কী উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশিক সরকার অরণ্য আইন প্রণয়ন করেন
অথবা,
ঔপনিবেশিক সরকার কি উদ্দেশ্যে অরণ্য আইন প্রণয়ন করেছিল
ভূমিকা:
ভারতবর্ষের জনগণের একাংশ হল অনার্য আদিবাসী বা বিভিন্ন উপজাতির লোক। আর্য সংস্কৃতির সঙ্গে এরা একাত্ম হয়ে মিশে যায়নি, নিজেদের সমাজ, ভাষা ও সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে চলেছিল। এরা বাস করে পাহাড়ে, পাহাড়ের পাদদেশে, অরণ্যে বা অরণ্যের সন্নিহিত অঞ্চলে, নদী উপত্যকায়। এদের বেশিরভাগ অরণ্যচারী মানুষ, শিকার ও বনের ফল, মূল কাঠ ও মধু সংগ্রহ হল’এদের জীবিকার উপায়। এরা পাহাড়ের গায়ে ঝুম চাষ করে খাদ্য সংগ্রহ করে, এই চাষে লাঙল বা পশুর দরকার হয় না। ভারতের সর্বত্র বহু উপজাতি লোক বাস করে। সাঁওতাল, ওরাঁও, হো, ভূমিজ, খন্দ, গোও, ভারলি ও নাগারা হল উপজাতি জনগোষ্ঠীর মানুষ। বিদেশিরা এদের উপজাতি বলে চিহ্নিত করেছিল। এরা অস্ট্রিক গোষ্ঠীর ভাষায় কথা বলে, এই ভাষা আর্য বা দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠী থেকে উদ্ভূত নয়। এদের নিজস্ব সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিধিনিয়ম আছে, ভারতের সভ্য মানুষদের সঙ্গে অনেকক্ষেত্রে এদের মিল নেই। তবে এদের ওপর হিন্দু সভ্যতা ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাব পড়েছিল। হিন্দুদের অনেক আচার-আচরণ এরা অনুসরণ করতে থাকে। এরা পাহাড়, অরণ্য ও নদী উপত্যকায় বসবাস করে, এজন্য এরা প্রকৃতির মতো সহজ ও সরল। এরা সারাদিন খেতে বা অরণ্যে কাজ করে, রাতের বেলায় নৃত্য ও গীতে অংশ নেয়, আনন্দময় জীবনযাপন করে। উনিশ শতকে তথাকথিত সভ্য মানুষের সংস্পর্শে এসে এদের জীবনে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে। এরা হিন্দুদের মতো সংস্কার আন্দোলন প্রবর্তনকরে দৈহিক শুচিতা রক্ষা এবং মদ্যপান পরিত্যাগ করে উন্নততর জীবনের সন্ধান করতে থাকে। পুরোনো ও নতুনকে মেলাতে গিয়ে এদের মধ্যে আত্ম-পরিচয়ের সংকট তৈরি হয়।
ঔপনিবেশিক সরকার অরণ্য আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যে:
1) অষ্টাদশ শতকের শুরুতে ভারতে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে নতুন নতুন শহরের নির্মাণ, জাহাজ তৈরি, রেলপথ প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি প্রয়োজনে ভারতের অরণ্য সম্পদের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। নানা বাধানিষেধের মাধ্যমে সরকার আদিবাসীদের বনজ সম্পদ আহরণের অধিকার কেড়ে নেয়। তারা নিজ পরিশ্রমে যে কৃষিজমি উদ্ধার করে তার উপর সরকার খাজনা বসায়।
2) সরকার ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে ‘অরণ্য সনদ’-এর দ্বারা ভারতীয় অরণ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করে। এর দ্বারা জনগণ কর্তৃক অরণ্যের কাঠ সংগ্রহ ও কাঠের ব্যাবসার উপর সরকার বাধানিষেধ আরোপ করে। অরণ্যের শাল, সেগুন প্রভৃতি মূল্যবান কাঠ সরকারের সম্পত্তিতে পরিণত হয়।
3) উনিশ শতকে আদিবাসীরা ছিল প্রান্তিক মানুষ, সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে এরা মিশতে পারেনি। মূল স্রোত থেকে এরা স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে চলেছিল। কিন্তু এই সময়ে এদের জীবন ও সংস্কৃতিতে সংকট দেখা দেয়। এই পরিবর্তন এনেছিল ব্রিটিশ শাসন, আইন ও বিচারব্যবস্থা।
4) অরণ্য আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ছিল ব্রিটিশ সরকার নতুন ভূমি বন্দোবস্ত করেছিল, সব ধরনের জমির ওপর কর বসেছিল। মধ্যস্বত্বভোগীদের সঙ্গে সরকারি ভূমি বন্দোবস্ত হলে এদের জীবনধারায় পরিবর্তনের সূচনা হয়। এরা জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষ-আবাদ করে, তারপর সেই আবাদি অঞ্চলে সরকার ভূমি বন্দোবস্ত করলে জমিদার, জোতদার, মহাজন, বণিক, ঠিকাদার ও দালালরা চলে আসে। আদিবাসী সমাজে ভূমিরাজস্বের ধারণা ছিল না, যৌথভাবে কিছু অনিয়মিত কর তারা ওপরওয়ালাকে দিত কিন্তু কর দেওয়া তারা পছন্দ করত না।
5) ব্রিটিশ ভূমি ব্যবস্থায় সকলকে কর দিতে বাধ্য করা হয়। প্রথাগত আদিবাসী ব্যবস্থার সঙ্গে নতুন ব্যবস্থার মৌলিক পার্থক্য দেখা দেয়। ব্রিটিশ পুলিশ ও বিচারব্যবস্থা স্থাপিত হলে এদের প্রথাগত বিচারব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
6) ব্রিটিশ আইন-কানুন এরা বুঝত না কারণ এদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটেনি। আধুনিককালে খ্রিস্টান মিশনারিরা এদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার প্রকল্প ও সেবামূলক কাজকর্ম চালিয়েছিল। এদের মধ্যে অনেকে লেখাপড়া শিখে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিল কিন্তু খ্রিস্টান ধর্ম ও সংস্কৃতি এদের ওপর তেমন গভীর প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।
7) খ্রিস্টান মিশনারিরা আদিবাসীদের মধ্যে অনুসন্ধান চালিয়ে এদের সমাজ, ধর্ম, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক জীবনের ওপর আলোকপাত করেছিল। আদিবাসী জীবন ও সংস্কৃতির অনেক কিছু শিক্ষিত ভারতবাসীর জানা হয়ে যায়।
8) আদিবাসীদের একাংশ ছিল অরণ্যচারী, এরা অরণ্যের ওপর নির্ভর করে জীবন কাটাত। অরণ্যের কাঠ সংগ্রহ, পশু শিকার ও ফল মূল সংগ্রহ করে নির্বিবাদে জীবন কাটিয়ে দিত। কিন্তু এদের শান্ত জীবন অশান্ত হয়ে উঠল যখন সরকার ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে আইন পাশ করে সংরক্ষিত বনে ঝুম চাষ নিষিদ্ধ করেছিল বা নিয়ন্ত্রণ করেছিল। অরণ্য আইন প্রণয়নের মূখ্য উদ্দেশ্যে ছিল সরকার অরণ্য সম্পদের ওপর একচেটিয়া অধিকার স্থাপনের জন্য এদের কাঠ সংগ্রহ ও গোচারণের অধিকার নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াস চালিয়েছিল।
9) ঔপনিবেশিক সরকার অরণ্য আইন প্রণয়নের অন্যতম উদ্দেশ্যে ছিল রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য সরকার সত্তর ও আশির দশকে অরণ্য আইন কড়াকড়ি করে কার্যকর করতে শুরু করেছিল। সরকার বনজ সম্পদ বিদেশে রপ্তানি শুরু করলে আদিবাসী অঞ্চলের অরণ্য-নির্ভর জীবনধারা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
10) সরকার ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে বনবিভাগ গঠন করে এবং ডায়াট্রিক ব্র্যান্ডিস নামে জনৈক জার্মানকে বনবিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেল হিসেবে নিয়োগ করে। সরকার ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ‘ভারতীয় অরণ্য আইন’ পাস করে । ঔপনিবেশিক অরণ্য আইনের উদ্দেশ্য ছিল অরণ্য সম্পদের উপর ভারতীয়দের অধিকার খর্ব করে এবং অরণ্যকে সরকারি সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা। সরকার ঘোষণা করে যে, অরণ্যে ঘেরা যে-কোনো ভূমিই হল সরকারের সম্পত্তি।
11) ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের দ্বিতীয় ‘ভারতীয় অরণ্য আইন’-এর দ্বারা সরকার অরণ্যের উপর নিজের অধিকার আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করে। সরকার এর এই পদক্ষেপের ফলে অরণ্যের উপর নির্ভরশীল ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায় তাদের শতসহস্র বছরের অরণ্যের অধিকার হারিয়ে প্রচণ্ড দুর্দশার শিকার হয়।
12) আদিবাসী বা উপজাতি সম্প্রদায় হল ভারতের প্রাচীন বাসিন্দা। তারা অরণ্যের নানাবিধ সম্পদ আহরণ, পাথুরে অনুর্বর পতিত জমিতে চাষবাস প্রভৃতির দ্বারা কোনোরকমে জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর তাদের ওপর সীমাহীন অর্থনৈতিক শোষণ নেমে আসে। এই শোষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন।
মূল্যায়ন:
ব্রিটিশ আমলে সারা ভারতের আদিবাসীরা যে অভিযোগগুলি তুলেছিল তাদের মধ্যে প্রধান হল তারা জমির অধিকার হারিয়েছে। দিকুরা তাদের জমি জবরদস্তি করে অধিকার করে নিয়েছে। বণিক ও মহাজনরা তাদের প্রতারণা করেছে, মিথ্যা মামলা সাজিয়ে জেলে পাঠিয়েছে। ব্রিটিশ বন আইনের জন্য তারা ‘অরণ্যের অধিকার’ হারিয়েছে। তারা অরণ্য থেকে কাঠ ও মধু সংগ্রহ করতে পারে না, পশু শিকার নিষিদ্ধ হয়েছে, অরণ্যে গোচারণের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। পুলিশ ও নিম্ন আদালতের কর্মচারীরা তাদের ওপর অত্যাচার করে, তাদের জবরদস্তি খাটানোর (বেত বেগারি) বিরুদ্ধে তারা কোনো প্রতিকার পায় না। জমির জন্য কর দিতে তারা অভ্যস্ত নয়, টাকার জন্য সুদ দিতেও তারা জানে না। একজন মিশনারি আদিবাসীদের অভিযোগগুলি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘বিচার চেয়ে আমরা সরকারের কাছে আর্জি করেছিলুম, কিছুই পাইনি। মিশনে গেলুম, তারাও দিকুদের হাত থেকে আমাদের বাঁচাল না। এখন আমাদের নিজেদের কোনো লোকের দিকে তাকানো ছাড়া আর কিছু করার নেই।