লোকশিল্প কাকে বলে । লোকশিল্পের বৈশিষ্ট্য লেখো ।
লোকশিল্প কাকে বলে (lok shilpo kake bole)
‘লোকশিল্প’ লোক মানসের সমষ্টিগত আশা-আকাঙ্খা বা তার চিন্তাচেতনার একটি বিশেষ শৈলী (Form)। শিল্প এখানে প্রধান শিল্পী নয়। প্রকৃতপক্ষে লোকশিল্প লোকজীবন ও সমাজের আশা-আকাঙ্খার প্রতীক। ‘Art for Art’s sake’-র তত্ত্ব এক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। ড. প্রদোৎ ঘোষ ‘বাংলার লোকশিল্প’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, ‘আদিম শিল্প অর্থাৎ Primitive art থেকে কৃষিভিত্তিক সমাজের বিভিন্ন কাজে মানুষ তার প্রয়োজনীয় ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, গৃহস্থালীর দ্রব্য, ভৌগোলিক ও নৈসর্গিক পরিবেশের অনুকূল ধ্যান-ধারণায় তৈরি ব্যবহারিক রূপের অতিরেকে (surplus value) নান্দনিক চেতনার যেসব দ্রব্য আত্মপ্রকাশ করে তাই লোকশিল্প’। অধ্যাপক কল্যাণকুমার গঙ্গোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন (বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতি কোষ—লোকশিল্প)—‘সাধারণত গ্রামীন কাজ, গ্রামীন কারিগরদের হাতের কাজ যাকে ইংরেজিতে Handicrafts বলা হয় তাই লোকশিল্প’।
লোকশিল্পের বৈশিষ্ট্য
1) লোকশিল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এর সরলতা, প্রথাগত কর্ম, সৃষ্টিশৈলীর রক্ষণশীলতা যা বংশপরম্পরায় প্রবাহিত হয়।
2) লোকশিল্পের আঙ্গিকে আদিমকাল থেকেই প্রকৃতি, জীবজন্তু, মানবজীবন ও তার কর্মপ্রবাহ কখনও সরাসরি, কখনও ব্যঞ্চনার মাধ্যমে ফুটে ওঠে। যেমন—ঘটি বা কলসীর ক্ষেত্রে উপবেশনরত নারীদের ইঙ্গিত অনেক স্পষ্ট। আবার আলপনায় অথবা রেখাঙ্কিত নানাধরনের নক্সায় বিভিন্ন লতাপাতা প্রভৃতির সরলরৈখিক অনুকরণ আজও সমানভাবে প্রবাহিত। শুধুমাত্র বিষয়বৈচিত্র বা আঙ্গিকের সরলতা নয়, রঙের ব্যবহারেও লোকশিল্পীরা ছিলেন প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল।
3) প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করা নানাধরনের খনিজ পদার্থ, রঙিন পাথর, গাছগাছালির পাতা, ফুল, বিভিন্ন গাছের কন্দ প্রভৃতি ছিল লোকশিল্পীদের রঙের উৎস। বলা যায়, লোকশিল্পীরা তাদের শিল্পকর্মকে সরলতায় অকৃত্রিমতায় প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগের মাধ্যমে এক নিজস্ব শৈলী তৈরি করেন।
4) এই শিল্পকলা আদিম মানবের শিল্পমনের প্রতিফলন। প্রকৃতির সুন্দর রূপ লক্ষ্য করে সেযুগের স্বভাব শিল্পীরা মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং সেই মুগ্ধতাই সেদিনের মানুষকে গুহার দেওয়ালে চিত্র অঙ্কনে অথবা শিল্প সমৃদ্ধ হাতিয়ার নির্মাণে প্ররোচিত করেছিল।
5) আদিম মানুষ বিশেষ শিকারের সাফল্য তার স্মৃতিপটে ধরে রাখার উদ্দেশ্যে গুহার দেওয়ালে সেইসব ছবি এঁকে রাখত।
6) শুধু শিল্পের খাতিরেই শিল্প হিসেবে নয়, ব্যবহারিক প্রয়োজনের খাতিরেই মানুষ লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
7) লোকশিল্পের ব্যবহারিক দিকের মধ্যে আদিম ধর্মবিশ্বাস বা সাদৃশ্য যাদুর উপর (sympathetic magic) সমাজবিজ্ঞানীদের একটি বড় অংশ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। মানুষের দৃষ্টির অন্তরালে অন্ধকার গুহার দেওয়ালে আঁকা ছবিগুলির কথা বিবেচনা করলে শেষোক্ত মতটি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। আদিম লোকশিল্পের প্রধান অভিপ্রায় সৌন্দর্য সৃষ্টি করা ছিল না, যাদুমূলক ধর্মবিশ্বাস এবং জীবনের ব্যবহারিক প্রয়োজনই এর পিছনে প্রধান প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। লোকশিল্পে নান্দনিক ভাবনার বিষয়টি নবাগত।