গুহা শিল্পকলার উপর একটি সংক্ষিপ্ত টিকা লেখ
ভূমিকা:
প্রাচীন মানুষের বসবাসের এমন বহু গুহা আবিষ্কৃত হয়েছে যেগুলিতে প্রচুর চিত্র অঙ্কিত আছে, এগুলিকে গুহাচিত্র বলা হয়। গুহার অভ্যন্তরস্থ দেওয়ালে আদি-মানব নিজের খেয়ালে মনের ভাব-ভাবনার রূপ দেয় চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে। বিষয়বস্তুতে জীবজন্তুর, বাইসন, গণ্ডার, হরিণ, হাতি-ঘোড়া ইত্যাদির প্রাধান্য ছিল। এযুগের শিল্পীরাও রঙ হিসেবে রঙিন মাটি, গেরি মাটি, চুন, পোড়া কাঠকয়লা ইত্যাদির সাথে প্রাণীর চর্বি মিশিয়ে ব্যবহার করত। ঘোড়ার কেশর বা কোনো চতুষ্পদ প্রাণীর লেজের লোম দিয়ে তুলি বানাতো। এছাড়া পশুর চ্যাপ্টা হাত বা চ্যাপ্টাকৃতি পাথরের চওড়া ফলকে রঙ গোলার কাজ করত।
প্রস্তর যুগে সারা ভারতে অন্তত ৭০০ স্থানে কোথাও একটি, কোথাও একাধিক গুহাশ্রয় আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলিতে আদিমানব বসবাস করত। ঐতিহাসিক যুগের প্রারম্ভ আজ থেকে তিন-চার হাজার বছর পূর্বে। এইযুগেও মানুষ দল বেঁধে গুহায় থাকত এমন নজির আছে। ভারতবর্ষের প্রাক্-ঐতিহাসিক ও প্রায় ঐতিহাসিক যুগের এইসব গুহাচিত্রগুলি হাজার হাজার বছর ধরে লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল। অজন্তা-পূর্ব যুগের চিত্রকলারূপে এগুলি স্বীকৃতি লাভ করলেও এগুলির সৃষ্টির নির্দিষ্ট সন-তারিখ বা স্রষ্টাদের পরিচয় চিহ্নিত করা যায়নি। এমনকি আবিষ্কারের সময় চিত্রগুলির যে বিবরণ সংগৃহীত হয়েছিল, তারও বেশিরভাগই সংরক্ষিত নেই। এইরূপ কয়েকটি গুহার কয়েকটি চিত্রের বিবরণ নিচে উল্লেখ করা হল।
কাইমুর পর্বতমালা:
ভারতের সর্বপ্রাচীন গুহাচিত্রের স্বীকৃতি প্রদান করা হয় মধ্যভারতের কাইমুর পর্বতমালার গুহাচিত্রগুলিকে। এখানে অপরিণত হাতে বেশ কিছু শিকারের চিত্র অঙ্কিত আছে, যার মধ্যে বেশ কিছু অসমাপ্ত অবস্থায় রয়েছে। এগুলি প্রস্তর যুগেরও পূর্বেকার।
মির্জাপুর:
ভারতীয় গুহাচিত্রের আদিম রূপ লক্ষ্য করা যায় বিন্ধ্যপর্বতের (মির্জাপুর) পর্বতগুহার প্রস্তরযুগের শেষদিকে অঙ্কিত চিত্রসমূহে। এগুলিতেই প্রথম শিল্পীদের দার্শনিক মনের পরিচয় পাওয়া যায়। এই গুহাগুলির কাছে লাল লোহা-পাথরের চাওড় (রাল) পাওয়া গেছে। মির্জাপুরের অন্তর্গত লিখুনিয়া, কোহবার, ভালদরিয়া, মহারারিয়া এবং বিজয়গড় নামক স্থানেও গুহাগুলি চিত্রমন্ডিত হয়েছিল।
সিঙ্গনপুর বা সিংহপুর:
উড়িষ্যার সম্বলপুরের উত্তরদিকে সিঙ্গনপুর বা সিংহপুরে অনেকগুলি গুহা আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রথম গুহাটি ২০ ফুট চওড়া ও ৩০ ফুট লম্বা।এতে গ্যালারির মত তাক সজ্জিত আছে। পরবর্তী গুহাটির প্রবেশপথ প্রায় ১৫ ফুট উঁচু। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে এ্যান্ডারসন নামক জনৈক রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ার গুহাদু’টি আবিষ্কার করেন।
ভীমবেটকা:
মধ্যপ্রদেশের রায়সেন জেলায় ভূপাল শহরের ৪৫ কিমি দক্ষিণে বিন্ধ্যপর্বতের দক্ষিণ ঢালে ভিমবেটকার অবস্থান। ভীমবেটকাকে ২০০৩-এ অন্যতম ‘ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থল’ (UNESCO Heritage Site) বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ইউনেস্কোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের নথিতে এই স্থানটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় একটি বৌদ্ধ মঠ-জাতীয় নিদর্শন হিসেবে। পরবর্তীকালে বিষ্ণু ওয়াকাঙ্কর ভূপাল যাবার পথে এই অঞ্চলে স্পেন ও ফ্রান্সে দেখা প্রস্তরখণ্ডের অনুরূপ গঠন দেখতে পান। তিনি ১৯৫৭ সালে প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটি দল নিয়ে এখানে উপস্থিত হন এবং অনেকগুলি গুহাবসতি আবিষ্কার করেন।
মূল্যায়ন:
বলা বাহুল্য, এইসব চিত্রাবলির উদ্দেশ্য কোনো শিল্পচর্চা নয়— ধর্মীয় বা জাদুবিশ্বাসই হল এর লক্ষ্য। সম্ভবত গুহার গভীরে লোকচক্ষুর অন্তরালে কোনো অদৃশ্য শক্তির উদ্দেশ্যে এই চিত্রগুলি অঙ্কিত হয়েছিল। মনে করা হয় আদিম মানব বিশ্বাস করত যে, চিত্রে যা ঘটেছে, বাস্তবেও তাই ঘটবে, অর্থাৎ জঙ্গলের জীবজন্তু শিকারির হাতিয়ারের আওতায় এসে পড়বে।