১৮৫৭ খ্রীঃ মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি ও চরিত্র বিশ্লেষণ কর
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ হল আধুনিক ভারত ইতিহাসের এক জলবিভাজিকা। আধুনিক কেম্ব্রিজ ঐতিহাসিকরা মনে করেন সমকালীন ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা ব্রিটিশ রাজের স্বার্থে এই ঘটনার নিরপেক্ষ, পক্ষপাতশূন্য নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ করতে পারেননি। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে পার্লামেন্টে এক বক্তৃতায় রক্ষণশীল দলের নেতা বেঞ্জামিন ডিসরেলি একে জাতীয় অভ্যুত্থান বলে বর্ণনা করেন (a national rising)। এই ঘটনার আধুনিক ব্রিটিশ মূল্যায়ন পাওয়া যায় টমাস আর. মেটকাফের গ্রন্থে। তিনি মন্তব্য করেছেন যে শুধু সিপাহি বিদ্রোহ বলে ঘটনাটিকে নস্যাৎ করা ঠিক হবে না, আবার একে পুরোপুরি জাতীয় বিদ্রোহও বলা যায় না।
সমকালীন ভারতীয় বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আহমদ খান ও দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ঘটনাটিকে সিপাহি বিদ্রোহ বলে উল্লেখ করেছেন। এর জাতীয় রূপ বা গণআন্দোলন তাঁরা দেখতে পাননি। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হলে ভি. ডি. সাভারকর এই বিদ্রোহকে স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধ বলে প্রচার করেন। সাধারণভাবে এই বিদ্রোহ সম্পর্কে প্রচলিত মত হল এটি একটি সামন্তপ্রতিক্রিয়া, দেশের রাজা ও অভিজাতরা ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে ক্ষমতা হারিয়েছিল। ক্ষমতা ফিরে পাবার জন্য তার ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিল।
ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতীয়দের হাতে অস্ত্র ছিল না, সিপাহিরা ছিল ভারতীয় জনগণের প্রতিনিধি, অনেক সময় এদের বলা হয়েছে ‘উর্দিপরা কৃষক’ (Peasant in uniform)। ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী ছিল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। সিপাহিরা প্রথমে বিদ্রোহ করেছিল, পরে কৃষক, শ্রমিক, কারিগর, সাধারণ মানুষ সকলে তাতে শামিল হয়। ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পর এদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। দিল্লি থেকে প্রচারিত বিদ্রোহীদের ঘোষণায় কর বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দুষ্প্রাপ্যতা, জনগণের দুঃখ ও হতাশার কথা বলা হয়েছিল। সমকালীন ইংরেজ লেখকদের রচনায় এই বিদ্রোহের গণরূপ উল্লিখিত হয়।
বিদ্রোহের ধরনটা ছিল খুব ব্যাপক, যেসব অঞ্চলে গ্রামের লোক বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল সেগুলি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। হোমস অনুমান করেছেন অযোধ্যা অঞ্চলে মোট দেড় লক্ষ সশস্ত্র লোক বিদ্রোহে প্রাণ হারিয়েছিল, এর মধ্যে সিপাহির সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৫ হাজার।
মহাবিদ্রোহ শুধু অযোধ্যা প্রদেশে সীমাবদ্ধ ছিল না, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ ও মধ্যভারত জুড়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটেছিল। পাটনা, ছোটোনাগপুর, হায়দ্রাবাদ, মহারাষ্ট্র ও পূর্ব পাঞ্জাবে বিদ্রোহ হয়। এই ব্যাপক বিদ্রোহের খবর সমসাময়িক সংবাদপত্র ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
ভারতবর্ষের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে অসংখ্য ভারতবাসীর মনে ইংরেজের প্রতি অপরিসীম ঘৃণার ভাব ছিল। বিদ্রোহীরা পরাস্ত হলে জনগণের ওপর তার প্রভাব পড়ত। লখনউ বা পাটনায় সৈন্যবাহিনীর বিদ্রোহের আগে জনগণ বিদ্রোহ করেছিল। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে পাটনায় বড়ো ধরনের হাঙ্গামা হয়েছিল, ছোটোনাগপুরে অভ্যুত্থান হয়, হায়দ্রাবাদ ও মারাঠা অঞ্চলে বিদ্রোহের চেষ্টা হয়েছিল।
ইংরেজ ঐতিহাসিক রেকস মন্তব্য করেছেন যে বিদ্রোহের সময়ও অল্প সংখ্যক ইংরেজ একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত করেছিল। সুরেন্দ্রনাথ সেন মনে করেন এতে ইংরেজদের প্রতি ভারতীয়দের আনুগত্য প্রমাণিত হয় না, প্রমাণিত হয় ভারতীয়দের ভদ্রতা ও মানবতাবোধের। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে গণবিদ্রোহের রূপটি কোনোভাবেই অস্পষ্ট নয়। যে ধরনের প্রমাণের জোরে আমরা অন্য দেশের ইতিহাসে গণবিদ্রোহের কথা বলি এখানে তার অভাব ছিল বলা যায় না।
জওহরলাল নেহরু তাঁর ডিসকভারি অব ইন্ডিয়ায় লিখেছেন যে ভারতে ব্রিটিশ যে মনোভাব গড়ে উঠেছিল তার সুযোগ নিয়ে সামন্তপ্রভু ও তাদের অনুচররা বিরোধী এই বিদ্রোহ ঘটিয়েছিল (a feudal outburst, headed by the feudal chiefs and their followers, and aided by the widespread anti-foreign sentiment)। তাঁর মতে প্রকৃতিতে এই ঘটনাটি হল একটি সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া যদিও কয়েকটি জাতীয়তাবাদী উপাদানও এর মধ্যে পাওয়া যায়।
বিদ্রোহ জয়যুক্ত হলে পরিস্থিতির প্রয়োজনে নতুন শক্তির আবির্ভাব ঘটত। নেতারা পশ্চিমি যুদ্ধ কৌশল, রাষ্ট্রব্যবস্থা, শিক্ষা, প্রযুক্তি প্রবর্তন করতে বাধ্য হতেন। বিদেশি শাসন থেকে মুক্তি কামনা কিছুতেই সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে না। ইংরেজ শাসন যদি শোষণমূলক হয় তবে তার বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদ বা সামরিক অভ্যুত্থান প্রগতি বিরোধী প্রতিক্রিয়া নয়। বিদ্রোহের স্বতঃস্ফূর্ত ও অসংগঠিত রূপ থেকে এটি প্রমাণিত হয় না যে এই বিদ্রোহ হল সামন্তপ্রভুদের পরিচালিত অভ্যুত্থান।
সমকালীন সামন্ত ব্যবস্থার স্তম্ভ রাজন্যবর্গের অনেকে এই বিদ্রোহে যোগ দেননি। অযোধ্যার বাইরে জমিদারদের বেশিরভাগ ইংরেজদের পক্ষে ছিল। সামন্ত নেতারা সকলে বিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশ সরকারকে সাহায্য করেছিলেন। সাম্প্রতিককালে একটি প্রবন্ধে ইরফান হাবিব লিখেছেন যে বিদ্রোহ সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া বা বুর্জোয়া বিদ্রোহ নয়। সামন্ততন্ত্রের দিন শেষ হয়েছিল। বুর্জোয়া যুগ শুরু হয়নি ।
ইংরাজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বিদ্রোহের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিল না। পরবর্তীকালে এই সামাজিক শ্রেণি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আইনানুগ জাতীয় আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। ঠিক এই কারণে মধ্যযুগের সশস্ত্র আন্দোলনকে জাতীয় সংগ্রাম বা প্রগতিশীল গণ আন্দোলন আখ্যা দেওয়া হয়নি। ইউরোপের ইতিহাসে উদীয়মান বুর্জোয়ারা অনেক সময় নিজেদের দেশের গণবিদ্রোহ ও জাতীয় বিদ্রোহের এভাবে মূল্যায়ন করেছেন। মহাবিদ্রোহের করাল রূপ, হিংসাত্মক ঘটনা, বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য ইত্যাদির জন্য ইংরাজি শিক্ষিতমধ্যবিত্ত এর সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেনি। কোনো সন্দেহ নেই ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া নয়।
ব্রিটিশ ও ভারতীয় ঐতিহাসিকদের অনেকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহকে জাতীয় সংগ্রাম আখ্যা দিতে চান না। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার ও ড. সুরেন্দ্রনাথ সেন এই বিদ্রোহের ওপর গবেষণামূলক গ্রন্থ লিখেছেন। এঁদের মতে, সেদিনের ভারতবর্ষে জাতীয়তাবোধের জন্ম হয়নি, অযোধ্যা ও শাহাবাদ ছাড়া আর কোথাও দেশভক্তি ও জাতীয়তাবোধের স্ফুরণ লক্ষ করা যায় না। বিদ্রোহের মধ্যে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা, নির্দিষ্ট কর্মপদ্ধতি ও সংগঠন ছিল না। নেতারা ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্ক্ষার দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন, সর্বভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি এদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। সেদিনের রণাঙ্গণ ছিল সীমাবদ্ধ, দেশবাসীর বিরাট অংশ ছিল নিষ্ক্রিয়।
