্পেরও উন্নতি হয়েছিল।
বিচিত্র ঘটনার সমাবেশ, ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত, দর্শকদের কৌতূহলের ক্রমবিকাশ এবং পরিণামের জন্য সাগ্রহ প্রতীক্ষা এবং শেষে চরমে উত্তরণ—ইত্যাদি সব নাটকীয় আঙ্গিক তিনি ভালভাবেই জানতেন এবং এগুলির সফল প্রয়োগেও তিনি সিদ্ধহস্ত ও অপরাজেয় ছিলেন।