নারীদের অধিকার রক্ষায় ‘Non-Government Organizations’ এর ভূমিকা
সমগ্র বিশ্ব জুড়ে নারীদের অধিকার রক্ষা করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে বেশ কিছু Non-Government Organizations সংক্ষেপে ‘NGO’। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হিসাবে পরিচিত এই বেসরকারী সংগঠনগুলি কার্যত সরকার দ্বারা পরিচালিত হয় না। অলাভজনক পদ্ধতিতে স্থানীয়, আঞ্চলিক, জাতীয় এমনকী আন্তর্জাতিক স্তরে এই সংগঠনগুলি আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সর্বোপরি মানবিক কোন উদ্দেশ্য নিয়ে স্বাধীনভাবে নিজেদের কর্মকান্ড পরিচালনা করে। নারীদের অধিকার রক্ষা, শিশুদের অধিকার রক্ষা, পরিবেশ রক্ষা, বন্যারাণ, মহামারি, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি নানা বিপর্যয় কবলিত মানুসকে সাহায্য করা, দুঃস্থদের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখা বা তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, ইত্যাদি নানা যুগোপযোগী মানবিক কাজের মধ্যে দিয়ে ‘NGO’ গুলি সামাজিক বা গোষ্ঠীজীবনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
অনেক ‘NGO’ কেবল স্বেচ্ছাসেবীদের দ্বারা পরিচালিত হয় আবার অনেকগুলিই তাদের কাজকর্ম চালানোর জন্য বেতনভূক কর্মচারী নিয়োগ করে থাকে। সদস্যদের চাঁদা, ব্যক্তিগত অনুদান, সেবা ও সম্পত্তি বিক্রয় এবং নানারকমের অনুদানের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে ‘NGO’গুলি কাজ করে থাকে। বিশ্বব্যাঙ্ককৃত বিভাজন অনুসারে ‘NGO’গুলিকে মূলত দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায় ক) Operational NGO ‘ বা কোন কর্মকান্ডের সঙ্গে বা কোন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত সংগঠন এবং খ) Advocay NGO’ অর্থাৎ যে সংগঠনগুলি সরকারী কোন কাজের বা নীতির বিরুদ্ধে বা কোনো বিশেষ বিষয়ের পক্ষে প্রচারমূলক কাজ করে থাকে।
অন্যান্য অনেক মহৎ উদ্দেশ্যের মতোই অসংখ্য ‘NGO’ আর্ন্তজাতিক ক্ষেত্রে নারীদের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে যে প্রতিষ্ঠানটির নাম করতে হয় তা হল ‘United Nations Entity for Gender Equality and the Empowerment of Women (UN Women)’। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ’র একটি গুরত্বপূর্ণ এজেন্সি রূপে এই সংগঠনটি সমগ্র বিশ্বজুড়ে নারীদের মৌলিক অধিকারগুলি রক্ষা করা এবং তাদের ক্ষমতায়নের জন্য সদর্থক ভূমিকা পালন করে থাকে।
ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। ভারতে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি মূলত দুটি প্রধান কাজ করে থাকে স্বনিযুক্তির ক্ষেত্র সৃষ্টি করা – এবং সেইসাথে সামাজিক সেবামূলক কাজকর্ম সম্পাদন করা। ভারতে সংকটের সময় বা দুর্যোগ মোকাবিলা করার জন্য এরূপ সেবামূলক প্রকল্প রচনা করা বা সংঘবদ্ধ হয়ে কাজ করার ইতিহাস আদি কাল থেকেই দেখা যায়।
বস্তুতপক্ষে NGO’ বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নানান আঙ্গিকে নারীদের অধিকার রক্ষা করার চেষ্টা করে থাকে বা অধিকারগুলি রক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরী করে। যেমন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলিতে অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে নারীদের বিবিধ কাজকর্মে স্বনিযুক্তি ঘটে থাকে, বিভিন্ন প্রকার উৎপাদনমূলক কাজের ট্রেনিং বা প্রশিক্ষণের সুযোগ তৈরী হয়, শিক্ষালাভের ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির অবকাশ তৈরী হয়, বৈবাহিক বা পারিবারিক জীবনের আইন, সম্পত্তির উত্তরাধিকারমূলক আইন, কর্মক্ষেত্রে। নিরাপত্তামূলক আইন ইত্যাদি বিষয়ে ধারণা তৈরী হয় এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে আত্মনির্ভরতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
ভারতে নারীদের অবস্থার উন্নতিকল্পে কর্মরত বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বা NGO’ এর ভূমিকা নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
Self Employed Women’s Association (SEWA) – ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটে আজকের এই জগৎখ্যাত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শ্রীমতি এলা ভাট। প্রাথমিকভাবে একটি ট্রেড ইউনিয়ান রূপে কাজ শুরু করলেও ক্রমে এটি নারীদের ক্ষমতায়নের একটি প্রতিক হয়ে ওঠে। এর মধ্যে দিয়েই এলা ভাট ভারতে নারীদের জন্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদর্থক ভূমিকাটিকে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। ‘SEWA’ এর মাধ্যমে অসংগঠিত কিন্তু বিবিধ শ্রমে নিযুক্ত নারীদের সংগঠিত করা ও সুরক্ষিত করার প্রয়াস নেওয়া হয়। এই NGO’টির অধীনস্ত এজেন্সি রূপে কাজ করে SEWA Bank’, ‘SEWA Movement’ এবং SEWA Bharat”। বর্তমানে এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে প্রায় ১৯০ কোটি নারী অন্তর্ভূক্ত হয়েছেন। নারীদের সংগঠিত করে তাদের অধিকার রক্ষার জন্য সদা সচেষ্ট এই সংগঠন আন্তর্জাতিক আঙিনায় খ্যাতি অর্জন করেছে।
‘ Azad Foundation’ এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটি ভারতের নারাঞ্চলে অত্যাচারিত, শোষিত বা অবমানিত নারীদের জন্য কাজ করে। এই সংস্থাটির প্রধান লক্ষ্য যে কোন রকমের লাঞ্ছনার শিকার হওয়া শহরে আরীদের আত্মমর্যাদা ও সম্মান পুনঃরুদ্ধার করা। এই সংগঠনের দ্বারস্থ হওয়া নারীদের ৬ মাসের একটি পুনর্বাসনমূলক কোর্সের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় যেখানে তাদেরকে আত্মসচেতন হওয়ার পাঠ, নিরাপত্তার কলোকৌশল শেখানো, ও নারীদের আর্থ-সামাজিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা হয়। সাম্প্রতিক কালে আজাদ ফাউন্ডেশন নারী পরিচালিত ক্যাব বা ট্যাক্সি পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা ‘সখা’র সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে কাজ করছে।
Centre For Social Research (CSR) জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় সমাজ বিজ্ঞানী দ্বারা ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে নতুন দিল্লীতে প্রতিষ্ঠিত এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটি নারীদের প্রতি হিংসাত্মক ঘটনাকে মোকাবিলা করা এবং লিঙ্গ ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য সক্রিয়। এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য এই সংস্থাটি আর্থ-সামাজিক বিষয়ে গবেষণা করে, দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা করে এবং সর্বোপরি পরামর্শদাতা রূপে কাজ করে। স্থানীয়, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে কাজ করে এই সংস্থা দেশের মধ্যে বিরাজমান লিঙ্গ বৈষম্যকে দূর করার জন্য সচেষ্ট।
Creating Resources for Empowerment in Action (CREA) ২০০০ খ্রিস্টাব্দে নতুন দিল্লীতে প্রতিষ্ঠিত এই ‘NGO’টি নারীবাদী অধিকার রক্ষামূলক সংগঠন। International Women’s Organization in global south’ এর অঙ্গ রূপে এই সংগঠনটি ভারতের নারীদের মর্যাদাহানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এবং লাঞ্ছনার শিকার এরূপ নারীদের আত্মমর্যাদা রক্ষা, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি এবং নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষমতা ইত্যাদি বিষয়ে পাঠ দেয় এবং তাদের আইনী সহযোগিতা করে থাকে।
Vimochana‘ ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে বাঙ্গালুরুতে এই NGO’ টি স্থাপিত হয়। নারীদের অধিকার রক্ষার জন্য এর সদসাগণ সদা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকে। বিমোচনার অন্তর্ভূক্ত সংস্থা রূপে Angala’ অঙ্গলা নারীদের কর্মে নিযুক্তির বিষয়টি দেখে। এছাড়াও যে সকল মায়েরা তাদের সন্তান প্রতিপলানে অক্ষম তাদের সন্তানদের অনাথ আশ্রমে রেখে দেখভাল করা এবং চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় সহায্য প্রদান করা এই সংস্থাটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ।
Swaniti’ ঋস্তিকা ব্যানার্জি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনটি জনপ্রতিনিধি রূপে নির্বাচিত নারীদের, বিশেষত গ্রামের নারীদের রাষ্ট্রনৈতিক কাঠামোতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার জন্য প্রশিক্ষণ দেয় এবং নারীদের জন্য নির্দিষ্ট সরকারী প্রকল্পগুলি যাতে গতিপ্রাপ্ত হয় সেই বিষয়টিকে নজর দেয়। বিশেষভাবে গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী নারীদের নিয়ে এই সংস্থাটি তাদের গবেষণা ও কাজ করে থাকে।
Guria India‘- যৌন লাঞ্ছনা বা উৎপীড়নের শিকার হওয়া নারীদের জন্য আইনী লড়াই এই সংগঠনটি লড়ে থাকে। FIR’ নথিভূক্ত করা থেকে শুরু করে স্বাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ করা, আক্রান্তদের কোর্টে মামলার জন্য প্রস্তুত করা সব দায়িত্বই বহন করে থাকে এই সংগঠনের উকিল বা ব্যারিস্টারগণ। আইনগত সাহায্য ছাড়াও এই সংস্থা লাঞ্ছিত নারীদের আর্থ-সামাজিক পুনর্বাসনের দিকেও নজর রাখে এবং তাদেরকে অর্থনৈতিক ভাবে সাহায্য করে থাকে।
Action Aid India‘ -এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটি আদতে Action Aid International’ এর অংশ। এই সংস্থা এবং তার ২৪ ঘন্টার সংকট মোকাবিলাকারী সংস্থা Gauravi সম্মিলিতভাবে যৌন উৎপীড়নের শিকার হওয়া নারীদের আইনী সাহায্য, পরামর্শদান, চিকিৎসা সংক্রান্ত সাহায্য, এমনকী প্রয়োজনে তাদের আশ্রয় প্রদানের ব্যবস্থা করে থাকে। তবে লাঞ্ছিত নারীদের আইনী পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করা হয়না, তাদের মতানুযায়ী পদক্ষেপ এই সংস্থাটি গ্রহণ করে থাকে।
ভারতের বাইরের NGO ও এই দেশের নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠাতে সক্রিয় ও সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। টাইমস অফ ইন্ডিয়ার একটি প্রতিবেদন অনুসারে যুক্তরাজ্যের Seva Trust এবং কানাডার Global Girls Power নামক দুটি ‘NGO এর প্রতিষ্ঠাতার মধ্যে অন্যতম হলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত চরন কানোয়াল শেখন ও লাকি গিল – উভয়েরই শিকড় রয়েছে পাঞ্জাবের লুধিয়ানায়। লুধিয়ানা থেকে ৩১ কিমি দূরে বারুন্দি গ্রামের চারটি গরীব কিন্তু পড়াশোনায় ভালো চারটি মেয়ের (মনপ্রীত কৌর, সপনা রানি, প্রাভজোত কৌর এবং এইডস আক্রান্ত পিতা মাতার সন্তান অপর একটি মেয়ের) পঠনপাঠনের যাবতীয় দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি মহৎ উদ্যোগ।