StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

খাই খাই বুড়ো

 

খাই খাই বুড়ো

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ 

_(গল্প)

 

সেই আজব রাজ্যের সুখের কথা কী বলব, এমন সুখশান্তি পৃথিবী খুঁজলে কোথাও তুমি দেখতে পাবে না। সেখানে মাঠভরা সোনার ফসল, গাছভরা মিঠে ফল, আর শহরে-বাজারে, দোকানপাটে থরে থরে সাজানো কতরকম সুন্দর জিনিস। কারও কোনো অভাব নেই। সবাই সুখী। তাই চোর-ডাকাত নেই। খুনোখুনি নেই। তা ছাড়া পশুপাখিরা সেখানে মানুষকে ভয় করে না। ফুলে ফুলে আলো সে রাজ্যের বাগিচাগুলো। প্রজাপতি ওড়ে। পাখি ডাকে। লোকেরা মনের আনন্দে গান গায়, আর যে-যার কাজ করে। তারপর রাত হলে নাক ডাকিয়ে ঘুমোয়।

হঠাৎ একদিন সেই সুখের রাজ্যে এক অবাক কাণ্ড দেখা গেল।

রান্না করে বউ-ঝিরা নাইতে গেছে ঘাটে। ফিরে এসে দেখে, সব খাবার কে

চেটেপুটে খেয়ে ফেলেছে। ফলের বাগানে গাছভরা ফল ছিল। হঠাৎ কখন সব ফল উধাও। চাষিরা মাঠে ফসল লাগিয়েছিল। সেই ফসল আর দেখা না।

আর সে-রাজ্যের রাজার ছিল ঘোড়াশালে ঘোড়া, হাতিশালে হাতি। সকালে আস্তাবলে এসে ঘোড়ার সহিস আর হাতির মাহুতের চোখ কপালে উঠেছে। কী

সর্বনাশ! গেল কোথায় সব?

তারপর দিনে দিনে আরও আজগুবি ঘটনা ঘটতে লাগল… কোথাও একটুখানি খাবার মতো জিনিস নেই। ঘরে ঘরে উপোস চলল। রাজার কাছে নালিশ গেল। রাজা কোতোয়ালকে ধমকে বললেন, “যেমন করে হোক, এই আজব কাণ্ডের বিহিত করো। নইলে গর্দান যাবে।

কোতোয়াল পাহারা দেয়। কিন্তু কোনো ফল হয় না। এমনকী, শেষে দেখা গেল সবুজ পাতাগুলি নেই, ঘাস নেই – সব রুক্ষ ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছে। আর প্রজাপতি দেখা যায় না। পাখি নেই। জন্তুজানোয়ার বলতে কিছু নেই। তারপর একটা-দুটো করে জ্যান্ত মানুষও উধাও হয়ে যাচ্ছে। দেশটা একেবারে শ্মশানের মতন দেখাচ্ছে। তখন কোতোয়াল রাজার সামনে এসে বলল, ‘মহারাজ, নির্ঘাত কোনো মায়াবী রাক্ষসের কাণ্ড। মায়াবলে অদৃশ্য হয়ে সব কিছু খেয়ে ফেলছে। হয়তো এরপর সব

জীবিত প্রাণী ও উদ্ভিদ খাওয়া শেষ হলে আস্ত ঘরবাড়িগুলো খেয়ে ফেলবে। তার

চেয়ে বরং আমরাই এখুনি কেটে পড়ি চলুন।’

রাজা মন্ত্রীকে বললেন, সর্বনাশ! একটা উপায় বের করো তো মন্ত্রী। মন্ত্রী মাথা চুলকে বলল, ‘উপায় আর কী মহারাজ। কোতোয়াল যা বলছে, তাই করা যাক। চলুন, সরে পড়ি। প্রাণে বাঁচলে ফের একটা রাজ্য মিলতে পারে। সেনাপতি আছে, তার কোমরে তলোয়ার আছে— তখন সে ভাবনা নেই। কী বল সেনাপতি?’

সেনাপতি সায় দিয়ে তলোয়ার ঘুরিয়ে বলল, আমিও তাই বলছি মহারাজ।’ ব্যাস রাতারাতি রাজা মন্ত্রী সেনাপতি কোতোয়াল আর যারা যারা বেঁচে ছিল, দল বেঁধে পালাল রাজ্য ছেড়ে। রাজ্যে তখন সত্যি সত্যি শ্মশানদশা। খাঁ-খাঁ নিঝুম পুরী। একটুও সবুজ রং নেই কোথাও। শুধু ঘরবাড়িগুলিই যা রইল…

কিন্তু না, সবাই পালাল বলছি বটে, একজন থেকে গেল চুপিচুপি। এক সুন্দর ছেলে। এই রাজ্যের প্রতিটি জিনিসের উপর ছিল তার ভালোবাসা। এর মাঠ, নদী, বন, গাছপালা, ফুল, পাখি, প্রজাপতিদের সে ভালোবাসত। সে তাই এই শ্মশান রাজ্য ছেড়ে কোথায়ও যেতে চাইল না। সে অবাক হয়ে খুঁজতে বের হল, কে সেই অদৃশ্য রাক্ষস? কেন সে সব কিছু খেয়ে ফেলল এমনি করে?

মাটিতে ঘাস গজায় না। গাছে গজায় না পাতা। নদীর জল গেছে শুকিয়ে। আর সে সেই শূন্য বুক্ষ মরুভূমির মতো মাটিতে ক্লান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায়। আজব রাক্ষস কিন্তু তাকে খায় না। হয়তো মজা দেখে। অতটুকু একটা বাচ্চা ছেলে। রাক্ষুসে মুখে বড়ো জোর একটা খুদে রসগোল্লা বই তো আর নয়।

কিন্তু রাক্ষুসে লোভ যাবে কোথায়? একদিন সে আর থাকতে পারল না। সামনে এসে দাঁড়াল। গর্জে উঠল, ‘হাঁউ মাঁউ খাউ ছেলেটি কিন্তু ভয় পাবে কী, ওকে দেখে হেসেই খুন।

রাক্ষস চোখ কটমট করে বলল, ‘হাসছ যে? ভয় হচ্ছে না আমায় দেখে?? ছেলেটি জবাব দিল, ‘হাসব না কেন? আরে, তুমি যে দেখছি মানুষের মতো। ‘মানুষের মতো?’ রাক্ষস একেবারে অবাক।

“হ্যাঁ, তোমায় কেমন দেখাচ্ছে জান? অবিকল একটা বুড়ো মানুষ। রোসো,

তোমার নাম দিলুম, খাই খাই বুড়ো। খুশি তো?? রেগে-মেগে রাক্ষস ওকে হালুম করে গিলে ফেলল। কিন্তু কী মুশকিল! ছেলেটি পেটের ভিতর এমন লাফালাফি শুরু করে যে, সে ওয়াক করে উগরে দিতে বাধ্য হয়। ফের অবশ্য গিলে নেয়। ছেলেটি নাকের ভিতর অ্যায়সা সুড়সুড়ি দেয় যে, সে হেঁচে ফেলে, ‘হ্যাঁচ্ছো’। ছেলেটি ডিগবাজি খেয়ে বেরিয়ে পড়ে, হাততালি দিয়ে হাসে।

• অগত্যা বেচারা হার মেনে বলল, “ওফ! কী সর্বনেশে ছেলে রে বাবা! ঠিক

আছে। তোমায় ছেড়ে দিলুম।’

ছেলেটি বলল, ‘না খাই খাই বুড়ো, সেটি হচ্ছে না। আমি কিন্তু তোমায় ছাড়ছি

না।

রাক্ষস চোখ পাকিয়ে বলল, “ছাড়ছি না মানে? যাও বকবক কোরো না আর। আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে। দেখি, অন্য কোথাও যাই। এখানে তো আর খাবার মতো কিছু নেই।’

ছেলেটি বলল, ‘তোমার খুব খিদে পেয়েছে বুঝি?? “ওঃ! ভীষণ খিদে। দিন-রাত্তির পেটটা শুধু খাই খাই করে। ওই তো হল

জ্বালা… • রাক্ষস দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চিন্তিত মুখে ছেলেটি বলল, ‘তাই তো! খাই খাই বুড়ো, তোমার সত্যি কোনো দোষ নেই বাপু। এত খিদে থাকলে তুমি আর কী করবে বলো। তবে যদি একটা কাজ

কর, এত খিদে তোমার থাকবে না –আর রাজ্য শ্মশান হবে না। করবে?’

খাই খাই বুড়ো আর ছেলেটি তখন হনহন করে হাঁটতে থাকল। মাঠ নদী বন জঙ্গল পেরিয়ে সে আর এক রাজ্য। সেখানে একটা পাহাড়ের চুড়োয় ঘর। ছেলেটি নাম তার উপোসি বলল, ‘খাই খাই বুড়ো, এই ঘরে যে থাকে সে তোমার মিতে— বুড়ো। বেচারা কিস্যু খেতে পারে না! শুকিয়ে আমশি হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। কত কবরেজ বদ্যি করল, কোনো ফল হয়নি। ওর খিদেই পায় না।

খাই খাই বুড়ো মহানন্দে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল, ‘মিতে, ওহে উপোসি মিতে! উপোসি বুড়ো রোগাপটকা গতর নিয়ে বেরিয়ে অতি কষ্টে বলল, ‘কে

রে?’ ‘আহা, কাছে এসেই দেখো, কে এসেছে।’ বলে ছেলেটি উপোসি বুড়োকে টানতে টানতে খাই খাই বুড়োর সামনে নিয়ে গেল।

কী তাজ্জব কাণ্ড! দুই বুড়ো যেই না কাছাকাছি হয়েছে, ছেলেটি দু-জনের পিছনে দুটো ধাক্কা লাগাতেই ব্যাস। দুই বুড়ো একাকার—একসঙ্গে মিলেমিশে

একজন।

তার ফলাফল কী হল বলব?

বলে আর লাভ নেই। নিজেই বুঝে নাও না। আর যদি অগত্যা বুঝতে না পার, অঙ্ক কষে দেখো প্ল্যাসকে মাইনাস দিয়ে

গুণ করলে কী হয়? স্রেফ মাইনাস।

তাহলে বুঝতে পারছ, ফের গাছভরা ফুলফল, পশুপাখি, প্রজাপতি আর খেতভরা ফসল, থরে থরে সাজানো দোকানপাট, মানুষ নির্ভয়ে সুখশান্তিতে বাঁচছে। ছেলেটি কে চিনতে পারছ না? আরে, সে তো তুমিই।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top