ম্যাজিশিয়ান মামা
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
– গল্প
টুকাই তার বন্ধু কুটুসের কাছ থেকে একটা ভূতের গল্পের বই পড়তে নিয়েছিল। সারা বিকেল খেলার মাঠের শেষদিকটায় নিরিবিলি ঝিলের ধারে বসে বইটা যখন শেষ করে ফেলল, তখন দিনের আলো ফুরিয়ে এসেছে। খেলুড়েরা কখন চলে গেছে খেলা শেষ করে। ঝিলের ঘাটে যে ধোপা কাপড় কেচে শুকোতে দিয়েছিল, সেও তার গাধাটার পিঠে কাপড়ের বোঁচকা চাপিয়ে চলে যাচ্ছে। টুকাইয়ের এবার গা ছমছম করছিল। সে উঠে পড়ল।
কুটুসের কাছে অনেক ভূতের গল্প বই আছে। টুকাই ভাবল, বইটা ফেরত দিয়ে আরেকটা চেয়ে নেবে। কিন্তু এসব বই পড়ে এই সন্ধ্যে বেলা বড্ড ভয় করে যে। কুটুসদের বাড়িটা আবার নিরালা জায়গায় শহরের একপাশে। পেছনে একটা কলকারখানাও আছে সায়েবি আমলের। কুটুস সায়েবভূতগুলোর কত গল্প না শুনিয়েছে।
দোনামনা করে টুকাই এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে খেলার মাঠ পেরিয়ে
রাস্তায় পৌঁছোল। রাস্তার আলো জ্বলে উঠেছে। লোকজন হাঁটাচলা করছে।
টুকাইয়ের ভয়টা চলে গেল তাই দেখে। সে কুটুসদের বাড়ির দিকে চলতে থাকল।
কুটুসদের বাড়িটা পুরোনো হলেও বেশ সুন্দর। সামনে এক টুকরো ফুলবাগান আছে। গেটের মাথায় বুগানভিলিয়া ফুলের ঝাঁপি আছে। সন্ধ্যার দিকে কেমন একটা মিঠে গন্ধ মউমউ করে। কিন্তু বাড়ির সামনে গিয়েই টুকাই একটু অবাক হল।
বাড়িতে আলো জ্বলছে না। কুটুসরা নেই নাকি? টুকাই গেট দিয়ে উঁকি মেরে
আস্তে ডাকল, ‘কুটুস!’ অমনি অন্ধকার বারান্দা থেকে কেউ ভারী গলায় বলে উঠল,
“কে রে?’
তাহলে বাড়িতে লোক আছে। গলাটাও যেন চেনা লাগছে। টুকাই বলল, “আমি।”
“আমি? আমি কী হে? আমি কি কারুর নাম হয় নাকি?? টুকাই ধমক খেয়ে হকচকিয়ে বলল, ‘আমি টুকাই।’
টুকাই? সে আবার কে? কই, সামনে এসো তো দেখি।’
টুকাই ভয়ে ভয়ে গেট খুলে ভেতরে গেল। রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট থেকে তেরচা হয়ে ফিকে হলদে রঙের একটুখানি আলো বারান্দায় গিয়ে পড়েছে। সেই আলোয় টুকাই এতক্ষণে দেখতে পেল। কুটুসের সেই ম্যাজিশিয়ান মামা বেতের চেয়ারে বসে আছেন।
অমনি সে খুশিতে নেচে উঠল। ভয়টুকু আর রইল না। কুটুসের এই মামা
নামকরা ম্যাজিশিয়ান। মাঝে মাঝে বেড়াতে আসেন এখানে। কুটুসের বন্ধুদের কত
মজার ম্যাজিক দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেন।
কিন্তু কুটুস তো বলেনি ওর ম্যাজিশিয়ান মামা এসেছেন। টুকাই মনে মনে কুট্টুসের ওপর রেগে গেল। ম্যাজিশিয়ান মামা ফের ধমক দিয়ে বললেন, ‘কী হল? অমন করে দাঁড়িয়ে আছ যে বড়ো? কাছে এসো, দেখি তুমি কে?’
টুকাই হাসিমুখে বারান্দায় উঠে বলল, ‘আমি টুকাই ম্যাজিশিয়ান মামা। আমাকে চিনতে পারছেন না।’ তারপর টিপ করে পায়ে একটা প্রণামও করে ফেলল। ম্যাজিশিয়ান মামা খুশি হয়ে বললেন, হ্যাঁ মনে পড়েছে বটে। তুমি টুকাই।
টুকাই বলল, ‘কখন এলেন ম্যাজিশিয়ান মামা। কুটুস তো আমাকে বলেনি।’ ‘বলবার সময় পেলে তো!’ ম্যাজিশিয়ান মামা বললেন। ‘আমিও এলুম, ওরাও বাড়িসুদ্ধ গেল কোন বিয়েবাড়ি নেমন্তন্ন খেতে। তাই একা একা পাহারা দিচ্ছি। তা তোমায় পেয়ে ভালোই হল। কথাবার্তা বলা যাবে।’
টুকাই বলল, ‘ম্যাজিক দেখাতে হবে কিন্তু ম্যাজিশিয়ান মামা।’
‘দেখাব, দেখাব।’ ম্যাজিশিয়ান মামা একটু হাসলেন, “তোমাদের ম্যাজিক দেখিয়ে বড়ো আনন্দ পাই, কিন্তু দেখছ তো, বাড়িতে কারেন্ট নেই–লোড শেডিং। ওই দেখো, সব বাড়িতে আছে। শুধু এই বাড়িটা বাদে। ভারি অদ্ভুত মনে হচ্ছে না তোমার??
টুকাই দেখে নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ ম্যাজিশিয়ান মামা।’
‘তা যাক গে। অন্ধকারই ভালো। বুঝলে? অন্ধকার আমি খুব পছন্দ করি।’ টুকাই সায় দিয়ে বলল, ‘আমিও পছন্দ করি ম্যাজিশিয়ান মামা।’ ‘কর বুঝি? তুমি খুব ভালো ছেলে।’ ম্যাজিশিয়ান মামা বললেন, ‘তা তোমার হাতে ওটা কী??
‘একটা ভূতের গল্পের বই, ম্যাজিশিয়ান মামা। কুটুসকে ফেরত দিতে এলুম।’
“অ্যা! ভূতের গল্পের বই? কই, দেখি, দেখি।’
ম্যাজিশিয়ান মামা বইটা টুকাইয়ের হাত থেকে টেনে নিলেন। টুকাই খিটখিট করে হেসে বলল, ‘অন্ধকারে দেখবেন কী করে?’ আমি অন্ধকারেও দেখতে পাই। বুঝলে তো?” টুকাই ভাবল, ম্যাজিশিয়ানরা কত অদ্ভুত অদ্ভুত ম্যাজিক দেখাতে পারেন। তা
ছাড়া চোখে রুমাল বেঁধে থটরিডিংয়ের খেলাও যখন দেখান, তখন অন্ধকারে বই
পড়াটা কী এমন কঠিন ওঁদের পক্ষে। সে অবাক চোখে ম্যাজিশিয়ান মামার দিকে
তাকিয়ে রইল। এও একটা দারুণ ম্যাজিক বই কী।
ম্যাজিশিয়ান মামার চেহারা এতক্ষণে আবছা দেখা যাচ্ছে। প্রকাণ্ড মানুষ। মাথায় টাক আছে। পরনে সেই বরাবর দেখা পাঞ্জাবির ওপর নকশাদার কালো জহরকোট। সেই পেল্লায় গোঁফ। উনি বইটা উলটে পালটে দেখে বললেন, ‘ভূতের ছবিও আছে দেখছি। কিন্তু দেখো বাপু, যে এই ছবি এঁকেছে, সে কস্মিনকালে ভূত কেন, ভূতের টিকিও দেখেনি। ছ্যাঁ হ্যাঁ। ভূতের চেহারা কি এমন বিচ্ছিরি হয়??
টুকাই হাসতে হাসতে বলল, ‘কেমন হয় ম্যাজিশিয়ান মামা?’
‘দেখবে নাকি?’
হুই
“কিন্তু এই অন্ধকারে দেখবে কী করে? একটা মোমবাতি চাই যে। চলো, ভেতরে গিয়ে খুঁজে দেখি।’
ঘরে ঢুকে ম্যাজিশিয়ান মামা অন্ধকারে খোঁজাখুঁজি করে মোমবাতি জোগাড়
করলেন। এটা ওঁর পক্ষে কঠিন কাজ নয়, টুকাই জানে। সে বলল, ‘ম্যাজিশিয়ান
মামা, দেশলাইকাঠি ছাড়া মোম জ্বালাতে পারেন না ম্যাজিক দিয়ে?
‘পারি বই কী।’ বলে ম্যাজিশিয়ান মামা ফুঁ দিলেন। আর অবাক কাণ্ড, মোমবাতি দপ করে জ্বলে উঠল। টুকাই খুব হাসতে লাগল মজা পেয়ে। ম্যাজিশিয়ান মামার কত মজার মজার ম্যাজিক সে দেখেছে, এমন ম্যাজিক দেখেনি তো।
টুকাই মনে করিয়ে দিল, ‘ম্যাজিশিয়ান মামা, এবার ভূতের চেহারা দেখব।’ ভূতের চেহারা—তোমায় বললুম না? কখনো এই বইয়ে আঁকা ছবির মতো বিচ্ছিরি হয় না।”
‘কেমন হয়?’
