StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

নীল বিদ্রোহে সংবাদপত্রের ভূমিকা বিশ্লেষণ করো


নীল বিদ্রোহে সংবাদপত্রের ভূমিকা বিশ্লেষণ করো

অথবা,

নীল বিদ্রোহে সংবাদপত্রের ভূমিকা আলোচনা করো




ভূমিকা:


 নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের প্রতিবাদে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এবং জনগণ সরব হয়ে ওঠে। হিন্দু প্যাট্রিয়ট সমাচার চন্দ্রিকা’, ‘সমাচার দর্পণ’, ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ প্রভৃতিতে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের ঘটনাধা রাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। ফলে কলকাতার শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় নীলচাষিদের প্রতি সহানুভূতি জানায়। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শিশিরকুমার ঘোষ, মনোমোহন ঘোষ,কিশোরীচাঁদ মিত্র প্রমুখের লেখা ও প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আন্দোলনকে বৃহত্তর রূপ দিয়েছিল।




নীল বিদ্রোহে সংবাদপত্রের ভূমিকা:



হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় তাঁর হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় প্রথম থেকেই সমকালীন বাংলার সামাজিক শোষণ, সাধারণ মানুষের উপর সরকার ও পুলিশের অত্যাচার, বাংলার নীলচাষিদের উপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচার, বাংলার চাল ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য রপ্তানি করে মদ আমদানি, পুরুষের বহুবিবাহ প্রভৃতির বিরুদ্ধে সরব হয়। সমাজের উচ্চবিত্ত বাঙালি, এমনকি ইউরোপীয়রাও এই পত্রিকা থেকে দরিদ্রশ্রেণির উপর তীব্র শোষণ ও অত্যাচারের কাহিনি জানতে পারে। হরিশচন্দ্র ভারতের সাম্রাজ্যবাদী শাসক লর্ড ডালহৌসির নগ্ন সাম্রাজ্যবিস্তার নীতির সমালোচনা করে দুঃসাহসের পরিচয় দেন। লোভনীয় সরকারি চাকরির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে তিনি সরকারের বিরোধিতা চালিয়ে যান।




বাংলার কৃষকদের উপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে হরিশচন্দ্র ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে কলম ধরেন। সারা বাংলায় সংবাদদাতা নিয়োগ করে তিনি নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিবরণ সংগ্রহ করেন এবং তা এই পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশ করতে থাকেন। বহু শিক্ষিত ব্যক্তি এবং ইউরোপীয় পাদরিও নীলকরদের অত্যাচারের সংবাদপত্রিকার দপ্তরে পাঠাতেন। সীমাহীন পরিশ্রম এবং স্ত্রী ও সন্তানদের অকালমৃত্যুর কারণে মানসিক অবসাদ প্রভৃতির ফলে শীঘ্রই হরিশচন্দ্রের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। তা সত্ত্বেও ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ এর কাজ থেকে তিনি কখনও ছুটি নেননি।




১৮১৯ সালে অক্ষয়কুমার দত্ত ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় এবং ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ‘প্রভাকর’ পত্রিকায় এ নিয়ে লেখালেখি করেছিলেন। পশ্চিমি শিক্ষার আলোকে আলোকিত বাঙালি বুদ্ধিজীবী নতুন করে কৃষককে আবিষ্কার করেছিল। হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর হিন্দু পেট্রিয়ট, শিশিরকুমার ঘোষ ও বাগ্মী রামগোপাল ঘোষ কৃষকদের পক্ষ নেন। 




 অধ্যাপক চিত্তব্রত পালিতের মধ্যে এই বিদ্রোহে কৃষকরা নেতৃত্ব দেয়নি এবং বিদ্রোহ স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না। ভূস্বামী জমিদাররা ছিলেন এই বিদ্রোহের নেতা। গ্রামবাংলায় জমিদার ও নীলকরদের স্বার্থের বিরোধ ছিল, গ্রামীণ নেতৃত্ব ফিরে পাবার আশায় জমিদাররা এ বিদ্রোহ শুরু করেছিল। হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও কৃষ্ণদাস পালের মতো নেতারা জমিদারদের বক্তব্য তুলে ধরেন।




হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় তাঁর সম্পাদিত হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকা নীল বিদ্রোহের নায়ক দের কথা উল্লেখ করেছিলেন। হরিশচন্দ্র তার হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিবরণ সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি যেভাবে এই বিদ্রোহে রায়তদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, তা আমাদের প্রশংসা কেড়ে নেয় এবং অনেকেই সঙ্গত কারণে এর জন্য তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। শিবনাথ শাস্ত্রী বলেছেন “নীলকর অত্যাচার নিবারণ হরিশের এক অক্ষয় কীর্তি। এই কার্যে তিনি দেহ, মন, অর্থ, সামর্থ্য সকলি নিয়োগ করিয়াছিলেন।”




অমৃতবাজার পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা শিশির কুমার ঘোষ ও এই বিদ্রোহের সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি শুধু সাংবাদিকের দায়িত্ব পালন করেননি তিনি যশোহর নদীয়ার গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষকদের সঙ্ঘবদ্ধ করেন।



যোগেশচন্দ্র বাগলের এর  মতে “ইংরেজদের স্বেচ্ছাচারের কথা হিন্দু পেট্রিয়টে যেরূপ নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হইতে লাগিল এমন কি তখনকার কোন পত্রিকারই বাহির হইত কিনা সন্দেহ। যশোহরের শিশিরকুমার ঘোষ, কৃষ্ণনগরের মনোমোহন ঘোষ, কুমারখালির হরিনাথ মজুমদার ও মথুরানাথ মৈত্রেয়, দীনবন্ধু মিত্র প্রভৃতির দ্বারা প্রেরিত নীলকরদের অত্যাচারের কথা হরিশচন্দ্র যথারীতি পেট্রিয়টে প্রকাশ করিতেন এবং তাহার উপর টিপ্পনী ও মন্তব্য লিখিতেন।




অন্যদিকে দীনবন্ধু মিত্র তার নীলদর্পণ নাটক লিখে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিলেন এবং এই নাটকের ইংরেজি অনুবাদ জেমস লং এর নামে প্রকাশিত হয় যেসব নাটকীয় ঘটনা ঘটেছিল তাও প্রত্যেক বাঙালির জানা সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র নীলকমল একটি বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তা আমরা প্রমোদ রঞ্জন সেনগুপ্ত বিরচিত নীল বিদ্রোহ ও বাঙালি সমাজ গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি। হিন্দু প্যাট্রিয়ট ছাড়া অন্য পত্রপত্রিকাও নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কলম ধরে ছিল।হিন্দু পেট্রিয়ট ছাড়া অন্য পত্র পত্রিকাও নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিল।




নীলদর্পণ তখন বাংলা দেশে ও বাঙালী সমাজে ঝড় তুলেছিল। অনেকেই এই নাটককে হেরিয়েট স্টোর লেখা আঙ্কল টমস্ কেবিন-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ সমকালীন লেখক নীলদর্পণ সম্পর্কে তাদের মূল্যবান বক্তব্য রেখেছেন। আজও নীলদর্পণ নিয়ে বাঙালীর আবেগ, উচ্ছ্বাস ও সমালোচনার অবসান হয় নি। এই নাটক লেখার কিছু পরে, তা মাইকেল মধুসূদন দত্ত কর্তৃক ভাষান্তরিত হয় ও রেভারেণ্ড জেমস্ লত্রে নামে প্রকাশিত হয়। এর জন্য লঙ্ সাহেবের জরিমানা হয় এবং এই জরিমানার টাকা কালিপ্রসন্ন সিংহ দিয়েছিলেন।



১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা থেকে নাটকটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। নাটকে উল্লিখিত নীলকর উদ্ভ-এর অত্যাচার জনমানসে শিহরণ সৃষ্টি করে। এই নাটক বাঙালির মনে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়। ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় নাটকটি অনূদিত হলে ইউরোপবাসী বাংলার নীলচাষিদেরদুর্দশা সম্পর্কে জানতে পারে। ‘নীলদর্পণ’-এর মধ্য দিয়ে নীলবিদ্রোহের বিবরণই শুধু নয়, ফুটে উঠেছিল নীলচাষিদের নিদারুণ অবস্থার মর্মস্পর্শী চিত্র।




মূল্যায়ন:


উনিশ শতকে বিভিন্ন বাংলা সংবাদপত্র ও সাহিত্যে সমকালীন নীল বিদ্রোহের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে , নীল বিদ্রোহের অত্যাচারিত জনগণের বিরুদ্ধে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় হিন্দু প্যাট্রিয়ট, দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ,অক্ষয়কুমার দত্তের ‘তত্ত্ববোধিনী’ এবং ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ‘প্রভাকর’ , বিভিন্ন পত্রপত্রিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । কিন্তু এসব পত্রপত্রিকা বা সাহিত্যের প্রচার অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুধু কলকাতা শহরের মধ্যে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কলকাতার বাইরে কিছু প্রধান শহরে সীমাবদ্ধ ছিল। । ফলে শহুরে শিক্ষিতশ্রেণির বাইরে সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী পত্রপত্রিকা ও সাহিত্যের বার্তা সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিল। নীল বিদ্রোহে সংবাদপত্রের ভূমিকা বা গুরুত্ব অপরিসীম।












Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *