বাংলা চিত্রকলার ইতিহাসে যামিনী রায়ের অবদান সম্পর্কে যা জান লেখো
বাংলার বাইরে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে যে কজন চিত্রশিল্পী খ্যাতির শিখরে উন্নীত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে যামিনী রায় ছিলেন অন্যতম। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিশ্র জোড়াতালি দেওয়া রীতিতে ছবি না এঁকে অদ্ভূতভাবে নিজের স্টাইলে আবদ্ধ থেকেছিলেন বলেই তিনি খ্যাত হয়ে উঠেছিলেন।
১৮৮৭ সালে বাঁকুড়া জেলার বেলিয়াতোড় গ্রামে যামিনী রায় জন্মগ্রহণ করেন। ছোটোবেলা থেকেই গ্রামের পরিবেশের সরল জীবনযাত্রার মধ্যে তিনি এক অদ্ভূত শৈল্পিক ছন্দ খুঁজে পান এবং শিল্পী হওয়াকেই জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। গ্রামীণ কারুশিল্পের প্রতি তখন থেকেই তাঁর গভীর আকর্ষণ ছিল।
যামিনী রায়ের পিতা তাঁকে কলকাতার ‘গভর্নমেন্ট স্কুল অফ্ আর্ট এন্ড ক্র্যাফটস্’-এ ভর্তি করে দেন। যামিনী রায় ওরিয়েন্টাল আর্টে ভর্তি না হয়ে সেখানে ওয়েস্টার্ন অ্যাডেমিক আর্টে ভর্তি হন। ক্লাসে তখন মডেল দেখে আঁকার প্রচলন সবে মাত্র চালু হয়েছিলচ। এইরূপ মডেল দেখে চিত্রাঙ্কন পদ্ধতি যামিনী রায়ের পছন্দ হয়নি। তাই তিনি কিছুদিনের মধ্যেই স্কুল ত্যাগ করেন। এসময় তাকে জীবন নির্বাহের কঠিন সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়েছিল। এই সূত্রে কলকাতা ছেড়ে এলাহাবাদে গিয়ে তিনি এক জার্মান সাহেবের রঙীন ছবি ছাপবার ছাপাখানায় কাজ নেন। এইখানেই রঙ মেশানোর বিষয়ে তিনি অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। কিছুদিন পর কলকাতায়ফিরে এসে তিনি স্থানীয় একটি রঙীন লিথোগ্রাফির প্রেসে কর্মী হিসেবে যোগ দেন। কখনো কাপড়ের দোকানো, কখনো থিয়েটারের দৃশ্যপট আঁকার কাজ করে তিনি জীবন নির্বাহ করতে থাকেন। জীবিকার তাগিদে তাঁকে বড়লোকদের প্রতিকৃতি ও ঘর সাজানোর জন্য নগ্ন নারীমূর্তি আঁকতেও হয়েছিল। তেলরঙে তাঁর অসাধারণ দক্ষতা ছিল। ধনী ক্রেতাদের ছবি বিক্রি করে তাঁর আর্থিক সমস্যার কিছুটা সুরাহা ঘটে। এইসময়ই অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় এবং তিনি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিকৃতি আঁকার ফরমায়েশ পান।
৩২-৩৩ বছর বয়সে যামিনী রায়ের জীবনে একটা পরিবর্তন আসে। যে তেল রঙকে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম হিসেবে ভালোবেসেছিলেন, ক্রমে সেই তেলরঙে আর প্রতিকৃতি আঁকতে তাঁর অরুচি জন্মায়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, এবার থেকে স্বদেশীরীতিতেই তিনি ছবি আঁকবেন। পূর্ববর্তী যুগের পটুয়াদের মত রঙ তৈরির কৌশল শিখে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে ‘টেম্পারা’ ও ‘গুয়াশে’ তিনি ছবি আঁকার কাজে মনোনিবেশ করেন। তাঁর ছবির বিষয়বস্তু হিসেবে উঠে আসে বাঁকুড়া তথা গ্রাম বাংলার লোকশিল্প ও কারুশিল্পের উপকরণসমূহ। ছোটোবেলায় দেখা দেবদেবীর মূর্তি, পুকুরঘাট, সাঁওতাল পরিবার, পুতুল খেলা, বিভিন্ন জীবিকার মানুষ তাঁর চিত্রে অভিনব রূপসজ্জায় ফিরে আসে। আধুনিকতা, বাস্তবতা ও বৈভবের হাতছানি সত্ত্বেও এইরূপ বৈরাগ্যের সাধনার ফলে জীবনের শুরুতে সাময়িকভাবে দৈন্যতার মধ্যে পড়লেও শেষপর্যন্ত তিনি জয়ী হন।
যামিনী রায় ছিলেন অত্যন্ত মিষ্টভাষী, সরল ও সাদামাটা মানুষ। বিত্তবান হয়ে ওঠার সুযোগ তাঁর কাছে ছিল। ধনের চাইতে জ্ঞান ও মানের কদর তাঁর কাছে ছিল অত্যন্ত বেশি। অত্যন্ত সাধারণভাবে জীবন ভাতিবাহিত করে তিনি নিজেকে গ্রামবাংলার যথার্থ প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হন। ১৯৭২ সালে এই মহান শিল্পীর জীবনাবসান ঘটে।
যামিনী রায়ের আঁকা ছবির সংখ্যা কারোর মতে ১০ হাজার, কারোর মতে বিশ হাজারের কম নয়। এইসব চিত্রকর্মের মধ্যে ‘মা ও হাতিশাবক’, ‘মা ও ছেলে’, ‘নৌকাযাত্রা’, ‘সূত্রধর’, ‘কৃষ্ণলীলা’, ‘বিড়াল’, ‘আভিজাত্য’, ‘বুদ্ধ’, ‘নারী’, ‘সীতার অগ্নিপরীক্ষা’, ‘দধিমহন’, ‘বৈষ্ণবী’, ‘বালিকা’, ‘মাছ মুখে বিড়াল’, ‘কৃষ্ণবলরাম’ ইত্যাদি সর্বজনপরিচিত ও বিখ্যাত।
চাক্ষুস সরলতা যামিনী রায়ের চিত্রকলার মূল শক্তি। যামিণী রায়ের চিত্রকলা ভারতীয়তার ও শুদ্ধতার প্রতীক। ইতিপূর্বে ভারতের কোনো শিল্পী এত সরল ও সাবলীলভাবে মৌলিক চিত্র অঙ্কনে সক্ষম হননি।বাংলা চিত্রকলার ইতিহাসে যামিনী রায়ের অবদান অনস্বীকার্য।