সাঁচীর স্তূপ সম্পর্কে টীকা লেখ।
সাঁচীতে ও তার নিকটবর্তী অঞ্চলে যে স্তূপগুলি আছে তার মধ্যে সাঁচী স্তূপ সর্ববৃহৎ। সাঁচীর নিকটবর্তী অন্যান্য স্তূপগুলিকে ‘ভিলসা স্তূপ সমুদয়’ নামে অভিহিত করা হয়। সাঁচীতে ১০ মাইল দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে ৬ মাইল সীমানার মধ্যে অবস্থিত অঞ্চলে পাঁচ-ছয় গুচ্ছ স্তূপ রয়েছে। এর মধ্যে ৬০টি স্তূপের অস্তিত্ব দেখা যায়। এদের অধিকাংশ অশোকের সমকালীন। কয়েকটি পরবর্তীকালের।
বিখ্যাত চিনদেশীয় পরিব্রাজক হিউয়েন সাং-এর ভ্রমণ-বৃত্তান্তে সাঁচী স্তূপের কোনো উল্লেখ নেই। ‘মহাবংশ’ গ্রন্থে একমাত্র সাঁচী স্তূপের উল্লেখ পাওয়া যায়। বুদ্ধের দেহাবশেষ নিয়ে যে আটটি স্তূপ নির্মিত হয় তার মধ্যেও সাঁচীর উল্লেখ নেই। কেউ কেউ মনে করেন, সাঁচী স্তূপ বুদ্ধের দেহাবশেষের উপর নির্মিত হয়নি। ফার্গুসন বলেছেন, অশোকের নির্মিত ৮৪,০০০ স্তূপের মধ্যে একটি ছিল সাঁচী স্তূপ। কিন্তু তখন ঐ অঞ্চলের নাম ছিল বিদিশা। বিদিশার স্তূপের বিবরণ অনেক ভ্রমণবৃত্তান্তে উল্লিখিত হয়েছে।
সাঁচীর বিখ্যাত বৌদ্ধস্তূপটির নির্মাণ অশোকের আমলে (আনুমানিক ২৭৩-২৩২ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দ) বলে ধরা হয়। তখন এটি আকারে ক্ষুদ্র ছিল এবং এটি ইট দ্বারা নির্মিত ছিল। পরে শুঙ্গ আমলে এর আকার দ্বিগুণ হয় এবং ইঁটের পরিবর্তে পাথর দ্বারা তা আবৃত করা হয়।
সাঁচীর সর্ববৃহৎ স্তূপটির ব্যস ১০৬ ফুট, উচ্চতা ৪২ ফুট। শীর্ষভাগ ক্রমে সূক্ষ্ম হয়ে যাওয়ায় ঐ স্থানের পরিসর মাত্র ৩৪ ফুট। এই স্তূপটিকে বলা হয় ‘কনক-হেড্ডা স্তূপ’। এর বেষ্টনীর ভগ্নাবশেষ অবশিষ্ট রয়েছে। পাথরের প্রাচীর বেষ্টিত স্তূপটির উপর কোনো উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্ম না থাকলেও এর চারটি তোরণ অপূর্ব ভাস্কর্যমন্ডিত। স্তূপটি নগ্ন; বিশালত্বই এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। তোরণের প্রবেশপথে স্তূপগাত্রে তথাগতের মূর্তি অঙ্কিত আছে। তোরণগুলি চতুষ্কোণ স্তম্ভের উপর নির্মিত। এর শীর্ষভাগে তিনটি আলঙ্করিক খিলান রয়েছে। অলঙ্কারবহুল খিলানগুলির একের উপর ব্যবধান রেখে অপরটি সন্নিবিষ্ট হয়েছে।
পশ্চিমদিকের তোরণের খিলানের মধ্যে বুদ্ধের সপ্তজন্মের সাতটি প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ আছে। প্রথম খিলানের এই বর্ণনার পর দ্বিতীয় বা মধ্য খিলানে মৃগদাবে বুদ্ধের উপদেশ দান কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। তৃতীয় বা সর্বনিম্ন খিলানের চিত্র বর্ণনাত্মক।
সাঁচী স্তূপে একটি বোধিবৃক্ষের সামনে বেদীকার উপর ছত্র স্থাপিত হয়েছে। এর পাশে বাদক ও ভক্তবৃন্দ আনন্দ উৎসবে মগ্ন। বিপরীত দিকে একটি হস্তী ও মার-পরাভব চিত্র উৎকীর্ণ আছে। এই তোরণটির উপরের খিলানটির নিম্নভাগে একসারি হস্তী এবং এর উপরে উৎকীণ স্তম্ভ ও সিংহমূর্তি সংযুক্ত হয়েছে। সাঁচী স্তূপের দক্ষিণ তোরণের কাছে একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত আলোকস্তম্ভ রয়েছে। দক্ষিণ তোরণের উপর হিন্দুদের মহালক্ষ্মী মূর্তির মত একটি মূর্তি স্থাপিত আছে, যাকে বৌদ্ধরা মায়াদেবীর মূর্তি বলে থাকেন। এই তোরণটিও অলঙ্কারবহুল। সাঁচী স্তূপের পূর্বদিকের তোরণটিও বহু অলঙ্কারশোভিত। উত্তরদিকের তোরণটিতে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট শিল্পনৈপুণ্য লক্ষ্য করা যায়। এর উর্ধ্বভাগের ধর্মচক্রটির অর্ধাংশ ভেঙে গেলেও মূল রূপটির সৌন্দর্য অনুভব করা যায়। এর নিম্নভাগের প্রথম খিলানটিতে বৃক্ষতলে উপদেশদানরত বুদ্ধ ছাড়াও নভোমণ্ডলে বিচরণশীল বুদ্ধমূর্তি উৎকীর্ণ হয়েছে। দ্বিতীয় খিলানে তথাগতকে মর্কটরাজের মধুপূর্ণ পাত্র প্রদানের দৃশ্য রয়েছে। বুদ্ধের জন্মগ্রহণের কাহিনীর প্রতীক পদ্ম, গৃহত্যাগের প্রতীক ছত্রশোভিত অশ্ব, বুদ্ধত্বলাভের প্রতীক বোধিবৃক্ষ এখানে প্রকাশ করা হয়েছে। ধর্ম ব্যাখ্যা, প্রতীক ধর্মচক্র এবং জাতক কাহিনীর কিছু চিত্রও এখানে উৎকীর্ণ আছে।
সাঁচীর প্রধান স্তূপের অনতিদূরে ক্ষুদ্রাকার দ্বিতীয় স্তূপটির মধ্যে সারিপুত্ত ও মহামৌদগল্যায়নের পুতাস্থিরক্ষিত ছিল। এই স্তূপের খানিকটা দূরে এর সমতলের উপর তৃতীয় স্তূপটি অবস্থিত। এর প্রস্তর প্রাচীর অদ্ভূত জীবজন্তর চিত্রে অলঙ্কৃত। দুটি স্তূপেরই একটি করে তোরণ বা প্রবেশ পথ ছিল।
সাঁচীর স্তূপগুলি পোড়া ইঁটে নির্মিত—কাদামাটির সাহায্যে ইট সংযুক্ত করার পর বৃষ্টির জল থেকে রক্ষা করতে এর বাইরের দিক ছাঁট পাথরে মুড়ে দেওয়া হয়। পাথরের আবরণীর উপরে চুনের সঙ্গে কোনো ভারী মশলা যুক্ত করে সিমেন্টের প্লাস্টার করা হয়। এই ভারী আস্তরণের উপর বুদ্ধের জীবনকাহিনী উৎকীর্ণ হয়েছে। স্তূপটি প্রদক্ষিণ করার জন্য উপরের দিকের পরিসর কমিয়ে স্তূপের
গায়ে একটি ‘প্রদক্ষিণ পথ’ নির্মাণ করা হয়। নীচেও একটি ‘প্রদক্ষিণ পথ’ নির্মাণ করা হয়েছিল। ‘হর্মিকা’শূণ্যগর্ভ; এর আকৃতি একটি চতুস্কোন পেটিকার মত। এর মুখ তিনখন্ড প্রস্তরে আচ্ছাদিত ছিল এবং এর মধ্যে দেহাবশেষ বা পবিত্র বস্তু রক্ষিত ছিল।
সাঁচীর রেলিং বা বেষ্টনীগুলি প্রস্তরনির্মিত, কিন্তু এর ছাঁচ দারুশিল্পের মত। বেষ্টনীগুলির কাঠামো সর্বত্র একইভাবে পরিকল্পিত হয়নি। ‘প্রদক্ষিণ পথ’-কে বেষ্টন করে রেলিংগুলির বাইরের দিকটি ডিম্বাকার রূপ নিয়েছে। দু’ফুট ব্যবধান রেখে রেলিংগুলি করা হয়েছে। স্তম্ভগুলির উচ্চতা ৮ ফুট। এগুলির গায়ে একাধিক রেলিং প্রবেশ করার জন্য গর্ত করা হয়েছে। আশোক সম্ভবত দারুশিল্পীদের মধ্যে থেকে এই প্রস্তরশিল্পীদের নির্বাচন করেছিলেন। ২ নং স্তূপের উপর উৎকীর্ণ লিপি থেকে জানা যায়, এই স্তূপটি অশোকের পূর্ববর্তী সময়ে নির্মিত হয়। প্রায় ১০০ বছর ধরে এর নির্মাণ চলে। এর দক্ষিণ তোরণের উপর খোদিত লিপিতে আছে যে, অন্ধ্র দেশের রাজা সাতকর্ণী (খ্রিস্ট-পূর্ব ১৫৫ অব্দ) এটি নির্মাণ করেন। দক্ষিণ কোণটি সর্বপ্রাচীন। তবে সাঁচীর তোরণগুলিকে ‘ভারতের প্রাচীনতম তোরণ’ বলে মনে করা হয় না। প্রধান স্তূপের তোরণের চেয়ে ছোট স্তূপদুটির তোরণ ক্ষুদ্রাকৃতি হলেও শিল্পকর্মের দিক থেকে উভয়েই সমশ্রেণির। সাঁচীতে এই তিনটি স্তূপ ব্যতীত আরও পাঁচ-ছয়টি স্তূপের ধ্বংসাবশেষ এখনও টিকে আছে। ফার্গুসন এইসব স্তূপগুলির বেষ্টনী শিল্পকর্মের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
মূল্যায়ন :
এ. এল. ব্যাসান মন্তব্য করেছেন—সাঁচীর শিল্পী তথা ভাস্করদের সৃষ্টিধর্মী কাজ দেখে বোঝা যায়, তাঁরা শিল্পের মাধ্যম ও হাতিয়ারকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হন। সাঁচীর ভাস্কর্যে ছিল ভারতের তুলনায় জীবন্ত এবং প্রথম থেকেই বলিষ্ঠরূপে প্রতীয়মান।