কিন্তু মনে রাখা দরকার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই হয়েছিল। হিন্দু ও মুসলমান সকলে বিদেশি শাসন থেকে মুক্তি চেয়েছিল (They were trying to free Hindustan of foreign yoke)। মোগলসম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে হিন্দুস্থানের বাদশাহ বলে ঘোষণা করা হয়, হিন্দুস্তানি ফৌজও গঠন করা হয়েছিল। বিদ্রোহের পেছনে অসংখ্য সাধারণ মানুষের সমর্থন ছিল।
ফরাসি বিপ্লবের পর ইউরোপে জাতিরাষ্ট্র, গণতন্ত্র, উদারনীতিবাদ ইত্যাদি ধারণাগুলি গড়ে উঠতে থাকে, কিন্তু এগুলি তখনও ভারতে প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। জাতীয়তাবাদকে সব সময় মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করাও ঠিক নয়। সেক্ষেত্রে পৃথিবীর অনেক মুক্তিসংগ্রামকে ব্যর্থ বলে ধরে নিতে হয়। জার্মানিতে যে ঐক্য ও মুক্তি আন্দোলন হয় সেখানে এক রাষ্ট্র, গণতান্ত্রিক জাতি রাষ্ট্র, ইত্যাদি ধারণা অনুপস্থিত ছিল। ইতালির কার্বোনারি অখণ্ড ইতালির নামে লড়াই করেনি। ইতালির স্বাধীনতার শ্রেষ্ঠ নায়ক কাভুর গোড়ার দিকে ইতালির রাষ্ট্রগুলির স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন। মধ্যযুগের ফ্রান্সে জোন অব আর্ক দখলদার ইংরেজবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। দেশের মুক্তি কামনায়। মধ্যযুগীয় সংস্কারে আচ্ছন্ন সে আন্দোলনকে কখনও জাতীয় আখ্যা থেকে বঞ্চিত করা হয়নি।
মহাবিদ্রোহের সময় এদেশের জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদ বা গণতান্ত্রিক আদর্শ খুঁজতে যাওয়া বৃথা পরিশ্রম ছাড়া আর কিছু নয়। উল্লেখ্য মধ্য উনিশ শতকে সারা দেশ বিদেশি শাসনে উৎপীড়িত ছিল, রাষ্ট্র ও সমাজের কাঠামো বাইরের চাপে ভেঙে পড়েছিল। সে সময় ভারতে জাতীয়তাবাদ না থাকুক একটি আত্মবোধের অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। হিন্দু ও মুসলমান উভয়ে মনে করেছিল দেশটি তাদের, বিদেশিদের নয়। এরকম একটি ধারণা যদি থেকে থাকে তাহলে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে জাতীয় সংগ্রাম বলা সম্ভব।
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের আগে দেশীয় রাজাদের অনেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। সেইসব লড়াইয়ের সঙ্গে তুলনায় ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ স্বতন্ত্র। সেসব যুদ্ধে এমন বিস্তৃত সংগ্রাম, এতখানি গণসংযোগ বা ব্রিটিশ বিরোধী সর্বাত্মক মনোভাব ছিল না। একথা ঠিক বিদ্রোহের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি ছিল না, নেতাদের মধ্যে প্রতিভা ও ব্যক্তিত্বের অভাব ছিল। ইউরোপের ইতিহাসে পোল বিদ্রোহের চরিত্র অনেকটা এরকমের, সেখানে ভূস্বামীদের সঙ্গে নিয়ে কৃষকরা রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। নেতৃত্বের দুর্বলতা সত্ত্বেও জনগণ যদি বিপুলভাবে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে থাকে তাহলে এর জাতীয়তাবাদী চরিত্র সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়।
মূল্যায়ন:
জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস চলিয়েছিল। হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে নজিরহীন ঐক্য দেখা গিয়েছিল। আজমগড়ের ঘোষণায় সর্বশ্রেণির ভারতীয়কে বিশ্বাসঘাতক ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করার আহ্বান জানানো হয়েছিল। দিল্লির ঘোষণায় হিন্দু-মুসলমানকে ঐক্যবদ্ধ হবার ডাক দেওয়া হয়। বেরিলি ও দিল্লির নেতারা চেষ্টা করেন যাতে হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাসে কোনো রকম আঘাত না লাগে। নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ স্বার্থান্বেষী ছিলেন একথা ঠিক।
ঝাঁসির রানি, তাঁতিয়া টোপি, ফৈজাবাদের মৌলবি বা বখত খান সকলে দেশপ্রেমিক ছিলেন। সব সাক্ষ্য প্রমাণ বিচার করে বলা যায় ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ ছিল একটি জাতীয় সংগ্রাম। বিদ্রোহে পরাজয় ঘটলে সারা দেশে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল।