StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

ইতিহাসের সাথে নৃতত্ত্বের সম্পর্ক

 

ইতিহাসের সাথে নৃতত্ত্বের সম্পর্ক 



  ইংরাজিতে “Anthropolgy’ কথাটির বাংলা তর্জমা হল নৃতত্ত্ব বা নৃবিদ্যা অর্থাৎ যা মানুষকে নিয়ে আলোচনা করে। নৃতাত্ত্বিকগণের গবেষণার মূল বিষয় হল কীভাবে আমরা মানুষ হয়ে উঠলাম। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানচর্চার এই শাখায় মানুষের, বিশেষত আদিম মানুষের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি, আচরণ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয় যাকে বলা হয় ‘holism’ এবং যেখানে সার্বিক প্রেক্ষিতের আলোকে বা সম্পূর্ণ পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতাকে নিয়েই মানুষকে দেখা হয়ে থাকে। নৃতাত্ত্বিকগণ প্রত্নতত্তবের মধ্যে দিয়ে আদিম মানব গোষ্ঠীগুলির আচরণ অনুধাবন করার ও তাকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করে থাকেন।




  প্রাগৈতিহাসিক কালের আদিম মানবসমাজের নানান সাংস্কৃতিক চিহ্ন উদ্ধার করতে গিয়ে পুরাবিদগণ বিভিন্ন প্রকার আনুষাঙ্গিক জ্ঞানচর্চার বিষয় বা উপশাখার সাহায্য নেন। এক একটি জ্ঞানচর্চার শাখা বা বিষয়ের গবেষকগণ তাদের স্বতন্ত্র পদ্ধতি অবলম্বন করে আদিম সমাজের বস্তুগত নিদর্শনগুলিকে বিচার বিশ্লেষণ করে প্রত্নতাত্ত্বিক চর্চাকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলেন। উদাহরণস্বরূপ নৃতাত্ত্বিক প্রত্নতত্ত্ব’র বা “Ethno Archaeology” এর কথা বলা যায় যেখানে বর্তমান কোন সামাজিক রীতির বৈশিষ্ট্য বা চরিত্রগুলিকে অবলোকন করে আদিম কোন সভ্যতার অনুরূপ সামাজিক বা সাংস্কৃতিক রীতিগুলিকে অনুধাবন করার চেষ্টা করা হয়। 



  সমগ্র বিশ্বজুড়ে আদিম কিছু সমাজে বৃহদাশ্মীয় স্তম্ভ বা “Megalith ” নির্মাণ এর প্রচলন ছিল যা সভ্যতার বিবর্তনের সাথে সাথে লুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু নৃতাত্ত্বিকগণ গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে বর্তমান ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলে বসবাসকারী কিছু আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে এরূপ বৃহদাশ্মীয় স্তম্ভ নির্মাণের প্রক্রিয়া এখনও বজায় রয়েছে। বৃহদাশ্মীয় সংস্কৃতির বর্তমান চিহ্নগুলির ভিত্তিতে এই শাখার গবেষকগণ চেষ্টা করেন আদিম বৃহদাশ্মীয় সংস্কৃতির লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্যগুলির অনুসন্ধান করতে।




  নৃতাত্ত্বিক প্রত্নতত্ত্ব বা পুরাতত্ত্ব চর্চার একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত হরপ্পার পুঁতি নির্মাণের কৌশল অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। আধুনিক যুগে গুজরাটের ক্যাম্বে বা খাম্বাত পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ পুঁতি নির্মাণের কেন্দ্র। মার্ক কেনোয়ার, মাসসিমো ভিদালে এবং কুলদিপ ভান জাতিতত্ত্ব এবং প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে আধুনিক খাম্বাতের পুঁতি নির্মাণ শেলীর ভিত্তিতে হরপ্পা সভ্যতার কেন্দ্র চানহুদারোর তদানিন্তন কালের পুঁতি নির্মাণের একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।



 আলতামিরা উত্তর স্পেনের সানতানাদের নিকট অবস্থিত একটি প্রাগৈতিহাসিক গুহাবাস যেখানে নব্যপ্রস্তর যুগের মানুষ বসবাস করত। ৮৯০ ফুট লম্বা এই গুহাবাস আবিষ্কৃত হয় ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে। এই গুহাবাসের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক গুহার সিলিং ও দেওয়ালে অঙ্কিত ও খোদিত চিত্র যেগুলির বয়স ১৪০০০-১২০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ। ওহার অভ্যন্তরভাগের সিলিং এ লাল,কালো ও বেগুনি রঙ সহযোগে আঁকা বাইসনের চিত্র অসাধারণ। 




  গুহার দেওয়ালে বরং অনেক সহজ সরলভাবে চিত্রিত হয়েছে বন্য শুকর, ঘোড়া, হরিণ, আটটি অ্যানথ্রোপোমর্ফের চিত্র এবং হাতের চিত্র। চিত্রগুলিতে প্রাণির দেহের পেশীর গঠন ও গতিময়তাকে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। চিত্রগুলিকে বিশ্লেষণ করে গবেষকগণ মত প্রকাশ করেছেন যে সে যুগের চিত্রকর ও ভাষ্করদের জ্যামিতিক পদ্ধতিতে মাপজোপ করার একটি ধারণা চলে এসেছিল। দেওয়ালচিত্র ও ওহাবাসে প্রাপ্ত অন্যান্য দ্রব্যের উপর বিশ্লেষণ চালিয়ে পুরাবিদদের অভিমত গুহাটিতে বিশেষ বিশেষ মরসুমে প্রাগৈতিহাসিক মানবগণ সমবেত হতেন।



 আধুনিককালে ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের গবেষকগণ তো ম্যাগনন গুহাশিল্পের প্রকৃতিকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করে তাদের জীবনযাত্রা ও চিন্তাভাবনার জগৎটিকে অনুধাবন করার চেষ্টা করেছেন। এডোয়ার্ড ম্যাকনাল বার্নস ও ফিলিপ রালফ, মত প্রকাশ করেছেন যে ক্রো ম্যাগননদের শিল্পকর্ম এতটাই মৌলিক ও চমকপ্রদ যে ঐ শিল্পসৃষ্টিকে প্রাচীন পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের তালিকাভূক্ত করা উচিৎ ছিল। তো ম্যাগননদের দ্বারা সৃষ্ট চিত্রাঙ্কন, খোদাই ও ভাস্কর্য সম্বলিত এই শিল্পকর্ম পূর্বসূরীদের সঙ্গে তাদের সাংস্কৃতিক দিকে দিয়ে পৃথক করেছিল। 



  

  গুহাচিত্রের নির্মাণে রঙের অপরূপ ব্যবহার, চিত্রে সূক্ষতার মাধ্যমে বক্তব্যকে বিশদভাবে ফুটিয়ে তোলা দেহাকৃতি ও সামগ্রিক বিষয়টির পরিমাপকে যথাযথ রৈখিক ধারণায় উপস্থাপিত করা এবং সর্বোপরি প্রাকৃতিক বিষয়গুলিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ এবং যথার্থভাবে প্রকাশিত করা ফো ম্যাগনন শিল্পের অসামান্য দিক। পশুর চিত্রগুলিতে গতিময়তাকে অতি নিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তাদের লাফানো, ছোটা, খাদ্য চেবানোর ভঙ্গিমা, শিকারীর মোকাবিলার সময় দেহের ভঙ্গিমা সবই যেন অতিশয় বাস্তবোচিত। ক্রো ম্যাগনন চিত্রকরগণ গতিময়তাকে প্রকাশ করতে গিয়ে অত্যন্ত সুদক্ষ নির্মানকৌশল ও উদ্ভাবনীশক্তির প্রয়োগ ঘটিয়েছেন, যেমন পশুর পা ও মাথার স্থান পরিবর্তনের জায়গায় অতিরিক্ত রেখা খোদাই করা হয়েছে এবং এমনভাবে করা হয়েছে যে সম্পূর্ণ গতিময়তাটিকেই প্রাকৃতিক বলে মনে হয়।



  ক্রো ম্যাগননদের তৈরী শিল্পকর্ম থেকে তাদের জীবন ও মননের নানা দিক পুরাবিদগণ অনুধাবন করে থাকেন। শিল্পকর্মকে ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে কো ম্যাগননদের সৌন্দর্যবোধকে অস্বীকার করার উপায় নেই। দেহে উল্কি অঙ্কন করা বা অলংকার পরিধান করা ক্রো ম্যাগনন মানবদের ঐ নাম্পনিক দিকটিকেই প্রতিভাত করে। তথাপি, বার্ন ও রালফের মত ঐতিহাসিকবৃন্দ মনে করেন যে, ক্রো ম্যাগননদের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি তাদের গুহাচিত্রগুলি সৌন্দর্যবোধকে প্রকাশিত করার জন্য তৈরী হয়নি। তারা গুহাচিত্র তৈরী করেছিলেন জীবনধারনের বাস্তব প্রয়োজন সংক্রান্ত বিশ্বাসকে রূপ দেওয়ার জন্য। অধিকাংশ গুহাচিত্র আঁকা হয়েছিল গুহার প্রবেশদ্বার থেকে অনেক ভেতরে যাতে করে তা অন্ধকারে গোপনে থাকে। 


 


   নিয়াউক্স নামক স্থানে প্রাপ্ত গুহায় গুহাচিত্র আঁকা হয়েছিল গুহার মুখ থেকে অর্ধ মাইলেরও বেশি ভেতরে ঢুকে। সহজেই বোঝা যায় যে ক্রো ম্যাগননগণ তাদের শিল্পকর্ম ও তা সৃষ্টির বিষয়টিকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখতে চেয়েছিলেন, গুহার অভ্যন্তরে পশুর চর্বিকে জ্বালিয়ে আলোর ব্যবস্থা করে ছবিই আঁকার অন্য কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়না। চিত্রে কেবল শিকারের প্রাণীর ছবিকেই তুলে ধরা হয়েছিল, অজীব ও উদ্ভিদের ছবি সেখানে অনুপস্থিত। এছাড়াও গুহাচিত্রগুলি একবার আঁকা হয়ে গেলে সেগুলি জো ম্যাগননদের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ত কারণ অসংখ্য ক্ষেত্রে দেখা গেছে একটি চিত্রের উপর নতুন করে আবার চিত্র আঁকা হয়েছিল যা প্রমাণ করে শিল্পসৃষ্টির বিষয়টিই অধিক গুরত্বপূর্ণ ছিল, শিল্পটই নয়। ফলে পুরাবিদগণ অনুমান করেছেনে যে নান্দনিক আনন্দ প্রদানের জন্য নয়, চিত্রগুলি তৈরী হয়েছিল শিকারের সাফল্যের কামনায়। এই আঙ্গিকে বিচার করলে চিত্রকরগণ শিল্পী ছিলেন না ছিলেন একপ্রকার জাদুকর যার চিত্রাঙ্কনের বিষয়টিকে জাদুবিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে গোপনে সম্পাদন করতেন শিকারীর সাফলোকে নিশ্চিত করার জন্য।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *