StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

ইতিহাসে স্থান, কাল ও পাত্র ব্যাখ্যা করো।

 ইতিহাসে স্থান, কাল ও পাত্র ব্যাখ্যা করো। 


 ইতিহাসে স্থান (Space / Place) কাল (Time / Age) ও পাত্র (Man) অথবা, ইতিহাসের স্থান-কাল ও পাত্র সংক্রান্ত তথ্য বিষয়ে একটি টিকা লেখ।


ভূমিকা:

 ইতিহাসের চর্চা মূলত তিনটি স্তম্ভের উপর দাড়িয়ে স্থান অর্থাৎ অতীতে যে স্থানে নটি ঘটছে এবং যে যে স্থানে তার প্রভাব বাপ্ত হচ্ছে, কাল অর্থাৎ যে সাল বা সময়ে ঘটনাটি ঘটছে এবং যে সময়কাল পর্যন্ত তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে এবং পাত্র অর্থাৎ যে মানুষগণ কোন একটি ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত বা সম্পৃক্ত থাকছেন। এই তিনটি স্তম্ভ বা অঙ্গের বা আঙ্গিক বা প্রেক্ষিতের উপরেই ইতিহাসের পাঠ চর্চা পঁাড়িয়ে থাকে কোন একটিকে বাদ দিয়ে ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এই তিনটি অঙ্গ বা অঙ্গিক বা প্রেক্ষিতের চরিত্র নিয়ে প্রচুর আলোচনা বিশ্লেষণ ও বিতর্ক রয়েছে। প্রথমেই যে প্রশ্নটি অনিবার্যভাবে ওঠে তা হল ইতিহাসে স্থান কাল ও পাত্র কি নিয়ত বা অপরিবর্তনীয় (Constant) নাকি চলনশীল বা পরিবর্তনশীল। (Variable)। ক্রমান্বয়ে ইতিহাস নির্মাণে স্থান, কাল ও পাত্র ও তার ভূমিকা বিশ্লেষণ করে এই চরিত্র বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

ইতিহাসে স্থান :

কোন ঐতিহাসিক ঘটনা শূন্যস্থানে ঘটতে পারে না। বস্তুত ইতিহাসে ভূগোলের ভূমিকা অনিবার্য এ কথা অ্যানালস্, গোষ্ঠীর ঐতিহাসিগণ স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে দিয়েছেন।সিয়েন ডেবর, মার্ক ব্লগ, রোসেন সহ প্রায় সকল আনানস্ ঐতিহাসিকই ইতিহাস রচনার প্রতিটি ছনো স্থানের ভূমিকাকে প্রতিপন্য করেছেন।ইলেজের ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে মেননে বাজে আর গ্রীণ ঐ দেশের ভূগোলকে আগে বর্ণনা করে ইতিহাসে তার প্রভাবকে তুলে ধরেছেন। সহজেই অনুমেয় যে ইতিহাস নির্মাণে স্থানের একটি বড় মাহাত্মা বা বন্ধনা রয়েছে। ইতিহাস থেকেই কয়েকটি দৃষ্টান্ত প্রদান করে ইতিহাস নির্মাণে স্থানের ভূমিকা বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

  ভারতে কুষাণ রাজত্বকানের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল চৌহান সুরি ও তিয়েন হান সুরে বিধরণ অনুসারে তা-ইট চা কুষাগগণ সেন ভূ বা নিম্ন সিন্ধু অঞ্চল জয় করে আর্থিক দিক নিয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। পরবর্তীকানের মুদ্রাতাত্ত্বিক গবেষণা দেখাচ্ছে যে নিম্ন সিন্ধু অঞ্চলে প্রচলিত কুষাণ রৌপ্য মুদ্রা সাম্রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলে প্রচলিত রৌপ্য মুদ্রার তুলনায় অনেক বেশী খাদহীন ছিল। তার অর্থ দাঁড়ায় কুষাণদের কাছে ঐ অঞ্চলটির আদানা গুরুত্ব ছিল। 

