টুকুন ও চুমকি
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
– গল্প
টুকুনের মন খারাপ। তার বড়ো শালিখ পাখিটা খাঁচা থেকে পালিয়ে গেছে। এক বছর ধরে তাকে কত আদরে পুষছিল টুকুন। নাম রেখেছিল চুমকি। রোজ স্কুল থেকে ফিরে টুকুন তার সঙ্গে গল্প করত। স্কুলে/ সেদিন যা যা হয়েছিল, সেই সব মজার মজার গল্প। চুমকি মন দিয়ে শুনত আর কিচির কিচির করে হেসে খুন হত। চুমকির ভাষা টুকুন দিব্যি বুঝতে পারত। তেমনি টুকুন যা বলত, তাও কি বুঝত না চুমকি? নইলে অত হাসি কীসের?
তবু চুমকি পালিয়ে গেল। পালিয়ে গেল ছোটোমামার দোষে। খাঁচার দরজা খুলে আদর করতে গেছেন, আর চুমকি ফুড়ুৎ করে উড়ে গেছে। টুকুন রাগে-দুঃখে ছোটোমামাকে আঁচড়ে কোণঠাসা করে ফেলেছিল। ছোটোমামার ওই এক কথা, ‘ভারি তো একটা শালিখ। ময়না হলে কথা ছিল।’ রাতে টুকুন শুধু চুমকির স্বপ্ন দেখল। সকালে উঠে তাঁকে খুঁজতে বেরোল।
যেখানে শালিখ পাখি দেখতে পায়, খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। চিক্কুর ছেড়ে ডাকে,
‘চুমকি-ই-ই।’ চুমকি হলে তো সাড়া দিয়ে কাছে আসবে! ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে ডানা
মেলে পালিয়ে যায়। টুকুনের আরও মন খারাপ হয়ে যায়। টুকুনদের গাঁয়ে কত শালিখ। শুধু চুমকিই নেই। তাহলে কি কানুদের সেই রাক্ষসের পাল্লায় পড়েছিল? বেড়ালটা টুকুনকে দেখতে পেয়েই কেটে পড়ছে কেন? টুকুন কানুদের বাড়ির পেছনে ওত পেতে বসে রইল। হাতে একটা ইটের টুকরো। বেড়ালটাকে উচিত সাজা দেবে।
কানুর বোন বিনু এসে বলল, ‘ও কী রে টুকুন? কাকে মারবি তুই?’ টুকুন থতোমতো খেয়ে ঢিলটা ফেলে দিল। কাঁদো-কাঁদো মুখ করে বলল, “বিনুদি, আমার চুমকিকে দেখেছ? চুমকি পালিয়ে গেছে কাল।
বিনু বলল, ‘চুমকি কে রে?? ন্যাকামি দেখে গা জ্বলে যায় টুকুনের। সে রাগ চেপে বলল, ‘আমার শালিখ পাখি বিনুদি। দেখনি তাকে?
বিনু মুখটিপে হেসে বলল, ‘তাই বল। একটু আগে নদীর ঘাটে ভারু পাটনির ছেলে নোটনের কাছে একটা শালিখ পাখি দেখলুম। গিয়ে খোঁজ নে তো!’ টুকুন দৌড়োল। নদীর ঘাটে নৌকোয় বসে ভারু মাঝি হুঁকো খাচ্ছে আর খক খক করে কাশছে। বলল, ‘কী খোকাবাবু? ওপারে যাবে নাকি? এসো, পার করে দিই।”
টুকুন বলল, ‘নোটন কোথায় মাঝি? তাকে খুঁজছি।’
ভারু বলল, ‘নোটন? সে তো ওপারের বনে গোরু চরাতে গেল।’ টুকুন ব্যস্ত হয়ে বলল। মাঝি, আমাকে শিগগির পার করে দাও।’ আসল কথাটা ফাঁস করল না। ভারু যদি পার না করে? ভাৱু তাকে পার করে দিল। ওপারে মেঠো পথের দু-ধারে সবুজ ধান খেত। এদিক-ওদিক বন-বাদাড়। টুকুন দেখল বনের ধারে একপাল গোরু চরছে। তাহলে ওখানেই নোটন আছে। টুকুন আবার দৌড়োল।
কিন্তু কোথায় নোটন? একটা গাছের তলায় একদল রাখাল ছেলে খেলা করছে। তারা বলল, নোটনকে তারা দলে নেয় না। নোটন খুব একানড়ে ছেলে। সে তাই একলা গোরু চরায়। ওই তো তার বাঁশির সুর শোনা যাচ্ছে।
বাঁশির সুর যেদিক থেকে আসছে, সেদিকে গভীর বন। টুকুনের এবার একটু ভয় করছিল। তবু সে মরিয়া হয়ে ছুটে চলল। শরৎকালের আকাশ জুড়ে টুকরো টুকরো মেঘ ভাসছে। কাশ বনে সাদা ফুলের মেলা বসেছে। এই রোদ, এই ছায়া।
ফুরফুরে বাতাস বইছে। সবুজ ঘাসের পাতায় রং-বেরঙের ঘাসফড়িং কিরকির করে গান গাইছে। নালার ধারে এক পায়ে বসে থাকা বকটা টুকুনের দিকে বিরক্ত হয়ে। তাকাল। যেন বলল, ‘কে হে তুমি, এখন ঝামেলা করতে এলে?? নালা পেরোবে কেমন করে? টুকুন নালার ধার দিয়ে দৌড়ে ঝিলের সামনে
পড়ল। থমকে দাঁড়াল। এই কি সেই ডাইনির ঝিল – যেখানে পদ্মপাতায় বসে
রোদ্দুরে চুল শুকোয় এক আদ্যিকালের বুড়ি ডাইনি? তার নীল চোখ নাকি জ্বলজ্বল করে। ছেলেপুলে দেখলেই সে চোখ দিয়ে রক্ত চুষে খায়। টুকুনের বুক ঢিপ ঢিপ করল। সে ভয়ের চোখে তাকিয়ে রইল ঝিলের দিকে। কিন্তু ডাইনিটা নেই। ঝিলের জলে কত পাখি। মনের সুখে সাঁতার কাটছে। মাঝে মাঝে ডানা শনশন করে ঝাঁক বেঁধে ওড়াওড়ি করছে। টুকুন ভাবল, এই কি
তাহলে পাখিদের দেশ?
