বকুল গাছের লোকটা
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
– গল্প
এ আমার ছেলেবেলার কাহিনি। ইচ্ছে হলে বিশ্বাস না করতেও পার কেউ। কিন্তু সত্যি ঘটেছিল।
এক শীতের সকালে পুবের বারান্দায় ঝলমলে রোদ্দুর খেলছে। আমি আর আমার বোন ইলু শতরঞ্চি পেতে বসে খুব চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়া মুখস্থ করছি। ক-দিন বাদেই বার্ষিক পরীক্ষা কিনা! তার ওপর মেজোকাকা বলে দিয়েছেন, ‘যত জোরে চেঁচিয়ে পড়া মুখস্থ করবি, তত ভালো রেজাল্ট হবে।’ ইলু তো গলা ভেঙে ফেলল উৎসাহের চোটে। কিছুক্ষণ পরে শুনি, ফ্যাঁসফ্যাঁস আওয়াজ বেরোচ্ছে বেচারির গলা থেকে। সে মাঝে মাঝে বই থেকে মুখ তুলে করুণ চোখে তাকিয়ে যেন মেজোকাকাকেই খুঁজছে।
মেজোকাকার পাত্তা নেই। আমি বললুম, ‘ইলু, বরং জল খেয়ে আয়!? ইলু ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, ‘যদি মেজোকাকু এসে পড়েন!?
“তুই ঝটপট খেয়ে আয় গে না! আমি বলব মা ইলুকে ডেকেছেন।’ এই শুনে ইলু জল খেতে গেল ভেতরে। আমি আবার চেঁচিয়ে পড়তে শুরু করেছি, মোগল সম্রাট আকবর… মোগল সম্রাট আকবর…’, সেই সময় কোত্থেকে হেঁড়ে গলায় কে বলে উঠল, ‘কী পড়া হচ্ছে খোকাবাবু?’
আমাদের বাড়ির এদিকটায় বাগান। বাগানের ওপাশে ধান খেত। সবে পাকা ধান কেটে নিয়েছে চাষিরা। সেদিকে দূরে ঘন নীল কুয়াশা ভাসছে, যেন বুড়ো মাঠ আলোয়ান গায়ে দিয়ে এখন ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে আছে। বারান্দা থেকে কয়েক মিটার তফাতে আছে একটা ঝাঁকড়া বকুল গাছ। মনে হল, আওয়াজটা এসেছে ওই গাছ থেকেই। তাই মুখ তুলে হাঁ করে তাকিয়ে আছি। খুঁজছি কে কথা বলল।
হঠাৎ দেখি, বকুল গাছ থেকে হনুমানের মতো ধুপ করে নীচে লাফিয়ে পড়ল একটা বেঁটে নাদুসনুদুস গড়নের লোক। হাঁটু অব্দি পরা ধুতি, খালি গা, কুচকুচে কালো রং। বুকের ওপর দিয়ে একটা পইতে ঝুলছে। তার মাথার কাঁচা পাকা চুলগুলো ছোটো করে ছাঁটা, খোঁচা খোঁচা হয়ে আছে। টিকিতে ফুল গোঁজা। তার গোঁফগুলো সেইরকম বিচ্ছিরি। হাতে একটা হুঁকোও আছে। পায়ে খড়ম আছে। সে আমার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হাসল। তারপর এগিয়ে আসতে লাগল। আমি তো অবাক। হাঁ করে তাকিয়ে আছি। নাকে ভুরভুর করে তামাকের মিঠে গন্ধ ভেসে আসছে। আমাদের পাঠশালার পণ্ডিতমশাই ঠিক এমন সুগন্ধি তামাক খেতেন।
কিন্তু বকুল গাছে এমন হুঁকো-খাওয়া বিদঘুটে চেহারার লোক থাকাটা যদি-বা মেনে নেওয়া যায়, তার এভাবে পড়া ডিসটার্ব করতে আসাটা মোটেও উচিত হয়নি। মেজোকাকা থাকলে নিশ্চয় আপত্তি করতেন।
সে হুঁকোয় গুড়ুক গুড়ুক আওয়াজ করে টান দিতে দিতে আমার একটু তফাতে পা ঝুলিয়ে বসল। তারপর হুঁকো নামিয়ে বাঁ-হাতে ধরে রেখে বলল, ‘কী? ওটা কী পড়া হচ্ছে?’
গম্ভীর মুখে জবাব দিলুম, ইতিহাস।’
এই শুনে সে খিক খিক করে হেসে উঠল, ইতিহাস? সে আবার কেমন হাঁস খোকা? এ্যা? ঢের ঢের হাঁসের নাম শুনেছি। ইতিহাঁস নামে কোনো হাঁসের কথা তো শুনিনি!’ কী বোকা লোক রে বাবা! হাসি পেল। বললুম, ‘না, না। হাঁস নয়।
ইতিহাস।’ লোকটা বলল, ‘সেই তো বলছি গো! পাতিহাঁস, এলেহাঁস, বেলেহাঁস, জলহাঁস, রাজহাঁস, বুনোহাঁস… কতরকম হাঁস আছে। তা সেসব ছেড়ে ওই উদ্ভুটে ইতিহাঁস
নিয়ে পড়াটা সুবিধের নয়। বরং ওই যে কী বলে পাতালহাঁস—নাকি হাঁসপাতাল—সেটাও মন্দ নয়।’ এবার একটু রাগ হল। বললুম, ‘তুমি কিস্যু বোঝ না!’
“বুঝি না? আমি বুঝি না?? লোকটাও চটে গিয়ে মুখখানা তুম্বো করে ফেলল। “আমি বুঝি না তো কে বোঝে শুনি? কোথায় থাকে তোমার ইতিহাস??
বইয়ের পাতা দেখিয়ে বললুম, ‘এই তো এখানে থাকে।’ সে আবার ফিক করে হাসল।— ‘ওই শুকনো খসখসে বইয়ের পাতায় ইতিহাস থাকে? বলছ কী খোকা! খায় কী? এখানে তো দেখছি জল-টল একফোঁটা নেই। সাঁতার কাটছেই-বা কেমন করে??
বুঝলুম, বকুল গাছের এই হুঁকোখোর লোকটা একটি মুখ্যু। লেখাপড়াই জানে না। তাই ওকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেবার জন্য বললুম, ইতিহাস নয়, ইতিহাস। এর মানে কী জান??
সে আপত্তি করে বলল, ‘আমাকে মানে বোঝাতে এসো না। বিস্তর হাঁস দেখে দেখে বুড়ো হয়ে গেলুম। দিনে-রেতে ঝাঁকে ঝাঁকে ডানা শনশন করে কত হাঁস আসছে যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে। কতরকম গানও গায় তারা, জান? শোনো।’ বলে সে হেঁড়ে গলায় গুনগুন করে গেয়ে উঠল:
“তেপান্তরের মধ্যিখানে
মস্ত একটা বিল আছে। কলমিদামে শালুক পানায় কত যে ফুল ফুটতাছে শামুক বুড়ো চিংড়িবুড়ি বড়ো সুখে রোদ পোহায় কে যাবি ভাই আয় রে সাথে
শনশনিয়ে আয় রে আয়…
গানটা কেমন ঘুম ঘুম সুরে ভরা। শুনতে শুনতে হাই ওঠে। ঢুলুনি চাপে। শীতের লম্বা রাতে বেজায় লম্বা ঘুমের পর এই মিঠে রোদের সক্কাল বেলা আবার ঘুমিয়ে পড়াটা বিপজ্জনক। মেজোকাকা এসে টের পেলেই চুল খামচে ধরবেন।
গান শেষ করে লোকটা চোখ নাচিয়ে বলল, ‘দারুণ গান। তাই না?’ বলে সে আবার গুড়ুক গুড়ুক আওয়াজ করে হুঁকো টানতে থাকল।
আমি ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে বললুম, ‘গানটা ভালো লাগল। তবে বড্ড ঘুম পায় যে। ওগো লোকটা, তুমি বরং রাতে শোবার সময় এসো। এখন যাও। পড়া ডিসটার্ব কোরো না। মেজোকাকা বকবেন।’
“কে তোমার মেজোকাকা? ঢ্যাঙা রোগামতো ছোকরাটা বুঝি?