 প্রয়াত ঐতিহাসিক প্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এর গবেষণা স্পষ্ট করে প্রমাণ করে যে চীনের সঙ্গে পশ্চিম রোম সাম্রাজ্যের যোগাযোগ স্থাপনকারী বাণিজ্যিক রেশম পথে পারসিক সম্রাটরা চড়া হারে শুল্ক আরোপ করায় কুষাণ সম্রাট কুণ্ডুল কনফিলে সমুদ্রপথে রেশম বাণিজ্য বজায় রাখার জন্য দ্রুত নিম্ন কিছু অঞ্চল জয় করেছিলেন যাতে করে পারস্য সাম্রাজ্যের নাগাল এড়িয়ে আরব সাগর ও লোহিত সাগর হয়ে চীনের ঢাশম নিম্ন সিন্ধু অঞ্চলের বারবারিকাম ইত্যাদি বন্দর দিয়ে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী আলেকজান্দ্রিয়ার মতো রোমান বন্দরগুলিতে পৌঁছে দেওয়া যায়। অর্থাৎ এক্ষেত্রে বিশেষ একটি সময়কানে বিশেষ একটি স্থানের স্বতন্ত্র ভৌগোলিক অবস্থানগত ইতিহাসে ত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে স্থানের মাহাত্ম্য পরিবর্তনশীল কারণ হবহু এরপ কোন ঘটনা ঐ অঞ্চলে পরবর্তীকালে ঘটেনি।

  আবার ক্ষেত্রবিশেষে কোন স্থানের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যে বর্তমানের সঙ্গে অতীতের মিল দেখা যায় সেই মিল বা সাদৃশ্য হাতহাস নির্মাণে নতুন দিশা দেয়। পুঁতি বা মালাদানা নির্মাণের ক্ষেত্রে হওয়ার কারিগররা স্টিটোইট, আগেট, জ্যাসপার, কার্নেলিয়ান, লাপিজলাজুলি, ইত্যাদি পাথরের সাথে সাথে টেরাকোটা, ঝিনুক, হায়, সোনা, রুপো এবং তামাকে ব্যবহার করেছিল। পুঁতি নির্মাণের ক্ষেত্রে নব্যপ্রস্তর যুগের তুলনায় সুক্ষতা এসেছিল কারণ কারিগররা কোনাকার একধরণের ছেদক বা ফুটো করার চাট পাথরের ড্রিল ব্যবহার করেছিল যা মহেঞ্জোদারো, হরনা, চায়দারো এবং যেখানে পাওয়া গেছে, কার্নেলিয়ানের মত শক্ত পাথরের মুক্তি ফুটো করার ক্ষেত্রে শক্ত পাথরের ডিলের ব্যবহার হয়েছিল। 

 পুরাবিদরা হিসাব করে দেখেছেন যে আল্লাহদিনোতে প্রাপ্ত ৩৬টি লম্বা বেলনাকার কার্নেলিয়ান পাথরের পুঁতি তৈরী করতে শিল্পীর ৮০ দিনের শ্রম প্রয়োজন হয়েছিল। কার্নেলিয়ানের তৈরী নকশ খোদাই করা সাদা পুতি এবং আল্লাহনিনোতে প্রাপ্ত ৩৬টি লম্বা বেলনাকার কার্নেলিয়ান পাথরের পুতি নিঃসন্দেহে বিলাসদ্রব্য ছিল মেসোপোটেমিয়ার রাজকীয় সমাধিতে হওয়ার কার্নেলিয়ানের পুঁতির প্রাপ্তি এই ধরণের বিলাস দ্রব্যের চাহিদাকে সুচিত করে।

  ঐতিহাসিক ঘটনা কোন একটি নির্দিষ্ট সধানে ঘটে থাকে কিন্তু সেই ঘটনার কারণ ও ফলাফল সেই স্থানে সুনির্দিষ্ট নাও থাকতে পারে। ১৪৫৩ সালে উটোমান তুর্কিরা পূর্ব রোম সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টানটিনোপল অবরোধ ও দখল করেছিল কিন্তু এর ফলাফল কেবল আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ফলাফল কেবল তৎসন্নিহিত অঞ্চলে আবদ্ধ থাকেনি। প্রথমত, কনস্টানটিনোপল থেকে পালিয়ে গিয়ে ক্রাইসোলোরাসের মত মানবতবাদী পন্ডিতগণ ইতালিতে রেনেসাঁর পরিপ্রেক্ষিত রচনা করেছিলেন।

