StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

বাংলা চিত্রকলার ইতিহাসে বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের অবদান


বাংলা চিত্রকলার ইতিহাসে বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের অবদান 

 



আধুনিক চিত্রকলার ইতিহাসে যেসকল শিল্পী সুধী সমাজে তাঁদের শিল্পকর্মের দ্বারা প্রতিষ্ঠা লাভে সক্ষম হয়েছেন বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় ছিলেন তাঁদেরই একজন। ১৯০৪ সালে কলকাতার বেহালায় তাঁর জন্ম হয়। ১২-১৩ বছর বয়সে বাবা-মায়ের ইচ্ছানুসারে তিনি শান্তিনিকেতনের শিশুবিভাবে শিক্ষার জন্য ভর্তি হন এবং সন্তোষ কুমার মিত্র মহাশয়ের কাছে পাঠ শুরু করেন। একই সময়ে অপর শিল্পী নগেন্দ্রনাথ আইচের কাছেও তিনি শিল্পের পাঠ গ্রহণ করতে থাকেন। ১৯২০ সালে নন্দলাল বসু শান্তিনিকেতনের কলাভবনে স্থায়ীভাবে যোগদান করলে বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় ছাত্র হিসেবে কলাভবনে যোগ দেন। একটি চোখে তিনি প্রায় দেখতেই পেতেন না, অপর চোখটিরও দৃষ্টিশক্তি ছিল সীমিত। তথাপি, চোখ নির্ভর চিত্রাঙ্কন বিদ্যায় তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবল। প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও শুধুমাত্র আত্মবিশ্বাসের ভর দিয়েই বিনোদবিহারী একজন মহান শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হন।





ভারতীয় ক্ষেত্রে ধ্রুপদী চিত্রকলার ধারক নন্দলাল বসুর যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে বিনোদবিহারী গুরুর শিল্পদর্শন উপলব্ধিকে প্রকাশ করতে সক্ষম হন এবং নন্দলাল বসুর একজন সেরা ছাত্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। শিল্পী হিসেবে পরবর্তীকালে নন্দলাল বসুর উত্তরাধিকার প্রাপ্ত বিনোদবিহারী গুরুর মতই একাধিক বিষয়ে দক্ষ ছিলেন। রঙ-তুলি দিয়ে চিত্রাঙ্কন ছাড়াও ফ্রেস্কো, লিনোকাট, লিথোগ্রাফ, উডকাট, এচিং, ড্রাই পয়েন্ট ইত্যাদি কাজে তাঁর দক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত। নন্দলালের ছবিতে তিনি যেসব বৈশিষ্ট্য প্রত্যক্ষ করেছিলেন তাঁর মধ্যে চারটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ—১। বস্তু ও রূপের একাত্মতা, ২। বর্ণ অপেক্ষা রেখার দৃঢ়তা ও ছন্দময় নির্ভরতা, ৩। স্থাপত্যরূপী নির্মাণ ও ৪। অতীত-বর্তমানের সংঘাতের পটভূমিতে বিষয়বস্তুর গ্রহণ ও বর্জন। চারটি বিষয়কে বিনোদবিহারী তাঁর নিজের আঁকা ছবিতে নিজস্বতার নিরিখে প্রয়োগ করেছিলেন।





ভিত্তিচিত্রে নন্দলাল বসুর প্রবর্তিত আধুনিক ধারা বিনোদবিহারীর ছবিতে আরো পরিশীলিত ও পরিমার্জিত রূপে লক্ষ্য করা যায়। তাঁর আঁকা ভিত্তিচিত্রগুলির মধ্যে ১৯৪০ সালে শান্তিনিকেতনের ছাত্রাবাসের সিলিং-র চন্দ্রাতপ সুদৃশ্য কাজটি বিখ্যাত। ছবিতে একটি পুকুরকে ঘিরে গাছপালা, ফুল-ফল, মানুষজন, পশু-পাখির সংযোজন খুবই অর্থবহ। বীরভূমের গ্রাম্যজীবনের ব্যতিক্রমী রূপ ছবিটিতে অকৃত্রিমভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ভিত্তিচিত্র হিসেবে শান্তিনিকেতনের হিন্দিভবনের দেওয়ালে আঁকা তাঁর সুবৃহৎ ছবিটিও নিঃসন্দেহে প্রশংসারযোগ্য। ছবিটির বিষয়বস্তুতে মধ্যযুগীয় সাধুসন্তদের জীবনযাত্রা তুলে ধরা হয়েছে। এইরূপ একাধিক ভিত্তিচিত্র তাঁকে খ্যাতির শিখরে উন্নীত হতে সাহায্য করে। তাঁর আঁকা নিসর্গচিত্রগুলিতে অবনীন্দ্র-উত্তর আধুনিকতার সংযোজন লক্ষ্য করা যায়। লিনোকাট ও উডকাটের কাজগুলিতে সমকালীন কালের শৈলীর প্রত্যক্ষ প্রয়োগ তিনি ঘটিয়েছিলেন।





বিনোদবিহারীর চিত্রে মননশীলতার ছাপ খুব স্পষ্ট। চিত্রাঙ্কনের বিষয়ে সংখ্যাতত্ত্বের পরিবর্তে উৎকর্ষতার সমৃদ্ধি সাধনেই তিনি নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। ভারতীয়তার পরম্পরা ক্ষুন্ন করে পাশ্চাত্যের ক্রিয়াকর্মের আত্মীকরণের তিনি ঘোর বিরোধী ছিলেন। তবে চিন, জাপানের রেখাধর্মী চিত্রশৈলীতে তাঁর অসীম আগ্রহ ছিল। বিনোদবিহারী পৌরাণিক বিষয়কে কেন্দ্র করে খুব কম ছবি অঙ্কন করেন এবং ‘ওয়াশ’ পদ্ধতিতে প্রায় কোনো কাজ করেননি বললেই চলে। অবনীন্দ্র-নন্দলালের প্রকৃত সম্মীলন ঘটেছিল তাঁর সামগ্রিক শিল্পকর্মে। একজন সৃজনশীল শিল্পী হিসেবেও বিনোদবিহারী নিজেকে তুলে ধরতে সক্ষম হন। তাঁর চিত্রকর্মগুলিতে যেমন মৌলিকত্বের স্বাদ পাওয়া যায়, তেমনি এগুলির ভিত্তি ছিল ধীশক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। জটীলতা বিবর্জিত, নান্দনিক প্রবাহমানতায় পুষ্ট। তাঁর শিল্পকর্মগুলি আগামী প্রজন্মের কাছে শিক্ষণীয় হিসেবে বিবেচিত হয়।





শিক্ষক হিসেবেও বিনোদবিহারী যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেন। কলাভবনের অধ্যাপনার কাজ ছাড়াও বাংলার বাইরে রাজস্থান, হিমাচলপ্রদেশের বিভিন্ন চিত্রশিক্ষা কেন্দ্রে তিনি শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। পাটনার সরকারি আর্ট কলেজেও তিনি কিছুদিন অধ্যাপনা করেছিলেন। ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মবিভূষণ’ সম্মান প্রদান করেছিল।





লেখক হিসেবেও বিনোদবিহারীর যথেষ্ট পরিচিতি ছিল। তাঁর ‘চিত্রকর’ গ্রন্থটির জন্য তিনি মরণোত্তর ‘রবীন্দ্র’ পুরষ্কার লাভ করেন। তাঁর আঁকা ছবিগুলির মধ্যে ‘অধ্যয়ন’ (লিনোকাট), ‘নেপাল উৎসব’, ‘মধ্যযুগের সাধুসন্তরা’ (ভিওিচিত্র), ‘চড়াই-উতরাই’, ‘নারী ও ফুল’, ‘শীতকাল’, ‘বারান্দা’ (উডকাট) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। বীরভূমের প্রামবাংলা ও শান্তিনিকেতনের একাধিক কার্যক্রমকে কেন্দ্র করেও তিনি বহু চিত্র অঙ্কন করেন। তবে তাঁর আঁকা ফ্রেস্কো চিত্রগুলি সর্বশ্রেষ্ঠ। ১৯৮০ সালের নভেম্বর মাসে এই মহান শিল্পীর জীবনাবসান হয়।বাংলা চিত্রকলার ইতিহাসে বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের স্থান অবিস্মরণীয়। 




Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *