রাজতরঙ্গিনীর গুরুত্ব ব্যাখ্যা কর
আদি মধ্যযুগের রচিত একমাত্র স্বীকৃত ইতিহাসমূলক গ্রন্থ টি হল রাজতরঙ্গিনী। এটি রচনা করেন কাশ্মীরে ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান কলহন। কলহনের পিতা চম্পক সম্ভবত কাশ্মীর নৃপতি হর্ষের একমাত্র মন্ত্রী ছিলেন। রাজা হর্ষ 1101 খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনচ্যুত ও নিহত হন। কলহন রাজা জয়সিংহের আমলে তিনি রাজতরঙ্গিণী রচনার কাজ সম্পন্ন করেন। আনুমানিক 1148 -49 খ্রিস্টাব্দে এই গ্রন্থ রচনা সম্পন্ন হয়। 8 টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত এই গ্রন্থে প্রায় 4000 সংস্কৃত শ্লোক সন্নিবিষ্ট আছে। প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায়ের বক্তব্য ঐতিহ্য বা পরম্পরাগত লোক শ্রুতির ওপর ভিত্তি করে পরিবেশন করা হয়েছে।
পরবর্তী তিনটি অধ্যায়ের কাকোট ও উৎপল রাজবংশ দুটির ইতিহাস লিখিত আছে। এর উপাদান তিনি সংগ্রহ করেছেন মূলত ওই দুই রাজবংশের কার্যকালে প্রত্যক্ষদর্শী লেখকদের বিবরণ থেকে। শেষ দুটি অধ্যায় তিনি প্রথম ও দ্বিতীয় লোহার রাজবংশের কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছেন। ছটি অধ্যায়ের সাথে শেষ দুটি অধ্যায়ন গুণগত প্রভেদ লক্ষণীয়। প্রথম দুটি অধ্যায়ের রচনাশৈলী প্রধানত অলংকার বর্জিত,সহজ সরল। কিন্তু শেষ অধ্যায়ের বর্ণনা আড়ম্বরপূর্ণ। প্রথম অধ্যায়ঃ গুলিতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কালানুক্রমিক রক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু সপ্তম অষ্টম অধ্যায়ের ঘটনার সন-তারিখ প্রায় অনুপস্থিত। যথাযথ পূর্ব পরিচয় প্রদান না করায় দীর্ঘ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও গৃহগণনা প্রসঙ্গে তিনি নতুন নতুন চরিত্রের আবির্ভাব ঘটিয়েছেন। সম্ভবত দেশবাসীর মানসিক চাহিদার ভিত্তিতে তিনি মূলত কল্পনা ভিত্তিক কাহিনীর অবতরণ করেছিলেন।
কাশ্মীর রাজ জয়সিংহের সভাপতি ছিলেন কলহন। 1149 খ্রিস্টাব্দে এই গ্রন্থ রচনা করেন। তবে কাশ্মীর রাজ সেই হস্তেদ পৃষ্ঠপোষকতায় কাশ্মীর ইতিহাস রচনায় পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। রাজ তরঙ্গিনী বিখ্যাত ঐতিহাসিক কাব্য এই কাব্যটি কে ইতিহাস বা মহাকাব্য বলা চলে। এই রাজ তরঙ্গিনী কাব্যের মূল বিষয়বস্তু কাশ্মীরের ইতিহাস বিভিন্ন লোককথা শিলালিপি বিভিন্ন রচনা তথ্য সংগ্রহ করে কাব্যটি রচনা করেন। রাজ তরঙ্গিনী তে চারটি অধ্যায়ের পরবর্তীকালে সংগতি হলেও পড়বেন অংশের ঐতিহাসিক মূল্য অনেকখানি কিছু কিছু অসংগতি থাকলেও তৎকালীন কাশ্মীর ও জনগণের সামাজিক অবস্থা তুলে ধরেছিলেন।
তৎকালীন কাশ্মীর নিসর্গ চিত্র ও তার গভীর স্বদেশপ্রেমী মিলে মিশে একাধার হয়ে এই কাব্যের মধ্যে ফুটে ওঠে। এটি কাব্য মনোভাব হলেও এতে কল্পনার স্থান মাত্রাতিরিক্ত নয়। এই কাব্যের তথ্য সংগৃহীত হয়েছে 11 টি আকর গ্রন্থ এবং নুরান থেকে। মন্দিরের গায়ে খোদিত বেশকিছু লিপি দানপত্র প্রশস্তি এবং আকর কিছু পান্ডুলিপি এই কাব্যে রচনা কাজে ব্যবহৃত করা হয়।
শুধুমাত্র কাশ্মীরের ধারাবাহিক ইতিহাস নয় কাশ্মীরের বাইরে ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চল এবং বহু পূর্ববর্তী এমনকি যিশুখ্রিস্টের জন্মের পূর্ববর্তী শতকের ভারতীয় ঘটনাবলী এই কাব্যে বর্ণিত হয়েছে। প্রারম্ভিক জীবনে অশোকের শৈবধর্মের প্রতি অনুরাগ, মৌর্য সাম্রাজ্যের শেষ দিকের কয়েকজন শাসকের নাম ,একসময় কাশ্মীরের ওপর কুষাণ রাজ কনিষ্কের আধিপত্য ,খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে ভারতে হুন্দের প্রভাব-প্রতিপত্তি , এবং মিহির কুলের অত্যাচারের কাহিনী কাব্য থেকে জানা যায়।
খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে থেকে কাশ্মীর যে একটি বলিষ্ঠ স্বাধীন রাজ্য হিসেবে গড়ে উঠেছিল তা এই কাব্য থেকে জানা যায়। এই সময় কাকোট বংশের নেতৃত্বে কাশ্মীর একটি শক্তিশালী আঞ্চলিক শক্তি
হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে। এমনকি খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের গোড়া ইন ওই বংশের শাসক মুক্তা পীর ললিতাদিত্য প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। যেকোনো রাজ যশোবর্মন কেউ পরাজিত করেছিলেন সেই প্রতিষ্ঠা ঐতিহাসিক’ সত্য আমরা এই কাব্য থেকে জানতে পারি।
রাজ তরঙ্গিনী কাব্যটির একটি প্রধান ত্রুটি হল এতে ঐতিহাসিকদের বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গির অভাব রয়েছে। এর ফলে এটি পুরোপুরি ঐতিহাসিক গ্রন্থের মর্যাদা পায়নি। ঐতিহাসিক এরা প্রমাণ করে দেখেছেন যে এই কাব্যে উল্লিখিত 52 জন রাজার মধ্যে প্রথম দিকের কয়েকটি রাজার চরিত্র পুরোপুরি কাল্পনিক। এ সত্ত্বেও কলহনের ইতিহাস চেতনা ও সমাজ চেতনা অনস্বীকার্য। উল্লেখ্য রাজ তরঙ্গিনী কাব্যটি কলহন শেষ করে যেতে পারেননি। তার এই অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করেন জ্ঞানরাজ , শ্রী মাধব, নামে পরবর্তী কালের কয়েকজন কবি। তৎকালীন ভারত তথা কাশ্মীরের ঐতিহাসিক উপাদান হিসেবে কলহনের রাজতরঙ্গিনীর গুরুত্ব অপরিসীম।
মূল্যায়ন:
রাজতরঙ্গিনী কাব্যটি ইতিহাস হিসেবে যেমন আদরনীয় তেমনি কাব্যরস কবিদের কাছে কাব্য হিসেবে আদরনীয়। সংক্ষিপ্তভাবে রচনা কাব্যের উৎকর্ষতা নষ্ট হয়নি তবে ঐতিহাসিক কাব্য হলেও গ্রন্থটি শন্তরস প্রধান। পূর্বে ঐতিহাসিক কাব্যের রচয়িতা ছিলেন রাজার আশ্রিত। তারা রাজার জীবনের কীর্তিকাহিনী ও বর্ণনা করেছেন। কিন্তু কলহান ছিলেন একমাত্র ব্যতিক্রম যিনি কাব্যের মাধ্যমে ইতিহাস (রাজতরঙ্গিনী) রচনা করেছিলেন।