StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

ভারতীয় শিল্পকলায় মৌর্য যুগের গুরুত্ব

 


ভারতীয় শিল্পকলায় মৌর্য যুগের গুরুত্ব

হরপ্পা উত্তরকাল থেকে মৌর্য যুগ পর্যন্ত; অশোকের রাজত্বকালের আগে অবধি কোনও শিল্প-সংস্কৃতির নমুনা তেমন পাওয়া যায় না। অথচ, মৌর্য সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে ভারতীয় শিল্পের বিকাশে যে পরিণতি আমরা লক্ষ্য করি, তা নিঃসন্দেহে শিল্পকলার ধারাবাহিক চর্চা ছাড়া সম্ভবপর ছিল না। প্রাক্-মৌর্যযুগের শিল্প নমুনা একাধিক কারণে সম্ভবত আমরা পাই না। প্রথমত, প্রয়োজনীয় প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান ও খননের ফলে সেযুগের শিল্পকীর্তিগুলি সম্ভবত আমাদের অজানা রয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, এই যুগের শিল্পীরা সম্ভবত তাদের কীর্তিগুলি নির্মাণে এমন উপাদান ব্যবহার করেন যার স্থায়ীত্ব কম ছিল (মাটি বা কাঠ)।

পোড়ামাটি বা কাঠের দ্বারা তারা যে শিল্প-নিদর্শনগুলি সৃষ্টি করেন হাজার বছর ব্যবধানে সেগুলি কালের গর্ভে লীন হয়ে গেছে। তৃতীয়ত, ভারতীয় শিল্পরীতির সূচনা হয়েছিল মূলত ধর্মীয় বিষয়বস্তুকে অবলম্বন করে। খ্রিস্ট-পূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত ব্রাহ্মণ্য বা অব্রাহ্মণ্য কোনো ধর্মেই মূর্তি-পূজার স্বীকৃতি ছিল না। এইকারণে মন্দির নির্মাণের প্রয়োজন পড়েনি। তাই ভাস্কর্য ও স্থাপত্যশিল্পের বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল। অশোক বিদেশী শিল্পীদের আমন্ত্রণ করে আনলে ভারতীয় ভাস্কর্য ও স্থাপত্য দরবারী পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে পুনরায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

ভারতীয় শিল্পকলায় মৌর্য যুগের গুরুত্ব অপরিহার্য।বৈদিক যুগের পরবর্তী যুগ ভারতের ইতিহাসে একইসঙ্গে বৌদ্ধযুগ এবং ষোড়শ মহাজনপদের যুগ নামে পরিচিত। ষোড়শ মহাজনপদের মধ্যে কাশী, কোশল, অঙ্গ, মগধ, কুরু, পাঞ্চাল, মৎস এবং গান্ধার সমধিক প্রসিদ্ধ ছিল। এর মধ্যে উত্তপ-পশ্চিমে গান্ধার ও সিন্ধু ছিল পারসিক সম্রাট সাইরাস ও তার পৌত্র দরায়ুসের সাম্রাজ্যের অন্তর্গত। এইসময় ভারতে শিল্প নিদর্শনের বিষয়ে কিছুই জানা যায় না। প্রাচীন মগধের (বিহার) ‘রাজগৃহ’ বা ‘গিরিব্রজ’-র বিশালাকার পাথরের প্রাচীর দেখলে আমরা সেযুগের জীবনযাত্রা সম্পর্কে অনুমান করতে পারি। একটির উপর একটি পাথর বসিয়ে এই নগরের প্রাচীরটি নির্মিত হয়। বর্তমানে রাজগীরে এই প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ লক্ষ্য করা যায়। খ্রিস্ট-পূর্ব ষষ্ঠ ও পঞ্চম শতাব্দীর প্রথম ভাগে পারসিক সম্রাট দরায়ূস মিশর, গ্রিস ও পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের এনে তাঁর সুবিশাল রাজপ্রাসাদগুলিতে অপূর্ব স্থাপত্য-ভাস্কর্য রচনা করেন। পারসিক সম্রাটদের সারা বিশ্ব থেকে শিল্পী সংগ্রহের ফলে সম্ভবত ভারতেও নতুন চিত্তধারার ঢেউ উঠেছিল।

হরপ্পার স্থাপত্য নিদর্শনের পর রাজগৃহ বা বর্তমান রাজগীরে প্রায় খ্রিস্ট-পূর্ব ৫০০ অব্দে নির্মিত যে ধ্বংসস্তূপ সমূহ চারিদিকে ছড়িয়ে আছে, তার মধ্যে একটি স্থাপত্যকে ঐতিহাসিকরা মহাভারতের যুগের।

পরাক্রান্ত জরাসন্ধের স্থাপত্য বৈঠক’ বলে উল্লেখ করেছেন। ঐতিহাসিক ফার্গুসন বলেন—অশোক পূর্ববর্তী যুগের প্রস্তর স্থাপত্যের নিদর্শনরূপে একমাত্র ‘জরাসন্ধের বৈঠকটি’-ই টিকে আছে। বৈঠকটি একটি উঁচু বেদীর = উপর নির্মিত হয়েছিল। বেদীটি সমচতুষ্কোণ, প্রত্যেক বাহুর দৈর্ঘ্য ৮০ ফুট। ভূমি থেকে মঞ্চের দেওয়াল হেলানোভাবে উপরের দিকে ওঠায় উপরের তলের আয়তন ৭৪ বর্গফুট। কাঁচা ইট পোড়াবার জন্য যেভাবে ইট সাজানো হয়, বৈঠকটির বহিরাকৃতি অনেকটা সেধরনের। মিশরের প্রথম যুগের পিরামিডগুলির সঙ্গে এর আকৃতিগত মিল আছে। প্রত্যেকটি প্রস্তর অত্যন্ত নিখুঁতভাবে কেটে স্থাপন করার কারণে মশলার কোনো প্রয়োজন হয়নি। স্থপতির নিখুঁত বিন্যাসের জন্য বেদী বা বৈঠকটি প্রায় ২৫০০ বার নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যেও দণ্ডায়মান রয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি ক্ষুদ্র কক্ষ আছে। কক্ষগুলির দৈর্ঘ্য ৬-৭ ফুট, প্রস্থ ৩-৪ ফুট। এগুলি কুঠুরির মত ক্ষুদ্রাকার।

জরাসন্ধের মৃত্যুর পর তার পুত্রের পরবর্তী চৌত্রিশ পুরুষ অজাতশত্রুর বৃহৎ প্রস্তর নির্মিত দূর্গের স্মৃতিচিহ্ন এখনও রাজগীরে বর্তমান আছে। দূর্গের বিশাল প্রাচীরের সুদীর্ঘ বেষ্টনীর বৃহৎ পাথরের খণ্ডগুলি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। এ দুটি অতীত কীর্তি ব্যতীত অশোকের পূর্ববর্তী যুগের উল্লেখযোগ্য কোনো স্থাপত্য এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি।

বুদ্ধের আবির্ভাব খ্রিস্ট-পূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে শিল্পসৃষ্টির সহায়ক হয়। তাঁর মতবাদে ঈশ্বরে বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের স্থান নেই; মূর্তিপূজা অবাস্তর। তিনি জীবিত মানুষের মূর্তি ও আলেখ্য রচনা নিষিদ্ধ করে প্রচার করেছিলেন নারী, শিশু ও জীবপ্রেমের বাণী। জীবনের আনন্দ-উল্লাসের সর্বপ্রকার উপকরণগুলি ত্যাগ করার কথা তিনি বলেন। তথাপি, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে খ্রিস্ট-পূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যবর্তীকালে শিল্পবিকাশের পক্ষে একটি আদর্শ পরিমণ্ডল সৃষ্টি হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে।

ষোড়শ মহাজনপদের যুগে কাশী, বৈশালী, রাজগৃহ, পাটালিপুত্র, বিদিশা, তাম্রলিপ্ত ইত্যাদি নগর সৃষ্টি হয় এবং নগরকে কেন্দ্র করে জনপদ বা রাষ্ট্র গঠিত হতে থাকে। মগধ, কলিঙ্গ প্রভৃতি জনপদে বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। ফলে আর্থিক সমৃদ্ধি আসে। লৌড়িয়-নন্দনগড়ে পাওয়া যায় সোনার মূর্তি, যা এইসময়েই নির্মিত। এগুলি ভারতের প্রাচীনতম ভাস্কর্য-পর্যটন মূর্তি। দিদারগঞ্জে পাওয়া নারীমূর্তি ও সেনগরের যক্ষিণী মূর্তিগুলি সম্ভবত এইসময়ই নির্মিত হয়। বিভিন্ন গ্রন্থে ধাতু ও মাটির তৈরি মূর্তি-বিগ্রহ থেকে বোঝা যায়, সেসময় শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা সমাজের সর্বস্তরেই ছিল।

প্রাক্-মৌর্যযুগের শিল্পরীতির যোগসূত্র এসেছিল মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পার শিল্পরীতি থেকে। এতে বৈদেশিক প্রভাব ছিল না। এইযুগে ধ্রুপদী শিল্প বিশেষ না থাকলেও লোকায়ত শিল্পের চাহিদা ছিল প্রচুর এবং তার প্রসারও ঘটেছিল। কেবলমাত্র ধর্মীয় মূর্তিই নয়, আদি রসাত্মক মূর্তিও প্রচুর নির্মিত হত। এইকারণে শুক্রাচার্য ও মনু এইসব শিল্পের নিন্দা করেছিলেন। মনুর নির্দেশ ছিল গৃহস্থ যেন নাচ-গান থেকে বিরত থাকেন। কারণ নাচ-গানকে আশ্রয় করেই আদি রসাত্মক মূর্তি নির্মিত হয়।

বুদ্ধের এবং ব্রাহ্মণ্যধর্মের কোনো কোনো শাস্ত্রকারদের নিষেধের ফলে বুদ্ধে জীবিত কালে তো নয়ই, তাঁর মহানির্বাণের দীর্ঘকাল পড়ে সম্রাট অশোক প্রথম বুদ্ধের বাণী প্রচারের জন্য শিল্পকলাকে ব্যবহার করেন। নির্ভুল শারীর সংস্থান, বাস্তবতাবোধ থাকা সত্ত্বেও এইসময়ের মূর্তিগুলি আয়তনে বিশাল ও ভারী। মহেঞ্জোদাড়োর শিল্পধারায় বহুকাল ভারতীয় শিল্প ও শিল্পীর প্রেরণা জুগিয়ে এসেছিল। প্রাক্-মৌর্যযুগের শিল্পে এরই অভিব্যক্তি লক্ষ্য করা যায়। পারখাম মূর্তি, দিদারগঞ্জের নারীমূর্তি ও সিন্ধুর বেসনগরে যক্ষিণী মূর্তি এই তিনটিই নির্মাণশৈলীর দিক থেকে সিন্ধু শিল্পীদের ধারা বহন করে। তবে হেলেনিক ও পার্সিপোলীয় রীতির সঙ্গে তাদের পরিচয়ের প্রমাণও পাওয়া যায়।

আদিম যক্ষ ও যক্ষিণী মূর্তি

উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থানে—পাটলিপুত্রে, মথুরার গ্রামাঞ্চলে, বেসনগরে ও গোয়ালিয়রের নিকটবর্তী পাওয়াইয়া প্রভৃতি জনপদে খ্রিস্ট-জন্মের সমসাময়িককালের কয়েকটি যক্ষ ও যক্ষিণীর মূর্তি পাওয়া গেছে। এই মূর্তিগুলির নির্মাণকাল ও গঠনভঙ্গী নিয়ে অবশ্য পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অনেকে এগুলিকে আদিম গ্রাম্যদেবতা বলেই মনে করেন। মুর্তিগুলি মানুষের সমান উঁচু বা অনেকক্ষেত্রে তার চেয়েও বড়। দেহের গঠন অত্যন্ত ভারী ধরনের। স্থূল উদর, চওড়া বক্ষ, হাত-পায়ের গঠন মোটা মোটা, চোখের দৃষ্টি ‘ড্যাব-ডেবে’। গলায় মোটা কারুকার্যবিহীন মালা এবং কোমরে দৃঢ় কোমরবন্ধনী বা মেখলা। পাদপীঠের উপর মূর্তিগুলি সোজা দণ্ডায়মান থাকে। দাঁড়ানোর মধ্যে একটি কঠিন ছন্দ আছে, কমনীয়তা প্রায় নেই। এগুলির মধ্যে একটি দৈহির শক্তিমত্ত্বার ভাব বর্তমান।

দিদারগঞ্জের যক্ষিণী মূর্তি 

প্রাক্-মৌর্য যুগের যক্ষিণী মূর্তিগুলির একটি সুন্দর নিদর্শন পাওয়া গেছে পাটনার নিকটবর্তী দিদারগঞ্জে। এটি একটি চামরধারিণী নারীমূর্তি—‘দিদারগঞ্জের যক্ষিণী মূর্তি’ নামে এটি পরিচিত। বর্তমানে এটি পাটনা যাদুঘরের প্রবেশদ্বারের কাছে রাখা আছে। শিল্পগুণের দিক থেকে মূর্তিটি উন্নতমানের। চারদিক থেকে খোদাই করে এটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ ভাস্কর্যের রূপ দেওয়া হয়েছে। মূর্তিটির বাঁ হাত ভাঙা, মাথায় মুক্তোর অলঙ্কার, চুল পরিপাটি করে বাঁধা, কানে কানপাশা, ডানহাতে অনেকগুলি চুড়ি ও চামর। দেহের উপরিভাগ নগ্ন, কোমরে কারুকার্যখচিত মেঘলা, পরণে সূক্ষ্ম বস্ত্র, পায়ে মোটা নক্স। কাটা মল। সেযুগের নারীরা একখানি বস্ত্র পড়তেন ও অন্য একখানি বস্ত্রখণ্ড সামনের দিকে কোঁচার মত করে ঝুলিয়ে দিতেন। এই কারুকার্যখচিত কোঁচার সূক্ষ্ম ভাজই ছিল বিলাসিতা বা সৌখিনতার মাপকাঠি। এই অপূর্ব ও অতি মসৃণ মূর্তিটি সেযুগের নারী সৌন্দর্যের একটি নিখুঁত নিদর্শন হিসেবে ভারতীয় ভাস্কর্যের ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। 

বিভিন্ন প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থ, মহাভারত, বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ‘বিনয়পিটক’ ও জাতকের কাহিনীতে চিত্রকলার উল্লেখ থাকলেও প্রাক্-মৌর্যযুগের চিত্রের কোনো নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায় না। যোগীমারা গুহার কয়েকটি চিত্র খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে আঁকা হয়েছিল বলে পণ্ডিতগণ অনুমান করেন।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *