সমকালীন আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে বিশ্ব ব্যাংকের ভূমিকা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্রেটন উডস সম্মেলনে (১৯৪৪) আন্তর্জাতিক মুদ্রাভান্ডার স্থাপনের প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক পুনর্গঠন ও উন্নয়ন বিষয়ক আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্ক (International Bank for Reconstruction and Development / IBRD) স্থাপনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯৪৬ সালের জুন মাসে আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্ক বিশ্বব্যাঙ্ক নামে তার পথ চলা শুরু করে আন্তর্জাতিক মুদ্রভান্ডারের সহায়ক ও পরিপুরক প্রতিষ্ঠান হিসাবে।
মুদ্রাভান্ডারের প্রতিটি সদস্যই বিশ্বব্যাঙ্কের সদস্য হয়। ১৯৭৯ সালে বিশ্বব্যাঙ্কের সদস্য ছিল ১৩৮ টি দেশ (সোভিয়েত রাশিয়া ও চীন সদস্য ছিলনা)। আন্তর্জাতিক মুদ্র ভান্ডারের মত বিশ্বব্যাঙ্কের সদস্য রাষ্ট্রগুলিরও কোটা নির্দিষ্ট রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোটা যেখানে এক তৃতীয়াংশের উপর সেখানে ভারতের কোটা এক পঞ্চমাংশের কম। ১৯৭৯ পর্যন্ত বিশ্বব্যাঙ্কের মোট মূলধনের পরিমাণ ছিল ৪৩৮৯.৭ কোটি ডলারের উপর।
একাধিক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বিশ্বব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধজনিত কারণে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত ও বিশ্বস্ত দেশগুলিতে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন এবং বিকাশমান দেশগুলিতে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাহায্য প্রদান ছিল এই ব্যাঙ্কের প্রাথমিক উদ্দেশ্য এইজন্য এই ব্যাঙ্কটিকে পুনর্গঠন ও উন্নয়ন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্ক রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। ২) বিশ্বব্যাঙ্কের অন্যতম প্রধান কাজ বেসরকারী বিদেশী বিনিযোগে উৎসাহ দান করা গ্যারেন্টি দিয়ে বা নিজস্ব অর্থে ঋন দিয়ে বিশ্বব্যাঙ্ক উৎপাদনশীল ক্ষেত্রে মূলধন বিনিযোগে উৎসাহ দেয়। ৩) সদস্য দেশগুলির উৎপাদনক্ষমতা বিকাশের জন্য আন্তর্জাতিক বিনিযোগেও বিশ্বব্যাঙ্ক উৎসাহ দেয় যাতে করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে দীর্ঘকালীন ভারসাম্য রক্ষিত হয়।
কার্যাবলী:
বিশ্বব্যাঙ্কের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে ঋন প্রদান করা। সাধারণভাবে ৩৫ বছরের জন্য ঋন দেওয়া হয়, প্রয়োজনে এই মেয়াদ আরও দশ বছর বাড়ানোর নিয়মও রয়েছে। এছাড়াও বিশ্বব্যাঙ্ক ঋনের জামিনদারও হয় বা অন্য কোন সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত ঋল যথেষ্ট না হলে বিশ্বব্যাঙ্ক তা পূরণ করার চেষ্টা করে। বিশ্বব্যাঙ্ক সদস্য দেশের কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারকেও ঋন দেয় এবং প্রকল্পভিত্তিক বৈদেশিক মুদ্রা প্রদান করে।
সরকারের আয়ত্তাধীন পরিবহন ও বৈদ্যুতিন শিল্প এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর উন্নয়নেও ব্যাঙ্ক ঋন দেয়। সাম্প্রতিককালে কৃষির প্রসার, বন্যা নিয়ন্ত্রন, মৎস্যচাষ, পানীয় জল সরবরাহ, পয়ঃপ্রণালী নির্মাণ ইত্যাদি জনকল্যানমূলক প্রকল্পেও বিশ্বব্যাঙ্ক অর্থসাহায্য করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ১৯৮৬ সালে প্রদত্ত বিশ্বব্যাঙ্ক বাৎসরিক রিপোর্ট অনুসারে ঐ বছর পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন প্রকল্পে বিশ্বব্যাঙ্ক ২৪.৫ বিলিয়ান মার্কিন ডলার অর্থ লগ্নি করেছিল।
১৯৭০ এর দশকের গোড়ার দিকের বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের প্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাঙ্ক কৃষি ও গ্রামীন পরিকাঠামো উন্নয়নে মনোনিবেশ করে। ১৯৭৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাঙ্কের কৃষি উন্নয়ন সংক্রান্ত বিনিয়োগ বার্ষিক ১.৪ বিলয়ন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায় যা বিশ্বব্যাঙ্কের সামগ্রক বিনিযোগ বা ঋনদানের প্রায় ২০%।
বিশ্বব্যাঙ্কের ঋনদান ও বিনিযোগ প্রকল্পের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বীজ, সার এবং জনের অধিক কার্যকরী ব্যবহার, সেচব্যবস্থার প্রসার (যা এশিয়ায় ধানের উৎপাদন বাড়িয়েছিল), মার উৎপাদন শিল্প প্রতিষ্ঠা (বিশ্বব্যাংক এই বিষয়ে সর্বাধিক অর্থ ঋন দিয়েছিল), গ্রামীন রাস্তাঘাট নির্মাণ ও বৈদ্যুতীকরণ, ইত্যাদি। ভারতে কৃষি বিষয়ক অভিজ্ঞতা আদান প্রদান করে ১ কোটি কৃষক উপকৃত হয়, বিশ্বব্যাঙ্কের ঋন সহজেই কৃষককূলের হাতে পৌঁছে যায়। কেনিয়াতে ক্ষুদ্র চা প্রকল্পগুলি উপকৃত হয়, মেক্সিকোতে গ্রামীন বৈদ্যুতীকরণ, সেচের প্রসারের ফলে ৩০ টি জনপদের ৭৫০০০ স্বল্প উপার্জনকারী গ্রামীন পরিবার উপকৃত হয়। সমসাময়িক বিশ্বের অতি গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা পরিবেশ সংরক্ষণ।
এই বিষয়েও বিশ্বব্যাঙ্ক সমর্থক ভূমিকা পালন করছে এবং উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলির পরিবেশসচেতনতার প্রশ্নে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করছে। ১৯৮৯ সালের পর থেকে বিশ্বব্যাঙ্ক যে কোন প্রকল্পে ঋন বা অর্থ মঞ্জুরের পূর্বে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাবের বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। এছাড়াও পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক প্রকল্পেও বিশ্বব্যাঙ্ক তাদের ঋন প্রদান করছে বা অন্যভাবে অর্থ সাহায্য করছে।
১৯৯০ এর দশকে মাঝামাঝি বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে আর্থিক বৈষম্যকে দূর করার লক্ষ্যে বিশ্বব্যাঙ্ক Highly indebted poor Countries’ নামক একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ১৯৯৬ সালে গৃহীত এই পরিকল্পনায় বিশ্বব্যাঙ্কের সভাপতি জেমস উলফেনসন জানিয়েছেন যে বিশ্বব্যাঙ্ক এতদিন পর্যন্ত ঋণ মকুবের ক্ষেত্রে যে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করত, ১৯৯৬ সালে এই পরিকল্পনা গ্রহণের পর থেকে আর তা করবে না।
কিন্তু ঋণমকুবের কঠিন শর্ত পূরণ না করতে পারার কারণে (ঝন: রফতানি ১০০:২২০ বা ঋন: সরকারী রাজস্ব (১০০:২৮০) প্রথম তিন বছরে মাত্র সাতটি দেশ সামগ্রিকভাবে ১০ বিলিয়ান ডলার ঋণমকুবের সুবিধা পায়। বাধ্য হয়ে ১৯৯৯ সোলে কালোন শহরে ধনী রাষ্ট্রসমূহের উদ্যোগে ‘The Enhanced HIPC Debt Relief Initiative’ প্রকল্প ঘোষিত হয়, বিশ্বব্যাঙ্কের ভাষায় এর উদ্দেশ্যে ‘deeper, breader and faster relief”।
দূর্ভাগ্যবশত আজও আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলি স্বাস্থ্য ও শিক্ষাথাতে যা ব্যয় করে তার থেকে অনেক বেশী ব্যয় করে বিশ্বব্যাঙ্কের ঋন পরিশোধে বিশ্বব্যাঙ্কের কঠোর আমলাতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় ঋনের শৃঙ্খলা মোচন যে অতি দুঃসহ তা ঋনগ্রহণকারী দরিদ্র রাষ্ট্রগুলি অতি সহজেই অনুধাক করছে। বস্তুতপক্ষে আন্তর্জাতিক মুদ্রাভান্ডারের মতই বিশ্বব্যাঙ্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা ইওরোপের ধনী রাষ্ট্রগুলি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত দরিদ্র ও অভাবী দক্ষিণ গোলার্ধের রাষ্ট্রগুলির আর্থিক বিকাশের সম্পূর্ণ দায়ভার তাই কখনোই বিশ্বব্যাঙ্কের মত ঋনদানকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বহন করবে না এবং এটাই বাস্তব।