  ভূমধ্যসাগরে খ্রিশ্চান বণিকদের আধিপত্য খর্ব হওয়ার ফলে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বজায় রাখা ও মশলা আমদানির বিকল্প পথের অনুসন্ধান চলেছিল কলম্বাস, আমেরিগো ভেসপুচিদের কল্যানে ইওরেরূপ আবিষ্কার করেছিল আমেরিকা মহাদেশকে, বার্ধেলমিড দিয়াজ ও ভাস্কো দা গামা মিলে ভারতে আসার নতুন পথকে, ম্যাগলান আবিষ্কার করেছিলেন গলাকার পৃথিবীকে জলপথের আবর্তনের পথটিকে শুরু হয়েছিলে উপনিবেশ স্থাপন এবং যার ফলে সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসটাই বদলে যেতে শুরু করেছিল।

 একইভাবে ১৭৫৭ এর ২৩ জুন নদিয়ায় পলাসীর প্রান্তরে সিরাজের সঙ্গে রাইত নেতৃত্বাধীন কোম্পানীর যে যুদ্ধ হয়েছিল তার প্রেক্ষিত রচিত হয়েছিল মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতা জুড়ে এবং তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল প্রায় সমগ্র দেশ জুড়ে – কারণ পলাশির বিজয় কোম্পানীকে প্রথমে বাংলা দখল করতে এবং পর্যায়কে সমগ্র ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তারের সোপান তৈরী করে দিয়েছিল।

  বস্তুত আধুনিক ইতিহাসচর্চায় ঐতিহাসিকগণ ইতিহাস নির্মাণে স্থানের প্রভাবকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বিচার করছেন, বিশেষ করে অ্যানালস্ ঐতিহাসিকদের কাজের পর থেকে। লুসিয়েন ফেবর স্পষ্টই বলেছিলেন যে অতীতের কোন গোষ্ঠীর সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক বুঝতে গেলে ঐ অঞ্চলের ভুস্তর, জলবায়ু প্রাকৃতিক পরিবেশ, পাহার, নদী নালা সমুদ্র ইত্যাদি প্রাকৃতিক ভূগোলের বিষয়গুলিকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে।

ইতিহাস ও কাল চেতনা:

  মানবসভ্যতার অতীতের অনুসন্ধানে ইতিহাস দুটি চোখ ব্যবহার করে একটি স্থান এবং অপরটি বাল। যে কোন ঐতিহাসিক ঘটনা যেমন একটি স্থানে ঘটে, তেমনই একটি সময় বা কানো ঘটে ইতিহাসের উপাদানে সেই কালের বছর বা তারিখভিত্তিকউল্লেখ থাকে আবার সুদুর অতীতের অনেক ক্ষেত্রে তারিখ পাওয়া যায় না। যেমন প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন থেকে প্রাপ্ত বস্তুগত নিদর্শনগুলির ক্ষেত্রে একমার লেখমালা এবং মুদ্রার ক্ষেত্রে তারিখের উল্লেখ থাকলেও অন্য আয়ুখে বা উপকারণে বিশেষ থাকে না সেক্ষেত্রে রেডিও কার্বন, ভেনয়োফোনোলজি বা খর্মোলুমিনিগেন্স বা পটাসিয়াম আগুনের মতো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে বন্ধু বা বস্তুগত সংস্কৃতির সম্ভাব্য নিববর্তী সময়করাটিকে নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। এক কথায় সময়ের ধারণা বাদ দিয়ে ইতিহাস পাঠ ও বোঝা সম্ভব নয়।

  সমাকে নির্দিষ্ট করা হয় বহু খনার মধ্যে দিছে, খুব পুরাতন প্রাগৈতিহাসিক যুগের ইতিহাসের ক্ষেত্রে বর্তমান থেকে কত বৎসর পুরাতন তা দিয়ে সময়াটিকে মাপা হয়। যেমন মধ্যপ্রদেশের হাসনোরা নামক স্থানে আদিমতম যে হোমিনিড নিদর্শন রূপে মানুষের মাথার খুলি আবিষ্কৃত হয়েছে তার বয়স বর্তমান থেকে ৫ লক্ষ বছর আগের (Below Present)। পৃথিবীর নানা স্থানে বা গণনার নানান পদ্ধতি ও নাম থাকলেও সব থেকে জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত বর্ষগণনা হল খ্রিস্ট পূর্বাব্দ (BC-Before Christ/ BCE Before] Christian or Common Era) এবং খ্রিস্টাব্দ (AD – Anno Domini / CE= Christian or Common Era) বর্ষগণনার এই প্রচলিত রীতির মধ্যে নিয়েই বিশ্বজুড়ে ইতিহাসচর্চা চলে যাতে করে সব স্থানে এক পদ্ধতি অবলম্বন করে সময়ের সঠিক ধারণাটি লাভ করা যায়।

  কাল চেতনার সঙ্গে তৃতীয় যে বিষয়টি জড়িয়ে তা হল যুগের ধারণা। ঐতিহাসিক প্রবণতা বা চরিত্রের সমরূপতা ও ধারাবাহিকতাকে লজ্জা রেখে ঐতিহাসিকগণ একটি লম্বা সময়কে একটি যুগ রূপে আখ্যায়িত করেন যাতে করে ইতিহাসের চলনটিকে বা মানব সভ্যতার বিবর্তনের পর্যায়টিকে সহজে বোঝা যায় এবং সেইসাথে ইতিহাসের পঠন পাঠনেনা সুবিধা হয়। বস্তুত এই যুগবিভাগকে অনসুরণ করেই ভারতে ও বিশ্বের সকল স্থানে বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় বিশ্বিদ্যালয়ে ইতিহাসের পাঠক্রম রচিত হয়।   

  প্রাচীনকাল থেকেই ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রে যুগ বিভাগের ধারণা চলে এসেছে, যেমন প্রচন সে সুবর্ণযুগ, রৌপ্যযুৎ হে পরবর্তীকালে মার্কসীয় ইতিহাদর্শনেও দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের তত্ত্বে আদিম সাম্যবাদী সমাজ, দাস যুগ বা প্রাচীন সময়কাল, সামন্ততান্ত্রিক মধ্যযুগ ধনতান্ত্রিক আধুনিক যুগ ইতাদির খাবণ প্রকাশিত হয় এবং তা অনেকাংশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এখানে ভারতের ইতিহাসের নিরিখে কালের ধারণা ও বর্ষ গণনার পাশাপাশি যুগবিভাগের কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যেতে পারে।

  কালের ধারণার পাশাপাশি প্রাচীন ভারতে দিনকাল, মাস, বছর ইত্যাদি গণনার একাধিক প্রথা ও পদ্ধতি প্রচলিত ছিল অসংখ্য দোখমালায় উল্লেখিত সময় চিহ্নিত করার মধ্যে দিয়ে বর্ষ ইত্যাদি সময় গণনার প্রমাণ পাওয়া যায়। রোমিলা খাপার স্পষ্টভাবে বলেছেন যে কালের পরিবর্তনশীলতার সম্পর্কে সম্যক ধারণা ভারতে আদিকাল থেকেই প্রচলিত ছিল।

 ইতিহাস দার্শনিকগণ দুই প্রকার সময়ের ধারণা তুলে ধরেন একটি হল চক্রাকার সময় বা কালচক্র। এই ধারণা প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে জনপ্রিয় হয়েছিল এবং এই ধারণা অনুসারে যুগের চক্রাকার আবর্তন ঘটে প্রাক ঔপনিবেশিক পর্বে, বিশেষত আদি পর্বে ইতিহাস পুরাণ নামক রচনাবলীতে, বিশেষত মহাভারত, মনুসংহিতা এবং বিষ্ণুপুরাণের মত প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে ৪,৩২০,০০০ বছরের মহাযুগ নামক এক চক্রাকার কানের ধারণা বা কল্পনার চিত্র পাওয়া যায় ।

  মহাযুগ আবার চারটি যুগে বিভক্ত সত্য, নেতা, দ্বাপর ও কলি এখনকার যুগ কলি যার সূচনা হয়েছিল ৩১০২ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে এবং যার স্থায়িত্ব ৪৩২,০০০ বছর। যুগবিভাগের এই কল্পনা অনুযায়ী প্রত্যেকটি যুগ তার আগের যুগের তুলনায় হীনতর (সত্য যুগ যেমন শ্রেষ্ঠ, তেমনি কলি যুগ সবথেকে হীন) সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির চূড়ান্ত অবক্ষয় যখন ঘটবে তখন কলিযুগের অবসান ঘটবে এবং কালচক্রের নিয়ম মেনে পুনরায় সত্যযুগের আগমন ঘটবে।

  চক্রাকার সময়ের ধারণার বিপরীতে অবস্থান করছে রৈখিক সময়ের ধারণা বা notion of linear time কালানুক্রমকে রৈখিকভাবে অনুসরণ করেই ঐতিহাসিক ঘটনার প্রবাহকে মাপা হয়ে থাকে যা মূলত প্রণিতর ধারণার উপর দাড়িয়ে। হেগেল, কান্ট, মার্কস ফখটে হয়ে মানবসভ্যতার প্রগতির যে ধারণা ইতিহাসে উত্থাপিত তা সময়ের ক্রম অগ্রসরতার উপর দাড়িয়ে। এই হিসাবে ইতিহাস সদা পরিবর্তনশীল সময়ের সাথে সাথে রুমে আপন গতিতে ও ময়ে এগিয়ে চলেছে -ধনুক থেকে নিঃসৃত একটি তীরের মতো অতীত থেকে বর্তমান হয়ে ভবিষত্যের পথে। সময়ের রৈখিক ধারণা অনেক বেশি বিজ্ঞানসম্মত এবং আধুনিক ইতিহাসচর্চায় এই ধারণাই প্রচলিত। পাশ্চাত্য জগতে ইহুদি ও খ্রিশ্চান দর্শনে রৈখিক সময়ের ভাবনা প্রকশিত হয় এবং সপ্তদশ শতকে ফ্রান্সিস বেকন, প্যাস্কাল প্রমুখের হাত ধরে।

  ইতিহাসচর্চায় রৈখিক সময়ের ধারণা অনুসৃত হতে থাকে। এমনকি প্রাচীন বৌদ্ধ দর্শনেও যে ক্ষণিকতাবাদের তত্ত্ব তুলে ধরা হয়েছিল সেখানেও বলা হয়েছিল প্রতিটি মুহূর্তের চরিত্র পরবর্তী মুহূর্তে বদলে যায়, অর্থাৎ যে সময় চলে যায় তা আর ফিরে আসে না, সেই অর্থে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কখনোই ঘটেনা কারণ চরিত্রগত দিক দিয়ে দুটি ঘটনা আলাদা, এমনকি কাল ও পাত্রও আলাদা।

ইতিহাসে মানুষ (পাএ): 

স্থান ও কাল নিয়ে ইতিহাসকাররা পাঠ করে মানুষের কথা। এই মানুষ প্রকৃতির মধ্যে বসবাস করা মানুষ সেহেতু প্রকৃতির সঙ্গে তার সম্পর্কও ইতিহাসে স্থান পর, অন্যভাবে বললে প্রাকৃতিক ইতিহাস নিতে সেখানকার মূল বিষয় কিন্তু মানুষ।

  আধুনিক কালে মার্কসবাদী এবং নিম্নবর্ণের ইতিহাসচর্চায় এলিট গোষ্ঠী বা ব্যক্তির চেয়ে অনেক বেশী দেওয়া হয় জনগণের ভূমিকাকে বিশেষত নিম্নবর্গীয় সাধারণ মানুষের ভূমিককে। বস্তুত বালাইন নিজেই ইতিহাসে ব্যক্তি মানুষ ও সমীর ভূমিকার চিরায়ত সম্মাটিকে তুলে ধরেছেন তার নিজের মধ্যেও যে এরূপ দ্বন্দ্ব তৈরী হয়েছিল যে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

  প্রাচীন কালের ইতিহাসচর্চা থেকেই ইতিহাসে ব্যক্তি মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় গ্রীক ইতিহাসচর্চায় লাইকারগাস, পেরিক্লিস বা সোলন বা আলেকজান্ডারের মত ব্যক্তিত্ব, প্রাচীন রোমে জুলিয়াস সিজার, অগস্টাস সিজারের মত সম্রাটগণ, প্রাচীন ভারতে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, অশোক, কণিষ্ক, সমুদ্রগুপ্ত, হর্ষবর্ধন, রাজেন্দ্র চোন, ষষ্ঠ বিক্রমাণিতা’র মত শাসকবর্গ, মধ্যকালীন সময়ে ইংল্যান্ডের টিউডোর, স্টুয়ার্ট বংশীয় শাসক, বা ফ্রান্সে চতুর্দশ বা ঘোড়শ লুই, ভারতে আকবরের মত সম্রাটগণ, কলম্বাস, ভস্কো দা গামার মত অভিযানকারী বা কোপারনিকাস বা গ্যালিলিও বা নিউটনের মত বিজ্ঞানী, আধুনিক যুগে নেপোলিয়ন বা হিটলার বা মুসোলিনি, লেনিন বা স্ট্যালিন বা রুজভেল্ট তাদের নিজ নিজ সময়কালের ইতিহাসের উপাদানে বা ষাক্ষ্যে তাৎপর্যাপূর্ণভাবে অনেক বেশী স্থান দখল করে আছেন এমনকি ইতিহাসের পাঠ্যক্রমেও তাদের ভূমিকা বা অবদানকে কেন্দ্র করে প্রকৃত মাত্রায় আলোচনা হয় ও পরীক্ষায় প্রশ্ন আসে। ফলে ইতিহাসে ব্যক্তি মানুষের ভূমিকা একটি বাস্তব সত্য এবং তাকে কোনভাবেই অস্বীকার করা যায়না।

 বস্তুত, কোন একটি বিশেষ স্থানে, কোন একটি বিশেষ সময়ে বাক্তির ভূমিকা ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, সুপ্রাচীন ইতিহাসের ভাষ্যে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে সমকালীন ঐতিহাসিক স্বাক্ষ্যে ব্যক্তি মানুষকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। হরিসেন রচিত এলাহাবাদ প্রশস্তি বা বানভটের হর্ষচরিত, বা সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতে যথাক্রমে সমুদরগুপ্ত বা হর্ষবর্ধন বা রামপালের ঐতিহাসিক ভূমিকার উপর আলোকপাত করা হয়েছে ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই উপাদানগুলির উপর ভিত্তি করে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস লিখতে গেলে ব্যক্তি মানুষের ভূমিকাকে অস্বিকার করা যায় না। 

 ওয়েজউড ব্যক্তি মানুষের ভূমিকাকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন যে সমকালীন সমাজের আচরণগত চরিত্র থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আচরণগত চরিত্র স্বতন্ত্র হতে পারে বা এবং এই কারনে তা ঐতিহাসিকের গবেষণার বিষয়। দ্বিতীয়ত, এক্ষেত্রে ব্যক্তি মানুষের আচরণ ও ভূমিকাকে মৌলিকভাবেই পর্যালোচনা করতে হবে – সমাজের আচরণের সঙ্গে তাকে মিলিয়ে ফেললে চলবে না। ওয়েজউডেরর মতে বিশেষ ঐতিহাসিক চরিত্রকে তার প্রাপ্ত মর্যাদা প্রদান করা ইতিহাসের কাজ। সমাজের মধ্যে থেকেই তিনি তাঁর ভূমিকা পালন করছেন এবং এর জন্যই তাকে সমাজ থেকে অভিন্ন করে দেখলে চলবে না। বস্তুত ওয়েজউড বিশেষ ব্যক্তি মানুষকে তার যুগের সামগ্রিক প্রতিনিধি রূপে দেখতে চেয়েছেন।

  বর্তমানে আর্থ-সামাজিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে বা নৌকিক সংস্কৃতির ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে সমাজবদ্ধ মানুষকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়, ইটভাটার শ্রমিকদের ইতিহাস বা যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস বা গণিকাবৃত্তির ইতিহাস বা আঞ্চলিক বিদ্রোহের ইতিহাস যখন লেখা হয়, বিশেষত ক্ষুদ্র অঞ্চলগত পরিসরে, তখন কিন্তু সাধারণ মানুষই ইতিহাসের প্রধান আলোচ্য বিষয় রূপে চিহ্নিত হন। উদাহরণ দিয়ে বলা যায় যে ডি এন ধানাগারে যখন ‘Peasant Movements in India 1920-1950 গ্রন্থটি লেখেন তখন আলোচনার বিষয়কভু সমষ্টিগত কৃষক। অথবা উধী বুটানিয়া যখন দেশভাগের উপর ‘The Other Side of Silence: Voices from the Partition of India’ লেখেন তখনও ইতিহাসের বিষয় হল সাধারণ মানুষ সেখানে বিশেষ ব্যক্তি মানুষের ভূমিকা ও তার ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ না

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *