প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে দেশীয় সাহিত্যিক উপাদানের গুরুত্ব সংক্ষেপে আলোচনা করো
দেশীয় সাহিত্যিক উপাদান
ভূমিকা:
প্রাচীন ভারতে দেশীয় সাহিত্যিক উপাদান খুবই কম। সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের জীবনধারা বোঝার জন্য সাহিত্যিক উপাদান রয়েছে। সাবধানতার সঙ্গে সেগুলি ব্যবহার করে ঐতিহাসিকরা ইতিহাস রচনা করে থাকেন। তবে মনে রাখা দরকার যে, আমাদের দেশের ধারাবাহিক ইতিহাস জানার জন্য কেবল সাহিত্যিক প্রমাণের ওপর নির্ভর করা নিরাপদ নয়।
বৈদিক সাহিত্য:
দেশীয় সাহিত্যিক উপাদানের অন্যতম উপাদান বৈদিক সাহিত্য। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর আগের ইতিহাস জানার জন্য বেদ তথা বৈদিক সাহিত্যের ওপর আমরা পুরোপুরি নির্ভর করে থাকি। বৈদিক সাহিত্য বলতে ঋক, সাম, যজু,অথর্ব—এই চারটি বেদ ছাড়াও ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, সূত্র সাহিত্য ও উপনিষদকে বোঝায়। চারটি বেদের মধ্যে ঋগ্বেদ সংহিতা প্রাচীন। এরকম বলা হয়ে থাকে যে ঋগবেদকে সঙ্গে নিয়ে আমরা ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক যুগে প্রবেশ করেছি। ঋগ্বেদ রচনার সময়কাল নিয়ে পণ্ডিত মহলে নানা মতামত বিরাজমান। তবে সাধারণভাবে মনে করা হয় এর আনুমানিক সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের মধ্যে। ঋগ্বেদে প্রধানত প্রার্থনার মন্ত্র সন্নিবেশিত হয়েছে। পরবর্তী বেদ ও উপনিষদগুলি সম্ভবত রচিত হয়েছিল ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে। সুতরাং উভয় ধরনের বেদের মধ্যে বেশ কয়েকশো বছরের ব্যবধান রয়েছে। পরবর্তীকালে রচিত এই বেদগুলিতে প্রার্থনা বিষয়ক বর্ণনা ছাড়াও বিভিন্ন উৎসব এবং বহু কাল্পনিক কাহিনীও লিপিবদ্ধ আছে। উপনিষদগুলিতে প্রধানত দার্শনিক বিষয়বস্তু উপস্থাপিত হয়েছে। প্রসঙ্গত বলা যায় দীর্ঘ পরম্পরা ধরে বেদগুলি আরো স্পষ্ট করে বললে বেদের শিক্ষাগুলি গুরু থেকে শিষ্যের মধ্যে মুখে মুখে প্রচারিত হত। তখন তা লিখিত রূপ পায়নি। এই কারণেই বেদের আর এক নাম শ্রুতি।
বেদের ওপর নির্ভর করে ইতিহাস রচনা কতখানি বিশ্বাসযোগ্য সে-বিষয়ে তাঁর যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একথা অনস্বীকার্য যে, ইতিহাস রচনায় বৈদিক সাহিত্য অপরিহার্য। বেদগুলির পরিশিষ্ট হিসাবে ব্রাহ্মণসমূহ এবং ব্রাহ্মণগুলির পরিশিষ্ট হিসাবে আরণ্যক ও উপনিষদগুলিকে ধরে নেওয়া হয়। এগুলিতে প্রাচীন কিছু ঐতিহ্য, যথা— যাগযজ্ঞ, আচার-অনুষ্ঠান প্রভৃতি বিধৃত থাকায় কোনো কোনো সময় এগুলি ইতিহাস রচনার কাজে ব্যবহার করা হয়। যেহেতু বৈদিক সাহিত্য ছাড়া সে-যুগের কোনো ইতিহাস আমরা জানতে পারি না, সেহেতু সমকালীন ইতিহাস রচনার কাজে এগুলি অপরিহাস।
পুঁথি:
প্রাচীন দেশীয় সাহিত্যিক উপাদান পর্যায়ে পড়ে পুঁথিগুলিও। ঋগ্বেদের সূক্তগুলির রচনাকাল থেকে মধ্যযুগের আদিভাগের মধ্যে রচিত বিভিন্ন সময়ের অনুলিখনে কিছু গ্রন্থ আছে, যেগুলি আমরা পুঁথির আকারে পাই। তবে স্মরণ রাখা দরকার যে, এই পুঁথিগুলির মধ্যে অনেকগুলিই আধুনিক যুগে আবিষ্কৃত সম্পাদিত ও মুদ্রিত হয়েছে। এইভাবে যে পুঁথিগুলি আমরা হাতে পাই, সেগুলি গ্রন্থকাররা পুরনো পুঁথি থেকে অনুলিখন করেছেন। আধুনিককালের গ্রন্থকাররা যেহেতু প্রাচীনকালের পুঁথিগুলি অনুলিখন করে থাকেন সেহেতু এগুলিতে ভুলভ্রান্তি থাকা অসম্ভব নয়, বরং স্বাভাবিক। পুঁথিগুলির আর একটা বড় ত্রুটি হল এই যে, নতুন গ্রন্থকাররা অনুলিখনের সময় পূর্ববর্তী লেখকের গ্রন্থে নিজেদের বক্তব্যের অনুপ্রবেশ ঘটাতে পারেন। ফলে প্রাচীন ইতিহাস রচনার কাজে পুঁথিগুলিকে নির্দ্বিধায় গ্রহণ করা চলে না।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে দেশীয় সাহিত্যিক উপাদানের উল্লেখযোগ্য স্থান রয়েছে রামায়ণ ও মহাভারতের।
রামায়ণ :
এই মহাকাব্যের প্রধান চরিত্র রামচন্দ্রের নামানুসারেই এর ঐরূপ নামকরণ। মহাভারতের তুলনায় আয়তনের দিক থেকে রামায়ণ অনেক ছোট। উল্লেখ্য, বর্তমানে যে রামায়ণ আমরা দেখতে পাই তার শ্লোকসংখ্যা চব্বিশ হাজার এবং সাতটি ভাগ (কাণ্ড)-এ বিভক্ত। প্রসঙ্গত বলা যায়, মহাভারতের ন্যায় রামায়ণের আদিরূপও আমরা দেখার সুযোগ পাইনি। মহাভারতের ন্যায় রামায়ণও লেখা হয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে। সাধারণভাবে মনে করা হয় রামায়ণ খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় বা দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতকের মধ্যে রচিত হয়েছিল। অর্থাৎ মহাভারতের রচনাকালের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় এটি আগে শুরু হয়ে পরে শেষ হয় এবং রামায়ণ পরে শুরু হয়ে আগে শেষ হয়। পূর্ণকলেবরে মহাকাব্যের রূপ আগে পায় বলেই সম্ভবত এর নাম হয়েছে আদিকাব্য। রামায়ণ রচনার সঙ্গে মহাকবি বাল্মীকির নাম জড়িত। কিন্তু মনে রাখা দরকার এটি কোনো একক মানুষের কর্মকাণ্ড নয়। কেননা, কোনো একজন ব্যক্তির পক্ষে তো চার-পাঁচশো বছর ধরে কোনো কাব্য রচনা সম্ভব নয়। বলাবাহুল্য, এই মহাকাব্যের মধ্যে বহু প্রক্ষিপ্ত অংশ আছে। পণ্ডিতদের অনুমান রামায়ণের সপ্তম কাণ্ড সম্পূর্ণ রূপে এবং প্রথম কাণ্ডের অনেকটাই পরবর্তীকালের সংযোজন।
রামায়ণ মহাকাব্যটির ঘটনাস্থল উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশে কোশল রাজ্যে। মূল কেন্দ্র অযোধ্যা। যদিও এই মহাকাব্যে বর্ণিত অযোধ্যা এবং বর্তমানকালের অযোধ্যা এক বা অভিন্ন কি না সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। উল্লেখ্য, প্রখ্যাত প্রায় সমস্ত ঐতিহাসিকই স্বীকার করে থাকেন যে, খ্রিঃপূঃ ষষ্ঠ শতকের আগে ভারতবর্ষের ধারাবাহিক রাজনৈতিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থাদি থেকে ভারতে যে ‘ষোড়শ মহাজনপদ’ এর কথা জানা যায়, তার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য জনপদ ছিল কোশল, যার অন্তর্ভুক্ত ছিল অযোধ্যা। কিন্তু স্মরণে রাখা দরকার যে বৌদ্ধ গ্রন্থ অঙ্গুত্তর নিকায় ও জৈন গ্রন্থ ভগবতীসূত্রে ছয়টি প্রধান নগরের নামোল্লেখ আছে, যার মধ্যে অযোধ্যা অনুপস্থিত। এরকম মনে করা হয়ে থাকে যে সরযূ নদীর তীরে অবস্থিত প্রাচীন সাকেত (জৈন বৌদ্ধ গ্রন্থে উল্লেখিত এবং কোশল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত) শহরই অযোধ্যা নামে পরিচিত হয়েছে। অনুমান হয় যে মহাকাব্যের অযোধ্যা সাকেতের সঙ্গে মিশে গেলেও যেতে পারে।
রামচন্দ্র রামায়ণ মহাকাব্যের নায়ক এবং মহাকাব্য অনুসারে তিনি অযোধ্যার রাজা দশরথের জ্যেষ্ঠ পুত্র। কিন্তু তাঁর ঐতিহাসিকত্ব নিয়ে গভীর সংশয় আছে। এখনও পর্যন্ত কোনো ইতিহাসবিদ রামচন্দ্রকে ঐতিহাসিক চরিত্রের মর্যাদা দেননি। উল্লেখ্য, মহাভারতে বর্ণিত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের বিষয়টি যেমন প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের দ্বারা প্রমাণিত, রামায়ণে বর্ণিত রাম-রাবণের যুদ্ধ ও অন্যান্য কাহিনি কিন্তু পুরাতাত্ত্বিক বা অন্য কোন সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত নয়। বলাবাহুল্য, নির্ভরযোগ্য প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ না থাকলে কেবলমাত্র কাব্যে বর্ণিত চরিত্রকে ঐতিহাসিক মর্যাদা দেওয়া যুক্তিসঙ্গত হবে না।
মহাভারত :
সাধারণভাবে মনে করা হয়। কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত রচনা করেছিলেন। সাম্প্রতিককালে পণ্ডিতদের গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হল ঐ ধারণা ঠিক নয়। কারণ এই দীর্ঘ মহাকাব্যটি কোনো একজন বিশেষ মানুষ বা কবির জীবনকালের মধ্যে সমাপ্ত হওয়া সম্ভব নয়। মহাকাব্যটি সমগ্র অংশ পাঠ করলে বোঝা যায় যে এটি কোনো একজন কবির লেখা নয়। বহু কবি কয়েক শতক ধরে এটি লিখেছিলেন। তবে বেদব্যাস সেই সমস্ত কবিদের মধ্যে একজন। যাঁরা এটি লিখেছিলেন তাঁদের প্রায় সকলেরই নাম সম্ভবত কালস্রোতে ভেসে গেছে। উল্লেখ্য, মহাভারতের যে আয়তন আমরা বর্তমানে পেয়ে থাকি তার ভিত্তিতে বলা যায় এটি পৃথিবীর দীর্ঘতম কাব্য। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর অন্য সব মহাকাব্যের বহু ঊর্ধ্বে এর স্থান। কেন ঊর্ধ্বে তার উত্তরও আছে মহাভারতে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘মহভাদ্ভাবক্ত্রাচ্চ মহাভারতমুচাতে (১/১/২০৯)। এর অর্থ হল মহত্ত্ব ও ভারবত্ত থাকার জন্যই এর নাম মহাভারত।
তারিখ নির্ণয়ের বিষয়টি যদিও বিতর্কিত, তথাপি পণ্ডিতেরা সকলেই এই বিষয়ে একমত যে এটি লেখা হয়েছিল সুদীর্ঘকাল ধরে। বেদগুলি যেহেতু মহাভারত সম্পর্কে নীরব সেহেতু মনে হওয়া স্বাভাবিক যে মহাভারতের রচনা কাল বৈদিক যুগ (আঃ ১৫০০ খ্রিঃ পূঃ-৬০০ খ্রিঃ পৃঃ)-এর পরে। পণ্ডিতপ্রবর অধ্যাপক উইনটারনিৎস বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে এসেছেন যে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের মধ্যে মহাভারত রচিত হয়েছিল। বর্তমান মহাভারতের শ্লোকসংখ্যা এক লক্ষেরও অধিক।
কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে যুদ্ধ মহাভারতের প্রধান বিষয়বস্তু হলেও এর অসংখ্য • শ্লোকে বহু চিরন্তন সত্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। এখানে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। মহাভারতের শান্তিপর্বে যুধিষ্ঠির বলছেন, ‘পাপ করে ফেলে নিজেকে অমানুষ মনে করা উচিত নয়; সূর্য যেমন রাত্রিশেষে উদিত হয়ে অন্ধকারকে বিনষ্ট করে, তেমনই সৎকর্মের দ্বারা দুষ্কর্ম বিনষ্ট করা যায়’ (১২/১৪৯/৩১-৩২); “মহাসমুদ্রে যেমন দুটি কাষ্ঠখণ্ড ভাসতে ভাসতে কাছাকাছি আসে, আবার একটু পরে ভাসতে ভাসতে দুদিকে চলে যায়, এই পৃথিবীতে মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগও একই রকম’ (১২/২৮/৩৬)। আবার এক জায়গায় কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন, ‘সাহসের সঙ্গে যারা যুদ্ধে উদ্যত, যারা প্রাণের আশা পুরোপুরি ত্যাগ করেছে, তাদের সামনে। দাঁড়াবার সাধ্য স্বয়ং ইন্দ্রদেবেরও নাই।’ মহাভারতের দ্রোণপর্বে ধৃতরাষ্ট্রের অনুশোচনা শুনে সঞ্জয় বলেছেন, ‘এখন অনুতাপ করে কি লাভ? প্লাবন ভেঙে আসবার পর সেতু বাঁধবার চেষ্টার মতোই নিষ্ফল এ বিলাপ’। এই ধরনের আরো অনেক চিরন্তন সত্য বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছে নানা উপমার মাধ্যমে, যা এখানে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন।
পুরাণ প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় পুরাণের স্থান মুখ্য না হলেও একেবারে অগ্রাহ্য নয়। তৎকালীন ভারতের এমন অনেক রাজবংশ আছে যেগুলির বিবরণ পুরাণগুলিতে বর্ণিত হয়েছে। উল্লেখ্য, পুরাণে অতীতের ঘটনাসমূহ লিপিবদ্ধ হয়েছে ভবিষ্যৎ কালে। প্রত্নতাত্ত্বিক ও অন্যান্য সাহিত্যিক উপাদান থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনেক সময় পুরাণ কর্তৃক সমর্থিত হয়। তবে কেবল পুরাণের ওপর নির্ভর করে ইতিহাস রচনা সমীচীন হবে। না। কারণ বিভিন্ন সময়ে এগুলির মধ্যে নানা পরিবর্তন ঘটেছে। এককথায়, পুরাণ হল প্রাচীন কাহিনীর সমন্বিত রূপ। ধর্মীয় অনুশাসনের কথা এগুলিতে স্থান পেয়েছে। পুরাণের মোট সংখ্যা ১৮। ঐতিহাসিক উপাদান হিসাবে সমস্ত পুরাণগুলি অবশ্য সমান মূল্যবান নয়। ইতিহাস রচনার কাজে যে সমস্ত পুরাণগুলি থেকে সাধারণত তথ্য আহরণ করা হয়, সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘বিষ্ণুপুরাণ’, ‘বায়ুপুরাণ’,‘মৎস্যপুরাণ’, ‘ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ’, ‘গরুড় পুরাণ’ এবং ‘ভবিষ্য পুরাণ’। পুরাণ বা মহাপুরাণগুলি ছাড়াও আরো বেশ কিছু ক্ষুদ্র পুরাণ আছে যেগুলি উপপুরাণ নামে সমধিক প্রসিদ্ধ। বাস্তবে এগুলির সংখ্যা প্রায় একশো। ইতিহাস রচনার কাজে লাগে এমন কয়েকটি উপপুরাণ হল ‘বৃহন্নারদীয়’, ‘বৃহদ্ধর্ম’ ও ‘কালিকা পুরাণ’। পুরাণগুলি ঠিক কখন রচিত হয়েছিল সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা না গেলেও একথা বলা যেতে পারে যে, এখন যে পুরাণগুলি আমরা ব্যবহার করে থাকি সেগুলির রচনাকাল আনুমানিক ৪০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে।
রাজনৈতিক দিক ছাড়াও আর্থ-সামাজিক ইতিহাস রচনায় পুরাণগুলির ভূমিকা নগণা নয়। উল্লেখ্য, পুরাণে বর্ণিত কলিযুগের সূত্র ধরে প্রাচীন ও আদি মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষে সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো অনুধাবনে প্রয়াসী হয়েছেন এক শ্রেণীর পণ্ডিত। এঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন রামশরণ শর্মা। বস্তুত, পুরাণগুলি রচিত হয়েছিল সমকালীন আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে এবং পুরাণ রচয়িতাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। স্বাভাবিকভাবেই সমকালীন সমাজের সার্বিক চিত্র এগুলিতে প্রতিফলিত হয়েছে। প্রসঙ্গত বলা যায় বহু বর্ণ-উপবর্ণের নাম, নারী জাতির অবস্থান এবং কলিযুগ সম্পর্কে এক স্বচ্ছ ধারণা পুরাণগুলিতে উপস্থাপিত হয়েছে।প্রত্নতাত্ত্বিক অথবা কোনো নির্ভরযোগ্য সাহিত্যিক উপাদানের সাহায্যে পুরাণে উল্লেখিত তথ্যগুলি যাচাই করে নিতে হয়।
বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্য:
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পুরাণ ছাড়াও দেশীয় বহু মূল্যবান উপাদান ইতিহাস রচনার কাজে ব্যবহৃত হয়। এ প্রসঙ্গে বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থা ও মগধের অভ্যুত্থান সংক্রান্ত বিষয় অবহিত হওয়া যায় বৌদ্ধ গ্রন্থ ‘দীঘ নিকায়’ ও ‘অঙ্গুত্তর নিকায়’ থেকে। ‘ধম্মপদ’-এ খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর উল্লেখযোগ্য মহামানব বুদ্ধদেবের বাণী সম্পর্কে চারশো তেইশটি বক্তব্যের সংকলন করা হয়েছে। বৌদ্ধধর্মের একজন সুমহান শিক্ষক হিসাবে কুষাণ যুগের নাগার্জুনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর রচিত ‘মধ্যমক শাস্ত্র’ এবং ‘মহাপ্রজ্ঞাপারমিতা শাস্ত্র’ উল্লেখের দাবি রাখে।
জৈন গ্রন্থাদিও প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। জৈনগ্রন্থ ভগবতীসূত্র খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হতে আমাদের সাহায্য করে। বিশাখদত্তের মুদ্রারাক্ষস গ্রন্থটি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও চাণক্য কর্তৃক নন্দবংশ ধ্বংস করে মগধের সিংহাসনে চন্দ্রগুপ্তের অধিষ্ঠানের বিস্তৃত বিবরণ সরবরাহ করে থাকে। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সম্পর্কে হেমচন্দ্রের লেখা পরিশিষ্টপর্বণ গ্রন্থটি ইতিহাস রচনার কাজে লাগে। ভদ্রবাহু বচিত কল্পসূত্রে মহাবীরের জীবন কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।
মৌর্য ও মৌর্যোত্তর যুগের সাহিত্য:
মৌর্য ও মৌর্য পরবর্তী যুগের বেশ কিছু দেশীয় সাহিত্যের পরিচয় পাওয়া যায়। এগুলির মধ্যে ঐতিহাসিক দিক থেকে সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হল কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র। অর্থশাস্ত্রের রচনাকাল নিয়ে ঐতিহাসিক মহলে বাদবিতণ্ডা থাকলেও মৌর্যযুগের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ এতে পাওয়া যায়। প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে ‘অর্থশাস্ত্র’ একটি প্রামাণ্য দলিল।
তৎকালীন যুগের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনধারাও এতে সুন্দরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এছাড়া, দুটি উল্লেখযোগ্য ব্যাকরণ গ্রন্থ হল অষ্টাধ্যায়ী ও মহাভাষ্য। প্রথমটির রচয়িতা পাণিনি এবং এর রচনাকাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতক। এর থেকে বৈদিক যুগের পরবর্তীকালের ইতিহাস সম্বন্ধে অবহিত হওয়া যায়। ‘মহাভাষ্য’ লিখেছিলেন পতঞ্জলি খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে। শুঙ্গ রাজবংশের ইতিহাস এবং ব্যাকট্রীয় গ্রিকদের মধ্যভারত আক্রমণ সম্পর্কে এই গ্রন্থটি সংবাদ পরিবেশন করে থাকে। এছাড়াও উক্ত দুটি সংস্কৃত ব্যাকরণ গ্রন্থে ঘটনাক্রম, শাসকবর্গ, প্রজাতন্ত্র ও নানা রাজনৈতিক ঘটনাবলীর উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রাক্-গুপ্ত ও গুপ্তযুগের স্মৃতিশাস্ত্র:
প্রাক্-গুপ্ত ও গুপ্তযুগে আইন ও ধর্ম সংক্রান্ত তথ্য জানার জন্য সর্বোৎকৃষ্ট উপাদান হিসাবে ধর্মশাস্ত্র বা স্মৃতিশাস্ত্রগুলির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। স্মৃতি-শাস্ত্রগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল— মনুস্মৃতি, নারদস্মৃতি, কাত্যায়ন স্মৃতি, বৃহস্পতিস্মৃতি, যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতি প্রভৃতি। খ্রিস্টীয় প্রথম ছয় শতকের মধ্যে প্রধান প্রধান স্মৃতিশাস্ত্রগুলি লিখিত হয়েছিল। এই গ্রন্থগুলিতে রাজা, অমাত্য ও বিভিন্ন বর্ণের মানুষের কর্তব্যের সুস্পষ্ট নির্দেশ আছে। সম্পত্তি বিক্রয় ও তা রক্ষা এবং উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইন-কানুন ও বিধি-নিষেধের কথাও এগুলিতে বর্ণিত আছে। এছাড়াও অপরাধমূলক কোনো কাজ, যথা— চুরি, হত্যা প্রভৃতি বিষয়ে কী ধরনের দণ্ড দেওয়া হবে তারও সুস্পষ্ট বিবরণ এগুলিতে লিপিবদ্ধ আছে। এককথায়, শাস্ত্রকাররা এক আদর্শ সমাজের ছবি এঁকেছিলেন। কিন্তু স্মরণ রাখা দরকার যে, তাঁদের প্রদত্ত উপদেশ ও বিধি-বিধান সর্বদা সঠিকভাবে মেনে চলা হত না।
গুপ্তযুগের অন্যান্য সাহিত্যিক উপাদান:
গুপ্তযুগে ঐ সমস্ত শাস্ত্রগ্রন্থগুলি ছাড়াও অন্যান্য সাহিত্যিক উপাদানের সংখ্যা কম নয়। সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি ও এলাহাবাদ প্রশস্তির রচয়িতা হরিণে একজন কবি হিসাবেও প্রসিদ্ধ। তাঁর বিভিন্ন লেখনী সমুদ্রগুপ্তের ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে কিছু আলোকপাত ঘটায়। ভাস ও কালিদাসের রচনা থেকে সমকালীন ভারতের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। ভাস প্রণীত নাটক ‘চারুদত্ত’ এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। কাব্য ও নাটক উভয় ক্ষেত্রেই কালিদাস স্বচ্ছভাবে বিচরণ করেছেন। তাঁর নাটক ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’ এবং ‘রঘুবংশম্’ ও ‘মেঘদূত’ কাব্য দুটি সংস্কৃত ভাষার উৎকর্ষ ছাড়াও ঐতিহাসিক দিক থেকে মূল্যবান। রঘুবংশম্-এ গুপ্ত শাসক সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যজয়ের কিছু আভাস মেলে। বিশাখদত্তের দেবীচন্দ্রগুপ্তম্ নাটকটি গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে সিংহাসনের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত সমস্যা ও পশ্চিমি শকদের সঙ্গে গুপ্তদের সমকালীন সম্পর্ক নির্ধারণে একটা অস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। বরাহমিহিরের বৃহৎসংহিতা এবং প্রায় সমসাময়িক বাৎসায়নের কামসূত্র-য় সমকালীন সমাজ ও সমাজে নাগরকদের জীবনযাত্রার চিত্র বর্ণিত হয়েছে। উল্লেখ্য, খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের রচনা বৃহৎসংহিতা থেকে কৃষি সংক্রান্ত বহু তথ্য পাওয়া যায়। বিভিন্ন বর্ণ ও নানা স্তরের আমলাদের বাসস্থান কি ধরনের হওয়া দরকার তার আলোচনাও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এই গ্রন্থে।
গুপ্তোত্তর যুগের সাহিত্য:
জীবনচরিতমূলক গ্রন্থগুলির মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য হল হর্ষবর্ধনের সভাকবি বাণভট্টের লেখা হর্ষচরিত। এতে হর্ষবর্ধনের জীবনী ও রাজত্বকাল সম্পর্কে বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। তবে এই গ্রন্থটির দুটি ত্রুটি লক্ষণীয়—হর্ষবর্ধনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত কয়েকটি ঘটনা ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক বিষয়ে বাণভট্ট বিশেষ আলোকপাত করেননি।
আদি মধ্যযুগের দুজন কবি, বাপতি ও বিলহন যথাক্রমে কনৌজরাজ যশোকান এবং কল্যাণের চালুক্য শাসক যষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের জীবনচরিত ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা করেছেন। বাকপতির গৌড়বাহ ও বিলহনের বিক্রমাঙ্কদেবচরিত এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য। এগুলি সম্পর্কে বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়েছে এই বই-এর দ্বিতীয় খণ্ডে। আদি মধ্যযুগ তথা প্রাচীন ভারতের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত। এতে পাল আমলের শেষদিকে পাল শাসক রামপাল কর্তৃক কৈবর্ত বিদ্রোহ দমন করে পালদের আদি বাসভূমি বরেন্দ্রী উদ্ধারের কথা আলোচিত হয়েছে।
সঙ্গম সাহিত্য:
সংস্কৃত সাহিত্য ছাড়াও তামিল সাহিত্য থেকে দক্ষিণ ভারতের ইতিহাস রচনার জন্য মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। এই তামিল সাহিত্য ইতিহাসে সঙ্গম সাহিত্য নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ। ‘সঙ্গম’ বলতে বোঝাত তামিল কবিদের সংঘ সম্মেলনকে। এই সংঘ বা সম্মেলন সম্ভবত রাজা অথবা সর্দারের আনুকূল্যে আয়োজিত হত।যীশুখ্রিস্টের জন্মের পরে প্রথম কয়েক শতাব্দীর শাসকবর্গের সম্বন্ধে সঙ্গম সাহিত্য আমাদের অবহিত করে।
সঙ্গম সাহিত্যের সঠিক সময়কাল নিয়ে বিতর্ক থাকলেও অধিকাংশ সংকলন আনুমানিক ৩০০ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সম্পূর্ণ হয়েছিল বলে মনে করা হয়। এতদসত্ত্বেও সঙ্গম যুগ বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে যীশুখ্রিস্টের জন্মের কয়েকশো বছর আগে থেকে তার জন্মের কয়েকশো বছর পর পর্যন্ত সময়কালকে। সঙ্গম সাহিত্যকে ‘আখ্যান’ ও ‘উপদেশাবলী’—প্রধানত এই দুটি ভাগ করা হয়ে থাকে। এই গ্রন্থগুলি থেকে কর সংগ্রহের পদ্ধতি, বিচার ব্যবস্থা এবং বণিক, শিল্পী ও কৃষকদের সম্পর্কে নানা তথ্য আহরণ করা সম্ভব হয়। নগরায়ণ সংক্রান্ত কিছু তথ্যও পাওয়া যায় এগুলি থেকে। কাঞ্চী, কাবেরীপত্তনম, মাদুরা প্রভৃতি নগরগুলির উল্লেখ এতে আছে। বিভিন্ন সামাজিক ও ব্যবসায়িক শ্রেণীর আচার-আচরণ বর্ণিত হয়েছে এগুলিতে।
তামিল ভাষায় লেখা যীশুখ্রিস্টের জন্মের পরবর্তী কয়েক শতকের মধ্যে রচিত দুটি প্রসিদ্ধ মহাকাব্য যথা সিলগদিকারম ও মণিমেকলই এর কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে।
এছাড়াও তামিল গ্রন্থ তোকলিয়ম-এ তামিল ব্যাকরণ ও অলঙ্কার শাস্ত্রের পরিচয় পাওয়া যায় তাই নয়, সমকালীন দক্ষিণ ভারতীয় সমাজ সম্পর্কেও কিছু তথ্য আহরিত হয়ে থাকে এই গ্রন্থটি থেকে।
মূল্যায়ন:
পরিশেষে বলা যায় যে, প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে দেশীয় সাহিত্যিক উপাদানের গুরুত্ব বা ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন দেশীয় সাহিত্য যেমন পুরান, বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থ, মহাভারত ও রামায়ণ এর মত প্রাচীন গ্রন্থ, সঙ্গম সাহিত্য,গুপ্তোত্তর যুগের সাহিত্য,মৌর্য ও মৌর্যোত্তর যুগের সাহিত্য,প্রাক্-গুপ্ত ও গুপ্তযুগের স্মৃতিশাস্ত্র, সমস্ত দেশীয় সাহিত্য বিশিষ্ট অবদান রেখেছে, ফলে প্রাচীন ইতিহাসের অনেক তথ্য আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় লেখমালা ও মুদ্রার মতোই দেশীয় সাহিত্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যদিও দেশীয় সাহিত্যে বেশ কিছু ত্রুটি রয়েছে তা সত্বেও বলা যায় প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে দেশীয় সাহিত্যিক উপাদান গুরুত্ব অপরিসীম।
Thanks 😊
Khub help holo ☺️