‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ নাটকের সংলাপ রচনায় রামনারায়ণ তর্করত্নের কৃতিত্ব আলোচনা করো।
রামনারায়ণ তর্করত্ন ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ (১৮৫৪) লিখে জনপ্রিয় হয়ে উঠলে গুণীন্দ্রনাথ ঠাকুর রামনারায়ণকে অনুরোধ করেন, বহুবিবাহের কুফল দেখিয়ে আর একটা নাটক লিখতে। এর জন্য তিনি পারিতোষিকও দিতে চান। তাই নাট্যকার এবার লেখেন নবনাটক’ নামে আর একটি সামাজিক নাটক, প্রকাশ হয় ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে। এটাও উদ্দেশ্যমূলক নাটক। বহুবিবাহ নামক কুপ্রথা সম্বন্ধে মানুষ সচেতন করার প্রয়াসে এ নাটক রচিত।
জমিদার গবেশবাবুর বয়স পঞ্চাশের বেশি। তাঁর স্ত্রী সাবিত্রী বর্তমান। তবু তিনি চন্দ্রলেখা নামের এক বালিকাকে বিবাহ করে আনলেন। চন্দ্রলেখা স্বামীর প্রিয় হয়ে উঠে সাবিত্রীর দুই ছেলের উপর নির্যাতন চালাতে থাকে। স্বামীর সম্পত্তি হস্তগত করে সতীনকে ঘর থেকে বের করে দেয়। মায়ের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে সাবিত্রীর বড়ো ছেলে সুবোধ বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। সাবিত্রী সহা করতে না পেরে আত্মহত্যা করে। গবেশবাবুও অযত্নে মারা যান। সুবোধ বাড়ি ফিরে মা-বাবার মৃত্যু সংবাদ শুনে মূর্ছা যায়, আর সে মূর্ছা ভাঙে না। সেও মারা যায়। জমিদার বাড়ির বিয়োগান্ত পরিণতি ঘাটে চন্দ্রলেখাকে বিবাহ করার জন্য। কেউ কেউ বলেন, প্রথম নাটকের থেকে এটা নাটক হিসেবে উন্নত। সংস্কৃত নাটকের আদর্শে এর অঙ্গ পরিকল্পিত হলেও নাট্যকারের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতে পেরেছে।
বাংলা নাটকের প্রথম পর্বের একটি জনপ্রিয় সামাজিক নাটক এই ‘কুলীনকূলসর্বঙ্গ’। কৌলীন্য প্রথার বিরোধিতা করে এই নাটক লেখা। প্রচলিত সামাজিক প্রথার কিছু কিছু তখনকার বড়ো মানুষেরা পছন্দ করতেন না। তার কুফল জনসমাজকে জানাবার চেষ্টা করতেন।
রংপুরের কুত্তীগ্রামের জমিদার কালীপ্রসন্ন চৌধুরীও কৌলীনা প্রথা পছন্দ করতেন না। তিনি একটা বিজ্ঞাপন দেন, কৌলীন্যপ্রথার বিরোধিতা করে নাটক লেখার জন্য। যাঁর নাটক শ্রেষ্ঠ হবে, তাঁকে তিনি পুরস্কার হিসেবে ৫০ টাকা দেবেন। এই ৫০ টাকা পাবার জন্য রামনারায়ণ তর্করত্ন নাটক লিখতে প্রবৃত্ত হন এবং তাঁর লেখা ‘কুলীনকুল সর্বস্বই’ শ্রেষ্ঠ হয়।
এই নাটকে কৌলীন্য প্রথার বিষময় ফলই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। গরীব বাবা অর্থাভাবে চার মেয়ের বিবাহ দিতে পারে নি। সমাজচ্যুত হবার ভয়ে তিনি এক বৃদ্ধ পাত্রে চার কন্যাকে সমর্পণ করেন, যার অন্য স্ত্রী ও কন্যা সন্তান রয়েছে। এই বিবাহের চার কন্যার বড়োটির বয়স ৩২, ছোটোটির বয়স ৮। কিছু অর্থ প্রাপ্তির আশায় চার কন্যাকে এভাবে বিবাহ করা বা বিবাহ দেওয়ার অকল্যাণটাই নাটকে প্রদর্শিত হয়েছে।
এই নাটকের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ফুলকুমারী। বহুবিবাহকারী স্বামী যে তার স্ত্রীদের প্রতি কেমন আচরণ করেন, তার ছবিটা ফুটে ওঠে এই ফুলকুমারী এবং আরও কয়েকটি স্ত্রী চরিত্রের সংলাপ থেকে। সংলাপ রচনায় কিছু ত্রুটি থাকলেও এই প্রথম সামাজিক নাটক খুবই জনপ্রিয় হতে পেরেছিল। নাট্যকারও এই নাটকের জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠেন।
‘রত্নাবলী’ রামনারায়ণ তর্করত্নের লেখা অনুবাদমূলক নাটক। নাটক হিসেবে রত্নাবলী যে খুবই উৎকৃষ্ট, এমন নয়। তবু বাংলা নাটকের ইতিহাসে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৫৮ সালে। নাটকটি লেখার পরপরই বেলগাছিয়ার রঙ্গমঞ্চে অভিনয়ের আয়োজন করা হয়। সেই অভিনয় দেখার জন্য আমন্ত্রিত হয়ে আসেন মধুসূদন দত্ত। কিন্তু অভিনয় দেখে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেন নি। অলীক-কুনাট্য বলে মন্তব্য করেন। এবং ভালো নাটক, যথার্থ নাটক লিখে দেখাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নাটক রচনায় ব্রতী হয়েই তিনি ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক রচনা করেন। অর্থাৎ কবি হতে চাওয়া মধুসূদন ‘রত্নাবলী’র কারণেই নাট্যকার হয়ে গেলেন।
শ্রীহর্ষ রচিত সংস্কৃত নাটক ‘রত্নাবলী’র অনুবাদ করেন রামনারায়ণ। সংস্কৃত নাটকের আদর্শ মেনেই হুবহু অনুবাদ করা হয়েছে। পাশ্চাত্য নাটকের আদর্শ সম্পর্কে সচেতন মধুসূদনের কাছে তাই এ নাটক যথার্থ নাটক হিসেবে গণ্য হয়নি। অন্যান্য দর্শকেরা নাটকটি প্রশংসা করলেও মধুসূদন এর সংলাপ রচনা, কাহিনী বিন্যাস, চরিত্রচিত্রণ —সব ব্যাপারেই ত্রুটি লক্ষ্য করেন। সংস্কৃত নাটকের মতো কাব্য ভাষায় লেখা মন্থর সংলাপের কারণে নাটকীয় গতি কোথাও ফুটে ওঠেনি। পাশ্চাত্য নাটকের মতো ছোট ছোট সংলাপের দ্বারা নাট্যদ্বন্দ্ব ঘনীভূত করা সম্ভব হয়নি। তবু উনিশ শতকের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে নাটক নিয়ে গভীরতর চিন্তাভাবনার উৎসাহ-উদ্দীপনা জাগিয়েছে এই ‘রত্নাবলী’। সেই জন্যেই ‘রত্নাবলী’ নাটকের গুরুত্ব রয়েছে।