হঠাৎ কে ভারী গলায় বলে উঠল, ‘কে ওখানে?”
চমক খেয়ে টুকুন ঘুরে দেখল, ঝাঁকড়া আর বেঁটে একটা গাছের তলায় এক বুড়োমানুষ বসে আছে। টুকুনও ভয়ে ভয়ে বলল, ‘আমি টুকুন। নোটনকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। সে আমার চুমকিকে ধরেছে। নোটন কোথায় বলতে পার?’ বুড়ো হাসতে লাগল। তারপর বলল, ‘নোটন? ওই শোনো সে বাঁশি বাজাচ্ছে।
কিন্তু চুমকি কী খোকাবাবু ?? “চুমকি আমার শালিখ পাখির নাম। বলে টুকুন আবার পা বাড়াল।
বুড়ো বলল, ‘খু, নোটনের কাছে একটা শালিখ পাখি দেখেছি বটে!?
বাঁশির সুর গভীর বনের ভেতরে। টুকুন যত যায়, তত মনে হয় বাঁশির সুর দূরে সরে যাচ্ছে। বনের ভেতর ঘন ছায়া। পাখপাখালি ডাকছে। ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। নোটনের বাঁশির সুর সমানে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু কোথায় নোটন? হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে গেল টুকুন। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গেল। সে ধুপ করে বসে। পড়ল।
কতক্ষণ পরে তার কানে এল কেউ তার নাম ধরে ডাকাডাকি করছে। টুকুন উঠে দাঁড়াল। তারপর দেখল, ছোটোমামা আর সেই বুড়ো মানুষটা হন্তদন্ত হয়ে এদিকেই আসছেন। টুকুন গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ছোটোমামা বললেন, ‘তোকে খুঁজে খুঁজে সারা। বাড়ি আয় হতভাগা
ছেলে!
টুকুন গোঁ ধরে বলল, ‘নোটনের কাছে আমার চুমকি আছে যে!’
ছোটোমামা হাসলেন। ‘না, না। তোর চুমকি ফিরে এসেছে দেখবি আয়!’ টুকুন লাফিয়ে উঠল। বুড়ো বলল, ‘হুঁ, পোষা পাখি। যাবে কোথায়? বনের পাখি তো আর তাকে দলে নেবে না। তবে নোটনের একটা শালিখ পাখি আছে। ওই শোনো, নোটন কেমন বাঁশি বাজাচ্ছে।
যেতে যেতে ছোটোমামা গান শুনে বললেন, “বেশ বাজায় তো ছেলেটা। কোথায় বসে বাজাচ্ছে??
বুড়ো বলল, “সেটাই বলা কঠিন। নোটন তো এক জায়গায় থাকে না।
বাড়ি ফিরে টুকুন দেখল চুমকি খাঁচার ভেতর মনমরা হয়ে বসে আছে। তাকে দেখে কিচিরমিচির করে বলল, “তোমার মন খারাপ হবে বলে ফিরে এলুম, টুকুন! নইলে আকাশে উড়ে বেড়ানোর যা মজা!’
টুকুন বলল, “না চুমকি। তোকে আর সব সময় খাঁচায় ভরে রাখব না।
নোটনের মতো তোকে সঙ্গে করে রোজ নদীর ওপারে নিয়ে যাব। সেখানে কত
পাখি জানিস তো?’
তারপর সে মায়ের কাছে গিয়ে বলল, “ও মা! আমি একটা বাঁশের বাঁশি কিনব যে! পয়সা দাও!’ নদীর ওপারে ঝিলের ধারে গভীর বন। টুকুনের ইচ্ছে করছে, সেই বনে গিয়ে
রাখাল ছেলের মতো বাঁশি বাজাবে। আর তার কাঁধে বসে থাকবে চুমকি! কী মজাই না হবে! ছোটোমামা খুঁজতে গেলে তাকে খুঁজেই পাবেন না, অথচ তার বাঁশির সুর শুনতে পাবেন। সে এক দারুণ লুকোচুরি খেলা!