‘চুপ। ও কথা বোলো না। মেজোকাকাকে রোগা বললে আগুন হয়ে ওঠেন। মেজোকাকার একটা কুকুর আছে, জান তো? তার নাম কালু। কালুকে …’ এ পর্যন্ত শুনেই লোকটা যেন চমকে উঠল। চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কালু এখন বাড়িতে আছে নাকি?’
বললুম, ‘মনে হচ্ছে না। থাকলে এতক্ষণ তোমাকে… ওরে বাবা! বোলো না বোলো না!
ওকে ভয় পেতে দেখে খুব মজা লাগল। বললুম, ‘তাই তো বলছি, পড়ায় ডিসটার্ব না করে তুমি কেটে পড়ো। এক্ষুনি কালু এসে পড়তে পারে। বোধ হয় মেজোকাকার সঙ্গে পাড়াবেড়াতে বেরিয়েছে।’
লোকটা উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, ‘তাহলে আসি। আমার কথা কাকেও বোলো না যেন। পরে সময়মতো এসে তোমাকে আরও হাঁসের গান শোনাব। ইচ্ছে করলে দেখতে যেতেও পার হাঁসেরা কোথায় থাকে! কিন্তু তাই বলে সেখানে তোমার ওই ইতিহাস দেখতে পাবে ভেবো না! তোমার পড়ার বইতে মিথ্যে লিখেছে! বরং ওই যে কী বলে পাতালহাঁস বা হাঁসপাতাল সত্যি হলেও হতে পারে।’
এই বলে সে খড়ম পায়ে চাপা খট খট শব্দ তুলে বকুল গাছে দিব্যি চড়ে গেল এবং ঝাঁকড়া ডালপালার মধ্যে অদৃশ্য হল। আমি অবাক হয়ে বসে রইলুম। আমাদের বাগানের বকুল গাছটাতে এমন কেউ থাকে তা তো শুনিনি। বাবা মা মেজোকাকা সেজোকাকা ছোটোকাকা কেউই বলেননি।
ইলু এতক্ষণে এসে ফ্যাসফেঁসে গলায় বলল, ‘কী রে বিলু? কী দেখছিস অমন করে? সেই লেজঝোলা পাখিটা?’
উঁহু, বকুল গাছের লোকটা পইপই করে বারণ করেছে। কাকেও ওর কথা
বলব না। ‘কী রে বিলু? বলছিস না যে! বারবার জিজ্ঞেস করতে আমার কষ্ট হচ্ছে না বুঝি??
ইলুকে পাত্তা না দিয়ে আবার পড়া শুরু করলুম: ‘মোগল সম্রাট আকবর… মোগল সম্রাট আকবর… ইতিহাস না— পাতিহাঁস এলেহাঁস বেলেহাঁস রাজহাঁস পুষতে ভালোবাসতেন। তাই তিনি…. ইলু অবাক হয়ে বলল, ‘কী পড়ছিস রে? দাঁড়া, মেজোকাকু আসুক।….
বকুল গাছের লোকটার কথা আমি কাকেও বলিনি। সেই যে ওর সঙ্গে আমার আলাপ হয়ে গেল, তারপর কত বার এই বারান্দা কিংবা বাগানে একলা হলেই সে এসে আমার সঙ্গে কথা বলেছে। কতরকম মজার মজার গল্প শুনিয়েছে। কত আজব ছড়া।
কিন্তু মুশকিল বাধাচ্ছিল মেজোকাকার কুকুর কালু। বেশ দু-জনে কথা বলছি, হঠাৎ কালুটা কোথায় ঘেউ ঘেউ করে ওঠে, অমনি লোকটা বকুল গাছে লুকিয়ে পড়ে। কালুটা মহাপাজি। গাছটা চক্কর দিয়ে ওপরে মুখ তুলে কতক্ষণ ঘেউ ঘেউ করে। আমি ওকে তাড়াতে গেলে দাঁত বের করে আমাকে কামড়াতে আসে। আমি ঢিল ছুড়ে তাড়াই।
একদিন বিকেলে স্কুল থেকে শেষ পরীক্ষা দিয়ে ফিরে বাগানে একলা দাঁড়িয়ে ওর একটা গল্প শুনছি। গল্পটা দারুণ মজার। আমাদের গাঁয়েরই এক শাকতোলানি বুড়ি গেছে তেপান্তরের মাঠের মধ্যিখানে সেই হাঁসচরা বিলে। বুড়িটা ছিল বড্ড কুঁদুলি। লোকে বলত পাড়াবুদুলি। কারণ পাড়ার লোকের সঙ্গে হুট করতেই কোঁদল জুড়ে দিত।
সেই পাড়াকুঁদুলি বুড়ি আপন মনে হাঁসচরা বিলে কলমি শাক তুলছে। তার স্বভাব যাবে কোথায়? একটা শামুকের শুঁড়ে ওর ঠ্যাঙে সুড়সুড়ি লেগেছে বলে বুড়ি তার সঙ্গে কোঁদল জুড়ে দিয়েছে।
বুড়ি নেচে নেচে ছড়া গেয়ে কোঁদল করছে :
—তোর মুণ্ডু খাই, তোর কত্তাবাবার খাই কড়মড়িয়ে খাই আমি মড়মড়িয়ে খাই
খেয়েদেয়ে ড্যাংডেঙিয়ে নাতির বাড়ি যাই…’ এদিকে হয়েছে কী, জলার ধারে থাকে এক শাঁখচুন্নি। সেও পেতনিপাড়ার
নামকরা কুঁদুলি। শাঁখ, গুগলি, কাঁকড়া আর শামুক তার খাদ্য। এ বুড়ি যেমন পেটের জ্বালায় শাক তুলতে গেছে, সেই শাঁখচুন্নিও তেমনি পেটের জ্বালায় গুগলি, শামুক খুঁজতে গেছে। শাকতোলানির গলা পেয়ে সে ট্যাঙস ট্যাঙস করে সেখানে হাজির
হয়েছে। হয়ে বলেছে, ‘কী কী কী?’ ব্যাস! দুই কুঁদুলিতে বেধে গেছে তুমুল কোঁদল। কেউ থামবার নয়। পরস্পর
আঙুল তুলে পরস্পরকে শাসাচ্ছে। সে কী চিলাচানি। সে কী নাচনকোঁদন! হেন সময়ে জলার হাঁসদের রাজার কানে গেছে সেই খবর। হাঁসের রাজা রাজহাঁস খাপ্পা হয়ে বলল,
‘প্যাক প্যাক প্যাকোর প্যাঁক…
কারা দেখায় জাঁক রে
শিগগির গে দেখ তো কাট তাদের নাক তবু না থামে যদি, কাটিস চুল আর দু-কানের লতি প্যাঁক প্যাকোর প্যাক শিগগির গে’ দেখ তো॥…
হুকুম পেয়েই জলার যত পাতিহাঁস বেলেহাঁস, শনশনিয়ে ডানা কাঁপিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে আসতে লেগেছে। আকাশ-বাতাসে হুলুস্থূল। জলার জল ঢেউয়ে তোলপাড়। তারপর কিনা… আচমকা ঘেউ ঘেউ ঘেউ ঘেউ! বাড়ির ভেতর থেকে হতচ্ছাড়া কালুটা বেরিয়ে বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে পড়ল এবং তাকে দেখেই আমার বকুল গাছের
হুঁকোত্থেকো বন্ধুবেচারা এক লাফে গাছে চড়ে অদৃশ্য হল। তার হুঁকোটা পড়ে গেল
হাত ফসকে। কলকে উলটে ছাই পড়ল গড়িয়ে। আগুনের ফুলকি উঠল চিড়বিড়িয়ে।
বগ বগ করে একটু জলও হুকোর খোলের ফুটো থেকে গড়িয়ে পড়ল। কালু চ্যাঁচামেচি করে গাছ চক্কর দিচ্ছে। এমন সময় মেজোকাকা বেরিয়ে এলেন বাড়ি থেকে। এসেই কালুকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘শাট আপ! শাট আপ!’
কালু থামবার পাত্র নয়। সে মেজোকাকুর কাছে এসে হাঁটুর কাছে মুখ তুলে কেউমেঁউ করে কী বলল। তারপর আবার দৌড়ে গেল গাছতলায়। এবার মেজোকাকা সন্দেহাকুল চোখে গাছটা দেখতে দেখতে বললেন, ‘গাছে
হনুমান আছে নাকি রে বিলু?’ বললুম, ‘না মেজোকাকু। কালু একটা কাঠবেড়ালি দেখেছে।’ হঠাৎ গাছতলায় উলটে পড়ে থাকা হুঁকোটার দিকে চোখ গেল মেজোকাকার।
হুঁকোটা তুলে নিয়ে অবাক হয়ে বললেন, ‘এ কার হুঁকো রে বিলু?’
‘আমি তো জানিনে মেজোকাকু।’
মেজোকাকা ধমক দিয়ে বললেন, ‘জান না? এখনও কলকে আগুন রয়েছে। কে হুঁকো খাচ্ছিল বল হতভাগা? আলবাত জানিস?’… বলে হুঁকোটা তুলে ভুড়ুক ভুডুক করে কয়েকটা টান মেরে মেজোকাকা ফুরফুর করে ধোঁয়া উড়িয়ে দিলেন। “বাঃ, এ তো ভারি সুগন্ধি তামাক!?
‘ও মেজোকাকু! ছ্যা ছ্যা! তুমি হুঁকো খাচ্ছ? বলে দেব বাবাকে?? মেজোকাকা চোখ টিপে বললেন, ‘চুপ। লেবেনচুষ দেব।’ তারপর মনের আনন্দে হুঁকো খেতে থাকলেন। ততক্ষণে কালু মেজোকাকার কাছে ফিরে এসে মুখ তুলে যেন তামাকের গন্ধ শুঁকছে। কালুর মুখটা বেজায় গম্ভীর। চোখে সন্দেহের চাউনি। তারপর কালু আমার কাছে এসে বেজায় ধমক দিল বার তিনেক। আমি
অবিকল মেজোকাকার গলায় বললুম, ‘শাট আপ কালু! শাট আপ! কালু যেন কুকুরের ভাষায় পালটা ধমক দিয়ে বলল, ‘চালাকি কোরো না বিলু। সব বুঝতে পেরেছি আমি।’ তারপর সে কিছুক্ষণ ঘুরঘুর করে লেজ তুলে বাড়ির ভেতর চলে গেল।
মেজোকাকা তারিয়ে তারিয়ে হুঁকো খাওয়ার পর চাপাস্বরে বললেন, ‘এই বিলু,
আরও দুটো লেবেনচুষ দেব। বল না, কার হুঁকো এটা?? বলব, না, বলব না ভাবছি—হঠাৎ বিদঘুটে ব্যাপার ঘটে গেল। ততক্ষণে শীতের বেলা ফুরিয়ে এসেছে। বাগানে আর একটুও দিনের আলো নেই। আবছায়া ঘনিয়েছে। গাছগুলো গায়ে কুয়াশার চাদর টেনে নিয়েছে। সেই ধূসর কুয়াশা আর আবছা অন্ধকারে বকুল গাছটা থেকে একটা মস্ত লম্বা কালো হাত বেরিয়ে খপ করে মেজোকাকার হাত থেকে হুঁকোটা ছিনিয়ে নিয়ে গেল। অমনি মেজোকাকা আঁতকে উঠে গোঁ গোঁ করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন।
আর আমিও এতদিন পরে এতক্ষণে ঝটপট বুঝে নিয়েছি, বকুল গাছের বন্ধুটি
খুব সহজ লোক নয়। ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠেছি সঙ্গেসঙ্গে। আমার চ্যাঁচামেচিতে বাবা বেরিয়ে এলেন। মা এলেন। আর সব কাকারা এলেন। সে এক হুলুস্থুলস ব্যাপার। আলো আন! জল আন! পাখা আন!
