টাক এবং ছড়ি রহস্য
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
_ গল্প
কাকতালীয় যোগ
সেদিন সকালে আমার প্রাজ্ঞ বন্ধু স্বনামধন্য কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের ডেরায় ঢুকে আমি অবাক। একটি ছোট্ট ডিমালো আয়না মুখের ওপর তুলে উনি নিজের বিশাল টাকটি খুঁটিয়ে দেখছেন। বললেন, “এসো ডার্লিং। তোমার কথাই ভাবছিলুম।’
বললাম, টাকের সঙ্গে
সম্পর্ক?’
আমার কী
‘আছে।’ কর্নেল আয়নাটি টেবিলে রেখে একটু হাসলেন। ‘কারণ একটি বিজ্ঞাপন। যেটি তোমাদেরই দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় সম্প্রতি বেরিয়েছে। পড়ে দেখতে পার।’
উনি একটা বিজ্ঞাপনের কাটিং এগিয়ে দিলেন। পড়ে দেখি বেশ মজার একটা পদ্য।
টাক। টাক!! টাক!!!
ট্রাই ইয়োর লাক
যদি থাকে দাড়ি
সুফল তাড়াতাড়ি
ইন্দ্রোদ্ধার, দৈব চিকিৎসালয়
১১১/১পি খাঁদু মিস্তিরি লেন
কলকাতা-১৩ বি.দ্র. – আগে টাক পরীক্ষা করিয়ে তবে ভরতি। ২৪ ঘণ্টা সময় লাগবে।
দরাদরি নিষিদ্ধ। বললুম, ইন্দ্রোদ্ধারটা বোঝা যাচ্ছে না তো??
কর্নেল বললেন, ‘ইন্দ্ৰ মানে কালো চুল। তাই আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে টাক পড়াকে ইন্দ্ৰলুপ্ত বলা হয়।”
“কিন্তু হঠাৎ টাক নিয়ে আপনি চিন্তিত কেন? এতদিন তো টাককে জ্ঞানী ও
দার্শনিকের লক্ষণ বলে খুব গালভরা বুলি আওড়েছেন। আজ আবার
‘কাক!’ কর্নেল বিমর্ষমুখে বললেন। ‘কাকের অত্যাচারে, জয়ন্ত! টাকের সঙ্গে
কাকেরও গূঢ় সম্পর্ক আছে।’ ষষ্ঠীচরণ ট্রেতে কফি আনছিল। কথাটা শুনে গম্ভীর মুখে বলল, এতবার করে মনে পড়িয়ে দিই, ছাদে যাবার সময় কেপ পরে যান। বাবুমশাই তবু কথাটা কানে করবেন না। কাকের দোষটা কী?’
কর্নেল চোখ কটমটিয়ে তাকালে ষষ্ঠী ট্রে রেখে কেটে পড়ল। ব্যাপারটা বুঝতে পারলুম। ছাদের বাগানে গিয়ে আবার কাকের ঠোকর খেয়েছেন। তবে বাগান না বলে জঙ্গল বলাই ভালো। যত রাজ্যের বিদঘুটে গড়নের ক্যাকটাস, ‘উভুট্টে সব অর্কিড আর দুর্লভ প্রজাপতির ঝোপঝাড়। পাশের বাড়ির গা-ঘেঁষে ওঠা বুড়ো নিম গাছটা সম্ভবত কলকাতার কাকদের রাজধানী। তাড়ানোর জন্যে একবার পটকা ছুড়ে নাকি মামলা বাধার উপক্রম হয়েছিল। কফিতে চুমুক দিয়ে বললুম, ‘ষষ্ঠী ঠিক বলেছে। আপনার টাককে কাকেরা পাকা বেল-টেল ভাবে। অবশ্য বেল পাকলে কাকের কী বলে একটা কথা চালু আছে।’
কর্নেল কফির সঙ্গে চুরুটও টানেন। জ্বেলে নিয়ে ধোঁয়ার ভেতর বললেন, “বেল কেন? তালের সঙ্গেও কাকের সম্পর্ক জুড়ে দিয়ে একটা কথা চালু আছে।’
ঝটপট বললুম, ‘জানি। কাকতালীয় যোগ। কাক এসে তাল গাছে বসল, সেই মুহূর্তে একটা পাকা তাল খসে পড়ল। নিছক আকস্মিক যোগাযোগ। লোকে যদি ভাবে কাকের সঙ্গে তাল পড়ার সম্পর্ক আছে, তাহলে এটা বোকামি।’ ‘ডার্লিং, প্রাচীন ন্যায়শাস্ত্রে কাকতালীয় ন্যায় নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা আছে।’
কর্নেল সায় দেবার ভঙ্গিতে বললেন। ‘যাই হোক, বিজ্ঞাপনটা দেখা অবধি মন ঠিক করতে পারছি না। কী করি তুমিই বলো!’ ‘যদি থাকে দাড়ি/সুফল তাড়াতাড়ি। আপনার দাড়ি আছে। অতএব ট্রাই ইয়োর লাক।’
‘তাহলে চলো। কফিটা শেষ করে এখনই বেরিয়ে পড়া যাক।’ বেরিয়ে পড়া গেল না। কারণ কলিং বেল বাজল এবং আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই এক ভদ্রলোক আমাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে ঢুকে ধপাস করে সোফায় বসে পড়লেন। তারপর দু-হাতে মাথার চুল—কালো কোঁকড়া একরাশ চুল আঁকড়ে ধরে আর্তনাদের সুরে বলে উঠলেন, ‘ওঃ টাক। হায় রে টাক।
কর্নেল হাঁ। আমিও হাঁ। তবে এটুকু বুঝলুম। এই হল কাকতালীয় যোগ। একেবারে হাতেনাতে আর কি।…
টাক নিয়ে দুর্বিপাক
গরম কফি খাইয়ে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ভদ্রলোককে শান্ত-সুস্থ করা হল। তাঁর নাম মুরারিমোহন ধাড়া। ষাটের ওধারে বয়স। ঢ্যাঙা, রোগা গড়ন। বেজায় লম্বা নাক। মুখে গোঁফ-দাড়ি নেই। তবে মাথার চুল দেখার মতো—উজ্জ্বল কালো, মাঝখানে সিঁথি। পরনে ধুতি ও তাঁতের ছাইরঙা পাঞ্জাবি। পায়ে যেমন-তেমন একটি চটি। আর হাতে একটা ছড়ি। ছড়িটি কিন্তু সুন্দর
মুরারিবাবু যা বললেন, তা সংক্ষেপে এই :
দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় এই বিজ্ঞাপন দেখে গতকাল ইন্দ্রোদ্ধার দৈব চিকিৎসালয়ে যান। একটা ঘিঞ্জি গলির ভিতর জরাজীর্ণ বাড়ি। কোনো ব্যবসায়ীর গুদাম বলে মনে হয়েছে। দোতলায় অ্যাজবেস্টসের ছাউনি দেওয়া ঘরের মাথায় নতুন সাইনবোর্ড ছিল। বেঁটে, হোঁতকা-মোটা, গোলগাল চেহারার ডাক্তারবাবুটি অবশ্য খুবই অমায়িক। উঁচু বেডে শুইয়ে মুরারিবাবুর টাক পরীক্ষা করে বলেন, ‘ঠিক আছে। চলবে। তবে দাড়ি কামাতে হবে।’ মুরারীবাবুর তাতে আপত্তি ছিল না। ডাক্তারবাবু নিজেই যত্ন করে দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে দেন। তারপর বলেন, ‘চোখ বুজুন।’ মুরারিবাবু চোখ বোজেন। এরপর কী হয়েছে তাঁর জানা নেই। একসময় চোখ খুলে দেখেন, ঘরে আলো জ্বলছে। কেউ কোথাও নেই। উঠে বসেই সব মনে পড়ে। মাথায় হাত দিয়ে টের পান, টাক নেই, সারা মাথা চুলে ভরতি। খুশি হয়ে ডাক্তারবাবুকে ডাকাডাকি করেন। সাড়া না পেয়ে অবাক হন। ঘোরালো কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসেন অগত্যা। এই হল রহস্যের প্রথম পর্ব।
দ্বিতীয় পর্ব কিন্তু মারাত্মক। মুরারিবাবু কলকাতায় সবে এসেছেন। রেলে চাকরি করতেন। পাটনায় থাকার সময় রিটায়ার করেছেন। কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে কলকাতার লেক প্লেসে বহু টাকা সেলামি দিয়ে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করেছিলেন। দিন পাঁচেক আগে জিনিসপত্র নিয়ে উঠেছেন। একা মানুষ। স্বাবলম্বী। স্বপাক খান। গতকাল সন্ধ্যায় মাথার চুল গজানোর পর নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকতে গিয়ে দেখেন, অন্য কে একজন ঢুকে বসে আছে। কতকটা তাঁর মতোই চেহারা ও গড়ন। মাথায় টাক, মুখে দাড়িও আছে। মুরারিবাবুকে দেখে সে বলে, ‘কাকে চাই?’ মুরারিবাবু ভড়কে যান। তারপর হইচই বাধান। অন্যান্য ফ্ল্যাটের লোকেরা এসে পড়ে। তারা একবাক্যে রায় দেয়, এই কালো চুলের মুরারিবাবুকে তারা চেনে না। এমনকী ওপরতলা থেকে বাড়ির মালিক এসে পর্যন্ত শাসিয়ে বলেন, পুলিশ ডাকা হবে। বেগতিক দেখে মুরারিবাবু চলে আসেন। রাত্তিরটা হোটেলে কাটিয়ে এখন কর্নেলের শরণাপন্ন হয়েছেন। থানায় যাননি, তার কারণ তিনি এখন কীভাবে প্রমাণ করবেন যে তিনিই আসল মুরারিমোহন ধাড়া? কলকাতায় তাঁর আত্মীয়স্বজন দূরের কথা, চেনা লোকও নেই। থাকলেও কালো কোঁকড়া চুল গজিয়ে তাঁর চেহারাকে একেবারে বদলে দিয়েছে যে!
আর একটু রহস্য আছে। কর্নেলের কাছে আসার পথে ইন্দ্রোদ্ধার দৈব চিকিৎসালয়ে গিয়েছিলেন, টাক পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় তো বটেই, কিন্তু গিয়ে দেখেন, ঘরে তালা। সাইনবোর্ড নেই। খোঁজ করলে কেউ কিছু বলতে পারল না। কর্নেলের কীর্তিকাহিনি মুরারিবাবু খবরের কাগজে পড়েছেন। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা থেকেই তাঁর ঠিকানা জোগাড় করেছেন। এই দুর্বিপাক থেকে তিনি ছাড়া আর কেউ তাঁকে উদ্ধার করতে পারবেন না বলে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস।
ছড়ি বদল পর্ব
ঘটনাটি শোনার পর গোয়েন্দাপ্রবর মন্তব্য করলেন, হুঁ, টাকের আমি, টাকের তুমি, টাক দিয়ে যায় চেনা।”
বললুম, ‘উহু, গোঁফ। সুকুমার রায়ের ‘গোঁফচুরি’ পদ্যে আছে।’ কর্নেল হাসলেন। ‘যাই হোক, এক্ষেত্রে টাকচুরি নিয়েই সমস্যা বেধেছে।’ বলে মুরারিবাবুর দিকে তাকালেন। ‘মুরারিবাবু, সেল্ফ-আইডেন্টিটি ব্যাপারটা সত্যিই গুরুতর। আমিই যে আমি, আপনি মুরারিবাবুই যে মুরারিবাবু, কোনো কোনো সময়ে প্রমাণ করা কঠিন হয়। তবে এ জন্য আদালত আছে।’
মুরারিবাবু করুণ স্বরে বললেন, ‘আছে। আদালতে তো যেতেই হবে। রেলের কর্তারা এবং আমার কলিগরা আছেন। নানা জায়গায় আমার আত্মীয়স্বজন আছেন। টেলিগ্রাম-ট্রাংকল করে সবাইকে ডাকব। ব্যারিস্টারের কাছে যাব। সবই করব। কিন্তু সে তো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু ইতিমধ্যেই যে সর্বনাশ হবার তা হতে চলেছে। কারণ স্পষ্ট বুঝতে পারছি, বিজ্ঞাপন দিয়ে চক্রান্ত করে কেউ বা কারা আমার ফ্ল্যাটে ঢুকতে চেয়েছিল, এবং ঢুকে পড়েছে। কেন এ চক্রান্ত, কেন আমার ফ্ল্যাটে ঢুকেছে, সেটা নিয়েই আপাতত দুর্ভাবনা।
‘কেন?” কর্নেল সোজা হয়ে বসলেন। রহস্যের গন্ধটা এবার ঝাঁঝালো তো বটেই।
মুরারিবাবু চাপাস্বরে বললেন, ‘হিরে। একটা-দুটো নয়, তিন-তিনটে হিরে। দাম এ-বাজারে কমপক্ষে দেড় লাখ টাকা। কর্নেল নড়ে বসলেন। ‘কোথায় রেখেছেন হিরেগুলো??
মুরারিবাবু তাঁর কালো রঙের ছড়িটা দেখিয়ে বললেন, ‘অবিকল এইরকম একটা ছড়ির ভেতরে। মাথাটায় প্যাচ আছে। সেজন্য ছড়িটা সব সময় হাতে রাখতুম। কাল বিজ্ঞাপনটা দেখেই তাড়াহুড়ো করে বেরোতে গিয়ে ছড়িটা নিতে ভুলে গিয়েছিলুম। বুঝলেন না? টাক পড়া অব্দি কলিগরা তো বটেই, যে দেখত ঠাট্টাতামাশা করত। বেজায় বিদঘুটে টাক কিনা। আপনার টাক অবশ্য মানানসই। তো
কর্নেল ওঁর কথার ওপর বললেন, ‘এই ছড়িটা নতুন কিনেছেন, আসার
পথে?’
“ঠিক ধরেছেন। নিউ মার্কেটের ওখান থেকে কিনে আনলুম।’ মুরারিবাবু ছড়িটা এগিয়ে দিলেন। ফিসফিস করে বললেন, ‘ওরা হিরেগুলো খুঁজে হন্যে হচ্ছে। পাবে না। তবে বলা যায় না কিছু। যদি দৈবাৎ ছড়িটার বাঁট খুলে ফেলে—তার আগেই দয়া করে আমাকে সাহায্য করুন। আপনার হাতে ধরে বলছি কর্নেল স্যার। আপনি সব পারেন। কোনো ছুতো করে এই ছড়ি হাতে আমার ফ্ল্যাটে গিয়ে আপনি আগে ঢুকুন। আলাপ জুড়ে দিন। তারপর আপনার এই অ্যাসিস্ট্যান্ট ভদ্রলোক গিয়ে কলিং বেল টিপবেন।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, ‘জয়ন্ত আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট নয়। খবরের কাগজের রিপোর্টার।
মুরারিবাবু সঙ্গেসঙ্গে আমাকে নমস্কার করে বলল, ‘তাই বলুন! কাগজে কর্নেলের কীর্তিকলাপ তো আপনিই লেখেন। দারুণ আপনার লেখার হাত, মশাই!’ বলে ফের ফিসফিসিয়ে উঠলেন। ‘তাহলে তো আরও চাল। রিপোর্টার যেতেই পারে ওখানে। কারণ একটা বিচিত্র ঘটনা ঘটেছে। কে প্রকৃত মুরারিমোহন ধাড়া এই নিয়ে অন্তর্তদন্ত করা খুবই স্বাভাবিক। কর্নেল স্যার যাওয়ার মিনিট কতক পরে জয়ন্তবাবু যাবেন। জাল মুরারি তত্ত্ব করবে দরজায় দাঁড়িয়ে। সেই ফাঁকে কর্নেল স্যার দেওয়ালের ব্র্যাকেটে-ঝোলানো ছড়িটা হাতিয়ে এই ছড়িটা রাখবেন। ব্যাটা টেরই পাবে না। বাকিটা সহজ।”
ছড়িটা কর্নেল নিলেন। তারপর কুণ্ঠিতভাবে বললেন, ‘যদি কিছু মনে না করেন, আপনার চুল গজানোটা একটু দেখতে চাই।’ মুরারিবাবু মাথা বাড়িয়ে বললেন, ‘আলবাত দেখবেন। দেখুন। মিরাকল বলা যায়।’
কর্নেল একটুখানি হেসেই বললেন, ‘সত্যিই মিরাকল। ভেবেছিলুম, আঠা দিয়ে পরচুলা পরিয়েছে নাকি। তা নয়। প্রকৃত চুল। ঠিক আছে আপনি সন্ধ্যা ছ-টা নাগাদ আসুন।’ মুরারিবাবু আশ্বস্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন। একটু পরে কর্নেল বললেন, ‘তুমি
সম্ভবত কী জিজ্ঞেস করার জন্য উশখুশ করছিলে, ডার্লিং।’
উত্তেজনা নিশ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে গেল। বললুম, ‘ছড়ি বদলানোটা রিস্কি হবে
না? যদি দৈবাৎ—’
কথা কেড়ে কর্নেল বললেন, ‘রিস্ক না নিলে রহস্য ভেদ করা তো সৎ করা তো সম্ভব হয়। না ডার্লিং।’
“কখন বেরোবেন ভাবছেন??
কর্নেল চোখ বুজে দুলতে দুলতে এবং অভ্যাসে সাদা দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, যাবার সময় তোমার আপিস হয়ে তোমাকে ডেকে নেবখন।’
হুঁকো বিষয়ক প্রবাদ
দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার আপিসে অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছি, কর্নেলের পাত্তা নেই। দুটোয় ফোন করলুম, ষষ্ঠী বলল, ‘বাবামশাই তো লাঞ্চো খেয়েই বেইরেছেন।’ তিনটে বাজল। চারটে বাজল। পাঁচটায় উদবিগ্ন হয়ে বেরিয়ে পড়ার আগে আবার ফোন করলুম, ষষ্ঠী ফোন ধরে বলল, ‘বাবামশাই এই মাত্তর ফিরেছেন। ছাদে গেছেন! কেপ পরেই গেছেন। বুঝলেন না কাগুজে দাদাবাবু? কাক—কাক।’ রাগে-অভিমানে ফোন রেখে ভাবলুম, ‘এর অর্থ কী?’ আমাকে নিয়ে বেরোনোর কথা। অথচ একা বেরিয়েছিলেন। হলটা কী?
যখন কর্নেলের তিন তলার অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছোলুম, তখন প্রায় পাঁচটা বাজে। রাস্তায় যা জ্যাম। সটান ছাদে ওঁর ‘প্ল্যান্ট ওয়ার্ল্ডে’ চলে গেলুম। দেখলুম, একটা বিদঘুটে ক্যাকটাসের দিকে ঝুঁকে আছেন প্রকৃতিবিদ। মাথায় সত্যিই ‘কেপ’। কাছে গিয়ে বললুম, ‘আশ্চর্য মানুষ আপনি!’
কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। মুচকি হেসে বললেন, ‘আমার চেয়েও আশ্চর্য মানুষ
বিস্তর আছে, ডার্লিং। চলো নীচে যাই। মুরারিবাবুর আসার সময় হয়েছে।’
‘আপনি গিয়েছিলেন ওঁর ফ্ল্যাটে? কী দেখলেন? ছড়িটা বদলাতে পারলেন?’ ইউ। আসলে জয়ন্ত, টাক ও দাড়ির সঙ্গে টাক ও দাড়ির বন্ধুত্ব খুব ঝটপট গড়ে ওঠে। এটা বরাবর দেখে আসছি।’
নীচের ড্রয়িং রুমে ঢুকে কর্নেল বাথরুমে গেলেন গার্ডেনিং-এর জোব্বা বদলে হাত ধুতে! শুনলুম গলা চড়িয়ে ষষ্ঠীকে কড়া কফির হুকুম জারি করেছেন। এই সময় কলিং বেল বাজল। দরজা খুলে দিলুম। হন্তদন্ত হয়ে ঢুকে পড়লেন মুরারিমোহন ধাড়া। দম আটকানো গলায় বললেন, “গিয়েছিলেন? কাজ হয়েছে তো?’
কর্নেল পর্দা তুলে বললেন, ‘বসুন, আসছি।’ তারপর অদৃশ্য হয়ে গেলেন। মুরারিবাবু সোফায় বসে উদবিগ্ন মুখে বললেন, ‘আমার ঠাকুরদার কেনা হিরে, জয়ন্তবাবু। এক সায়েব দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল মাইনিং বিজনেসে। ঠাকুরদাকে মাত্র দেড় হাজারে বেচেছিল। তা সেসব কথা পরে বলবখন। বলুন, খবর কী? আমার
হার্ট ধুকপুক করছে খালি।’ বুকে হাত দিলেন মুরারিবাবু। কর্নেল সেইরকম একটি ছড়ি হাতে ফিরে এলেন। মুরারিবাবু খপ করে সেটি প্রায় কেড়ে নিয়ে বাঁটের প্যাঁচ ঘোরাতে শুরু করলেন। খিখি হেসে বললেন, ‘জ্যাম
হয়ে গেছে প্যাঁচ। বহুকাল খোলা হয়নি কিনা।” কর্নেল চোখ বুজে দুলতে দুলতে বললেন, ‘আগে একটু কফি খান পাঁচুবাবু!
তারপর কথা হবে।’ মুরারিবাবু চমকে উঠলেন। ‘পাঁচুবাবু! ও কী বলছেন কর্নেল স্যার? আমার না
কর্নেল চোখ বুজেই বললেন, ‘প্যাঁচ খুলবে না পাঁচুবাবু। কারণ ওটা আপনার
কেনা সেই ছড়িটাই।
মুরারিবাবু কিংবা পাঁচুবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘কী অদ্ভুত রসিকতা!” ‘রসিকতা আপনারও কম নয়, পাঁচুবাবু?’ কর্নেল চোখ খুলে ফিক করে হাসলেন। ‘আপনি আমার হাত দিয়ে আপনার মনিব মুরারিবাবুর হিরে চুরি করতে চেয়েছিলেন। একেই গ্রাম্য প্রবাদে বলে, অন্যের হাতে হুঁকো খাওয়া।”
‘মুরারিবাবু’ কিংবা ‘পাঁচুবাবু’ দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই পাশের ঘরের অন্য দরজার পর্দা তুলে এক পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোক বেরোলেন। ঢ্যাঙা, মাথায় টাক, মুখে দাড়ি। তিনি ‘তবে রে ব্যাটা পেঁচো।’ বলে গর্জন করে ঝাঁপ দিলেন এবং ‘পাঁচুবাবু’র পাঞ্জাবির কলার খামচে ধরলেন। তারপর একই দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলেন এক পুলিশ অফিসার এবং দু-জন সেপাই। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ব্যাপারটা ঘটে গেল। আমি হাঁ। তক্ষুনি দলটা বেরিয়ে গেলে ঘুরে কর্নেলের দিকে তাকালুম। স্বপ্ন না, সত্যি?
কর্নেল চোখ বুজে দুলতে শুরু করেছেন ফের। বললেন, হুঁ, একেই বলে পরের হাতে হুঁকো খাওয়া। মাঝখান থেকে পাঁচুবাবুর বিজ্ঞাপন-খরচটা গচ্চা গেল। লম্বা-চওড়া একটা গুলগল্প ও কাজে এল না। ডার্লিং তোমার অবশ্য একটা বড়ো লাভ হল। বড়োবাজারের শিশি-বোতলের কারবারি মুরারিমোহন ধাড়ার কর্মচারী পাঁচু বা পঞ্চানন্দকে নিয়ে কাগজে দারুণ খবর হবে।…