টীকা লেখো লোকশিল্প
“লোকশিল্প” বুৎপত্তিগত অর্থে ‘সংস্কার’ থেকে এর উৎপত্তি। এই সংস্কৃতির সঙ্গে ‘লোক’ পারিভাষিক শব্দটি যুক্ত হয়ে ‘লোক সংস্কৃতি’ শব্দটির উদ্ভব হয়েছে। ‘লোক’ বলতে গ্রামীন বা লোকায়ত সমাজের অধিকাংশ নিরক্ষর কৃষিনির্ভর সংহত জনগোষ্ঠীকে বোঝায়। আর ‘লোক সংস্কৃতি’ হল লোকায়ত মানুষের জীবন-জীবিকা সঞ্জাত মননের সামগ্রিক সার্থক ফসল। ‘লোক সংস্কৃতি’-র সুবিশাল পরিসরেই ‘লোকশিল্প’-র অবস্থান।–‘সাধারণত গ্রামীন কাজ, গ্রামীন কারিগরদের হাতের কাজ যাকে ইংরেজিতে Handicrafts বলা হয় তাই লোকশিল্প’।
লোকশিল্পকে আমরা কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত করে আলোচনা করতে পারি—১। বস্তুগত লোকশিল্প, ২। ধর্মীয় লোকশিল্প, ৩। গৃহস্থালীর দ্রব্য ও গৃহস্থকেন্দ্রিক লোকশিল্প, ৪। বিনোদনমূলক বা রসকেন্দ্রিক লোকশিল্প। বস্তুকেন্দ্রিক লোকশিল্পের অন্তর্ভুক্ত কৃষিসংক্রান্ত যন্ত্রপাতি—কোদাল, লাঙল, মই, জোয়াল প্রভৃতি।
রথ, গরুর গাড়ি, পালকি, নৌকা প্রভৃতি যানবাহনকেও আমরা বস্তুগত লোকশিল্পের অন্তর্গত বলে বিবেচনা করতে পারি। ধর্মীয় লোকশিল্পকে আবার দু’টি ভাগে বিভক্ত করা যায়—ক। ধর্মীয় চিত্তাপ্রসূত, খ। ধর্মীয় সমাজকেন্দ্রিক। পূজা-অর্চনার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী (ঘট, কলসী, সরা প্রভৃতি), আলপনা, প্রতিমা, দেবপুতুল, ধর্মীয় মুখোশ, ডাকের সাজ, দেবদেবীর পট, সিংহাসন, চালচিত্র, দারুমূর্তি প্রভৃতি ধর্মীয় চিন্তাপ্রসূত লোকশিল্পের নিদর্শন বলে বিবেচিত হয়। অন্যদিকে পুঁথির পাটাচিত্র, যাদুপট, যম্পট ইত্যাদি ধর্মীয় সমাজকেন্দ্রিক লোকশিল্পের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হয়।
গৃহস্থালীর দ্রব্য ও গৃহসজ্জাকেন্দ্রীক লোকশিল্পকে আবার কতগুলি ভাগে ভাগ করা যায়—ক। দারু ও তক্ষণ শিল্প (পালঙ্ক, সিংহদুয়ার, পিঁড়ে, কাঠের মালা প্রভৃতি), খ। বাঁশ ও বেতের শিল্প (ঝুড়ি, কুলো, ধামা প্রভৃতি), গ। বাসন-কোসন (মাটি-পাথর ও ধাতব পাত্র ও ডোকরা শিল্প ইত্যাদি), ঘ। বয়ন ও সূচিশিল্প (শাড়ি, গামছা, কাঁথা, ছাপার নক্সা ইত্যাদি), ঙ। অলঙ্কার (সোনা, রূপা, পাথর, মাটির গহনা ইত্যাদি), চ। অন্যান্য (মাদুর, শীতল পাটি, সন্দেশ ও আমসত্ত্বের ছাঁছ, গহনাবড়ি ইত্যাদি)। বিনোদনমূলক বা রসকেন্দ্রিক লোকশিল্পের অন্তর্ভুক্ত দেওয়ালচিত্র, সোলাশিল্প, বাদ্যযন্ত্র, পুতুল, ডোকরা শিল্প ইত্যাদি। লোকশিল্পের এইরূপ বিভাগটি মূলত বঙ্গশিল্পের উপর ভিত্তি করে করা হলেও এটিই সামগ্রিকভাবেও লোকশিল্পের বিভিন্ন ধারার পরিচয় বহন করে।
ড. পল্লব সেনগুপ্ত ‘লোকসংস্কৃতির সীমানা স্বরূপ’ গ্রন্থে লোকশিল্পকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন—আদিম মানুষের জীবনচর্চায় অজস্র দুর্বোধ্য রহস্য ভরা, পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে বেঁচে থাকার সংগ্রাম ছিল কেন্দ্রীয় ঘটনা। এই জীবনযুদ্ধ নিয়ন্ত্রিত হত অলৌকিতা ও যাদুবিশ্বাসের উপর আস্থাশীল এক মানসিক প্রবণতা দ্বারা। এই মানসিকতাই তাদের সৃষ্টির প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল।
পশুশিকারের ছবিগুলি হয়তো কোনো কল্পিত দেবতার উদ্দেশ্যে যাদুনির্ভর ধর্মাচরণের সঙ্গে জড়িত ছিল যাঁকে তুষ্ট করার মধ্যে লুকিয়ে ছিল জীবন সংগ্রামে জয়ী হবার আকুতি। এভাবেই তাদের ভাবনায় কিছু প্রতীক উঠে এসেছিল, যে প্রতীক চিহ্নগুলির যাদুকরির প্রভাবে তারা সেগুলি চিত্রিত বা খোদিত করতে শুরু করেন। অলৌকিক শক্তি কর্তৃক মঙ্গল সাধনের বাসনা অথবা অলৌকিক অশুভ শক্তির হাত থেকে রক্ষা পাবার আকাঙ্খা তাদের জীবনবোধকে স্বাভাবিকভাবেই আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। আদিম মানুষ শুধু এইটুকু উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল যে গর্ভবতী নারী সন্তান প্রসব করে জীবন সৃষ্টি করে। কিন্তু জ্বরা ও মৃত্যুকে প্রতিহত করা যায় না। তাই গর্ভবতী নারীমূর্তি তৈরি করে তারা চেয়েছিল তাদের গোষ্ঠীর অস্তিত্ব বজায় রাখতে গর্ভের নিয়ামক দেবতাকে তারা তুষ্ট রাখতে পেরেছিলেন।
ড.সেনগুপ্ত সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, বেঁচে থাকার প্রয়োজনে প্রয়োজনীয় উপাদান জোগাড়, মঙ্গল-অমঙ্গল সংক্রান্ত কিছু বিধি বিধান এবং গোষ্ঠীর অস্তিত্ব রক্ষা করা—এই তিনটি ঐকান্তিক প্রয়োজনকে ভিত্তি করেই শিল্পকলার সূত্রপাত হয়েছিল। এই শিল্পকলায় সমাজের উৎপাদন পদ্ধতির বিবর্তনের ধারাকে অনুসরণ করে প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়েছে। কৌম জীবন থেকে মানুষ যত শ্রেণিবদ্ধ, সমাজবদ্ধ হয়েছে সেই পথে লোকশিল্পের সৃষ্টি ও ব্যপ্তি ঘটেছে এর সঙ্গে তাল মিলিয়েই। লোকশিল্পের এই ক্রমপর্যায়কে চিহ্নিত করা যায় এভাবে—যাদুবিশ্বাসকেন্দ্রিক আদিম লোকশিল্প—ধর্মীয় লোকশিল্প—আঞ্চলিক লোকশিল্প-নাগরিক বা মার্জিত শিল্প।