পরদিন সকালে বুধু ওঝাকে ডেকে আনা হল। সে নাকি ভূতপ্রেতের যম। লোকে বলে বুধু ওস্তাদ। সে মেজোকাকাকে খুব ঝাড়ফুঁক করে বলল, ‘বলুন, নেই!’ মেজোকাকা মিনমিনে স্বরে বললেন, “নেই।’
তারপর বুধু গাছটার চারপাশে ঘুরে দেখে-শুনে বাবাকে বলল, ‘বড়োবাবু! এই গাছটা আজই কেটে ফেলুন। এ-গাছে ব্রহ্মদত্যি আছে।’ বাবা ভয় পেয়ে বললেন, ‘বল কীহে ওস্তাদ!
“আজ্ঞে হ্যাঁ বড়োবাবু।’… বলে বুধু আমার দিকে কেমন চোখে তাকিয়ে ফের
বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে, খোকাবাবুর দিকেও নজর পড়েছে ওনার। কেমন যেন
শুকনো শুকনো দেখাচ্ছে! হুঁ – খোকাবাবুর চোখে ব্রহ্মদত্যিমশাইকে দেখতে পাচ্ছি।
ওই তো হুঁকো টানছে গুডুক গুড়ুক করে!’
মা সভয়ে আমাকে টেনে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ। খোকা কিছুদিন থেকে ভালো করে খাচ্ছে-টাচ্ছে না। খালি বকুলতলায় মন পড়ে থাকে। কী যেন ভাবে
আর বিড়বিড় করে কথা বলে!
আমি বললুম, ‘ভ্যাট। আমার কিস্যু হয়নি।’
বুধু আমার বুকে তার কড়ে আঙুল ছুঁইয়ে বিড়বিড় করে কী মন্ত্র পড়ল। তারপর ঘুরে বকুল গাছটার দিকে কটমট করে তাকিয়ে ধমক দিল, ‘যা, যা! ভাগ!…?
সেদিন দুপুরে দেখি, মকবুল কাঠুরেকে ডেকে আনা হয়েছে। সে কুড়ুল নিয়ে গাছটার কাছে যেতে আমি কান্নাকাটি জুড়ে দিলুম। মেজোকাকা আমাকে থাপ্পড় তুলে ধমক দিলেন, ‘শাট আপ! শাট আপ!
আমার চোখের সামনে নিষ্ঠুর মকবুল কাঠুরে গাছটার গোড়ায় কোপ মারতে শুরু করল। দুঃখে-রাগে আমি অস্থির। কিছুক্ষণের মধ্যেই অত সুন্দর বকুল গাছটা, মড়মড় করে ভেঙে পড়ল। মকবুল দাঁত বের করে হেসে বলল, “এবারে শীতের রোদ্দুর অনেকটা পাবেন বাবুমশাই! এখানে ফুলের গাছ লাগাবেন। দেখবেন, কেমন রাঙা রাঙা ফুল ফুটবে!’