বাংলা গদ্যের বিকাশে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অবদান উল্লেখ করো।
ভূমিকা:
ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী তাঁদের দেশশাসন এবং কর্ম পরিচালনার ক্ষেত্রে এদেশে কয়েকটি বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন। তারা শাসিত দেশের ভাষা যদি ভালো ভাবে রপ্ত করতে না পারেন তবে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তাদের দূরত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পাবে। কারণ ভাব বিনিময়ের একমাত্র হাতিয়ার হল ভাষা। সেই ভাষা যদি একেবারে আয়ত্তের বাইরে থাকে তাহলে শাসন পরিচালনা করা বড়ই দুরূহ হয়ে পড়ে। এই সমস্ত অসুবিধাগুলি অনুভব করতে পেরেই তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলী ১৮০০ সালে কলিকাতার লালবাজারের নিকট ফোর্ট-উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করলেন। উদ্দেশ্য আগত তরুণ সিভিলিয়ানদের পড়ানোর মধ্য দিয়ে এদেশের ভাষা, সাহিত্য, ভূগোল, ইতিহাস, সম্পর্কে বিশেষ অভিজ্ঞ করে তোলা। ফলে কলেজ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে দেশের আধুনিক ভাষা প্রশিক্ষণের জন্য একাধিক পণ্ডিতকে বিভিন্ন বিষয়ের জন্য নিয়োগ করা হয়।
ঠিক এমনই এক শুভ লগ্নে বাংলা, সংস্কৃত, মারাঠা বিভাগের ভার অর্পন করা হল পণ্ডিত উইলিয়াম কেরীর উপর। যিনি ইতিমধ্যে বাইবেলের অনুবাদে হস্তক্ষেপ করে শাসক মহলে বিশেষ পরিচিত অর্জন করেছিলেন। উইলিয়াম কেরীর ব্যবস্থাপনায় এই তিন ভাষার উপরে উপযুক্ত পণ্ডিতদের সন্ধান নিয়ে দেশীয় অধ্যাপক পদে নিযুক্ত করতে শুরু করলেন। তবে তিনি এতে লক্ষ্য রাখলেন পণ্ডিতরা বাংলা ভাষায়, যে সমস্ত পুস্তিকা রচনা করবে তা যেন সহজ এবং সরল গদ্যের মধ্যেই সম্পন্ন হয়, নইলে বিদেশীদের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে উঠবে। প্রথমেই কেরী সাহেব স্বয়ং কয়েকটি পুস্তক রচনা করে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। যার দ্বারা অনুগামী পণ্ডিতরা সহজ এবং সরল বাংলায় রচনা করতে শুরু করে। এই সূত্রে প্রেরণার উৎস হিসাবে কেরী সাহেব ভালো পুস্তক রচনার জন্যে পণ্ডিতদের মধ্যে পুরস্কারেরও ব্যবস্থা রাখেন।
উইলিয়াম কেরী :
কেরী সাহেবের ব্যবস্থাপনার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগে নব নিযুক্ত পণ্ডিতদের রচিত বাংলা গদ্য পুস্তক সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে স্বয়ং কেরী সাহেবের রচিত গদ্যগ্রন্থ সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক—ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের দায়িত্ব ভার নেওয়ার পর রেভারেণ্ড উইলিয়াম কেরী মাত্র দুখানি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন ph। এ তথ্য তাঁর জীবনীতে প্রচারিত। ১। কথোপকথন (১৮০১) ২। ইতিহাস মালা (১৮১২)
এই ‘কথোপকথন’ গ্রন্থটি তিনি মোট ৩১টি পরিচ্ছেদে সমাপ্ত করেন। যেমন—সাহেবের ম/সাহেব ও মুন্সী/পরামর্শ/ ভোজনের কথা… ইত্যাদি। কেরী সাহেব বাঙালী মেয়েদের কথাবার্তা কেমন রপ্ত করেছিলেন তা বড়ো বিস্ময়কর।
দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘ইতিহাস মালা’ নাম দিলেনও কেরী সাহেব এতে অনৈতিহাসিক বহু কাহিনি লিপিবদ্ধ করেছেন। ভারতীয় ইতিহাসের বহু কাহিনির দ্বারা এটি রচিত। ‘চণ্ডীমঙ্গল’ ‘মনসামঙ্গলে’র পুরাণ কাহিনি এতে সংযোজিত হয়েছে।
কেরীর ‘ইতিহাসমালা’ গ্রন্থখানি কিরূপ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল ডঃ সুকুমার সেনের মধ্যে তা ধরা পড়েছে—“ব্যঙ্গমালা ও ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম গল্প সংগ্ৰহ বলিয়া ইতিহাসমালার মর্যাদা এখনো ক্ষুণ্ণ হইবে না
রামরাম বসু :
কেরী সাহেব বাংলা বিভাগের উন্নতি সাধনের জন্য যে সমস্ত দেশীয় পণ্ডিতদের নিযুক্ত করেছিলেন রামরাম বসু তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি দুখানি গদ্য গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ১. রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র (১৮০১) : এ গ্রন্থে তিনি তাঁর পূর্বপুরুষ ধূমঘাটের রাজা প্রতাপাদিত্য সম্পর্কে বিজয়ীমূলক গ্রন্থ রচনা করেন এবং সঙ্গে বহুফারসী এবং ঐতিহাসিক কাহিনি সন্নিবেশ করেন। এ পুস্তকের গদ্যরীতির মধ্যে বহু ফারসী/
আর্য ভাষার অনুকরণ ঘটলেও তা অত্যন্ত সহজ সরল ছিল। এটিই মূলত বাঙালীর রচিত প্রথম গদ্যগ্রহ রূপে বিবেচিত। ২. লিপিমালা (১৮০২) গ্রন্থটি মূলত পত্রাকারে লেখা। তবে এর মধ্যে স্থান পেয়েছে, কাল্পনিক ব্যাপার, গালগল্প, পুরাণ, উপকথা ইত্যাদি মোট চল্লিশটি পত্র। শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গ কর্মচারীদের বাংলা ভাষায় পত্রলিখন পদ্ধতি শেখানোর জন্যই তিনি লিপিমালা, গ্রন্থ রচনা করেননি, সাহেব কর্মচারীদের সহজ লেখাপড়ার বাংলা ভাষা শেখাতে চেয়েছিলেন।
রামকিশোর তর্কচূড়ামণিঃ
হিতোপদেশ (১৮১৫) গ্রন্থটি বিদ্যাপতির পুরুষপরীক্ষা নামের গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করা।
মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার :
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ব্রাহ্মণ পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয়ের সংস্কৃতে অসাধারণ পাণ্ডিত্যের জন্য একদা জন মার্শম্যান তাকে ডক্টর জনসনের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য মোট চারখানি গদ্যগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ১। বত্রিশ সিংহাসন (১৮০২) গ্রন্থটি সংস্কৃত বৈতাল পচ্চিশী’র অনুবাদ। বিদ্যাসাগরের বেতাল পঞ্চবিংশতির অনুরূপ। ২। হিতোপদেশ (১৮০৮) গ্রন্থটিও সংস্কৃতে বিষ্ণুশর্মার হিতোপদেশের আদলে রচিত। কয়েকটি নীতিমূলক গল্পই এর উপজীব্য বিষয়। ৩। রাজাবলী (১৮০৮) গ্রন্থটি বাঙালীর রচিত প্রথম ইতিহাস। পুরাণ, কল্পনা, লোক প্রবাদ-মিশ্রিত হিন্দুযুগ, মুসলমান শাসকদের বিচ্ছিন্ন ইতিহাস এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। ৪। প্রবোধচন্দ্রিকা (১৮১৩–১৮৩৩) ঃ এ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে নানাবিধ তত্ত্বকথা, ভাষারীতি, ন্যায়, দর্শন ইত্যাদি, সকল লৌকিক ভাষায় মধ্যে উত্তম গৌড়ীয় ভাষাতে এই গ্রন্থটি রচিত। মূলতঃ এ গ্রন্থে নীতি উপদেশের দ্বারা বামট্রিটি গল্প-আখ্যান স্থান পেয়েছে।
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগে পণ্ডিতদের মধ্যে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করলেও অন্যান্য লেখকরা গদ্য রচনার ক্ষেত্রে কোন অংশে কম ছিলেন না। যেমন—গোলক নাথ শর্মার—হিতোপদেশ (১৮০২) গ্রন্থটিও রচিত হয়েছিল। সংস্কৃত গ্রন্থের অনুকরণের। এর গ্য রীতি হলো—“আমার পুত্ররা অতি মুর্খ, অতএব ইহাদের কি হবে। এমন পুত্র থাকা না থাকা তুল্য
কাশীনাথ তর্কপঞ্চানন :
পদার্থতত্ত্ব কৌমুদী (১৮২১) ও আত্মতত্ত্ব কৌমুদী (১৮২২) নামক দুটি গ্রন্থ রচনা করেন ।
তারিণীচরণ মিত্র—
ওরিয়েন্টাল ফেবুলিস্ট (১৮০৩) গ্রন্থটি রচিত হয় ঈশপস ফেবলসের অনুকরণে। দৃষ্টান্ত—“হে মহাশয় আমার বোঝা সারিয়া পড়িতে দিল, তাহা আমি আপনি থামিতে না পারিয়া আমার কাঁধে তুলিয়া নিবার জন্য কেবল কাতর সহায়তায় প্রার্থনা করিতে ছিলাম। রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়—মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং (১৮০৫) এটি রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সংক্ষিপ্ত জীবনীরূপে কলেজে পাঠ্যপুস্তকরূপে বিবেচিত হল। চণ্ডীচরণ মুন্সী : তোতা ইতিহাস (১৮০৫)—এটি তুতিনামা নামক ফরাসী গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ। এটিতে পাদীর মুখ দিয়ে মানুষের গল্প বর্ণিত হয়েছে।
মূল্যায়ন:
এ সমস্ত পণ্ডিত মুন্সী লেখকদের গ্রন্থগুলি যেমন একদিকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের উন্নতিকার্যে সাহায্য করেছিল তেমনি এই গ্রন্থগুলির সাহায্যে বিদেশী ছাত্ররা অল্প দিনের মধ্যেই বাংলা ভাষাকে ভালোভাবে রপ্ত করেছিলেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কলেজের জন্য নির্বাচিত পুস্তক-পুস্তিকা গুলিতেই সর্বপ্রথম সহজ সাধু গদ্যের প্রাথমিক রূপটি ফুটে উঠেছে।
বাংলা গদ্যের উদ্ভব-ইতিহাস যেমন গতিশীল তেমনি চমকপ্রদ। এই গদ্য প্রয়োজন উদ্ভুত। এই প্রয়োজনের রূপটি বিভিন্ন রাজকার্য, বাণিজ্যিক, ধর্মীয়, শাসনতান্ত্রিক ইত্যাদি। রচনা ও লেখার প্রাথমিক প্রয়াসও দেশী ও বিদেশী, বহু ভাষাভাষী মন-নির্ভর। স্বভাবতই বাংলা গদ্য কোন একজন ব্যক্তি বা বিশেষ কোন গোষ্ঠীর উদ্যোগে গড়ে ওঠেনি। এমনকি সুবিশাল সংস্কৃত সাহিত্যের গদ্যরচনার উজ্জ্বল ঐতিহ্য থেকেও সে ছিল দূরে, পাণ্ডিত্যের অনুভব স্পর্শ থেকে বঞ্চিত। সে অর্থে বাংলা গদ্য সম্পূর্ণভাবে স্বয়ংজাত। তার ব্যবহারের ক্ষেত্রগুলিকে সূত্রাকারে লিপিবদ্ধ করতে যে নামটি সর্বাগ্রে তারকার মতো জ্বলজ্বল করতে থাকে তা হল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। এই কলেজ বাংলা গদ্য, বাঙালীর মনোলোক এবং সমাজচেতনার উপরে সুগভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। তার প্রতিষ্ঠার মূলে ছিলেন লর্ড ওয়ালেসলি।
Good