‘এই তোমার—আমার মতো।
টুকাই মাথা নেড়ে বলল, ‘উঁহু। তাহলে সবাই ভূতকে ভয় করে কেন শুনি?? ‘বোকারাই ভয় পায়।’ মোমবাতিটা টেবিলে আটকে দিয়ে ম্যাজিশিয়ান মামা
চেয়ারে বসলেন। ‘তুমি যদি বোকা হও, তুমিও ভয় পাবে। তুমি কি বোকা?? টুকাই, আরও জোরে মাথা নাড়ল। ম্যাজিশিয়ান মামা বললেন, ‘ভূতের চেহারা ভদ্রলোকের মতো। যেমন ধরো
আমি…’
কথা কেড়ে টুকাই হাসতে হাসতে বলল, ‘যাঃ। আপনি কি ভূত নাকি?’
‘কে বলতে পারে? এই যে নিঝুম সন্ধ্যা বেলা তুমি এই অন্ধকার বাড়িটাতে এলে—কে বলতে পারে তুমি ভূত না মানুষ! টুকাই হেসে অস্থির হল। ম্যাজিশিয়ান মামা খুব আমুদে মানুষ, তা সে বরাবর
দেখছে। বলল, ‘আচ্ছা ম্যাজিশিয়ান মামা ভূতরা নাকি ম্যাজিক দেখাতে পারে??
ইউ। খুব পারে। তবে ভূতের ম্যাজিক তো। আরও অদ্ভুত। দেখবে নাকি??
বলে ম্যাজিশিয়ান মামা প্যাচালো নাট থেকে বল্টু খোলার মতো নিজের প্রকাণ্ড
মাথাটা কয়েক পাক ঘুরিয়ে দিলেন। অমনি তাঁর মুণ্ডু বাঁই বাঁই করে ঘুরতে থাকল।
টুকাই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছিল। এতক্ষণে তার গা ছমছম করতে লাগল।
চোখদুটো বড়ো হয়ে উঠল। এ যে বড়ো সাংঘাতিক ম্যাজিক।
ম্যাজিশিয়ান মামার মুণ্ডুর ঘূর্ণি থামল। তখন চোখ নাচিয়ে বললেন, ‘কেমন ম্যাজিক? এর নাম হল মুণ্ডুনৃত্য। এবার এইটে দেখ। এ অমার নতুন ম্যাজিক। এর নাম হল জ্বলন্ত মোমবাতি ভক্ষণ।’
এবার উনি আস্ত মোমবাতি মুখে পুরে কোঁত করে গিলে ফেললেন। ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। টুকাই ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ম্যাজিশিয়ান মামা! ম্যাজিশিয়ান মামা!’
মোমবাতিটা হঠাৎ ম্যাজিশিয়ান মামার টাক ফুঁড়ে বেরোল। ঘর আলোকিত হল আগের মতো। উনি ফিক করে হেসে বললেন, ভয় পেয়েছিলে বুঝি? এটা তত কিছু ভয়ের না। তবে এই তিন নম্বর খেলাটা।….
টুকাই চেঁচিয়ে উঠল ফের, আর না। আর না।’ তারপর সটান দরজা দিয়ে ছিটকে বেরোল এবং বারান্দা থেকে এক লাফে নেমে গেট পেরিয়ে দৌড় দৌড় দৌড়! এ কখনো ম্যাজিক নয়। এ যে বড্ড ভূতুড়ে কাণ্ডকারখানা! মুণ্ডুনৃত্য, জ্বলন্ত মোমবাতি ভক্ষণ। তারপর তিন নম্বরটা হয়তো টুকাই ভক্ষণ। বাপস রে!…
পরদিন স্কুলে কুটুসের সঙ্গে দেখা। কুটুসকে কিছু বলার আগেই সে চোখ পাকিয়ে তেড়ে এল। টুকাই। আর কখনো তোকে বই দেব না। অমন করে জানলা গলিয়ে বইটা ছুড়ে ফেলে এসেছিস। মলাট ছিঁড়ে কী অবস্থা হয়েছে দেখেছিস?’ টুকাই কাঁচুমাচু মুখে বলল, ‘যাঃ! ছুড়ে দিয়ে আসব কেন? বইটা তো তোর
ম্যাজিশিয়ান মামাকে দিয়ে এসেছিলুম। উনিই দেখতে নিলেন যে।’ কুটুস আরও খাপ্পা হয়ে বলল, ‘চালাকির জায়গা পাসনি? ওঁকে কোথায় পেলি? ম্যাজিশিয়ান মামা তো আমেরিকায় ম্যাজিক দেখাতে গেছেন। এখন সানফ্রান্সিসকোতে ম্যাজিক দেখাচ্ছেন। কাগজে ছবি বেরিয়েছে না?
টুকাই ঢোক গিলে বলল, ‘তাহলে কাল সন্ধ্যে বেলা তোদের বাড়ি কাকে
দেখলুম রে!’ কুটুস ঘুসি পাকিয়ে বলল, ‘ফের চালাকি?’
টুকাই চুপচাপ কেটে পড়ল তার সামনে থেকে। হুঁ, খুব বেঁচে গেছে কাল সন্ধ্যে বেলা। তবে দোষ তো কুটুসদেরই। কবরখানার কাছে বাড়ি খালি রেখে অমন করে নেমন্তন্ন খেতে যায় কেউ?