আত্মশক্তি বৃদ্ধি আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা সংক্ষেপে আলোচনা কর।
১৮৬০-এর দশকে চীনে আত্মশক্তি বিকাশের এক পরিমণ্ডল তৈরী হয়। চীনকে আধুনিক করে গড়ে তোলার এমন সুযোগ আগে কখনো আসেনি। একদিকে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ চীনের আধুনিকীকরণে আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং এ বিষয়ে পরামর্শ, উৎসাহ ও সাহায্য দিতে এগিয়ে আসে, অন্যদিকে যুবরাজ কুং ও চীনের পণ্ডিত সম্ভ্রান্ত শ্রেণীও চীনের কূটনৈতিক ও সামরিক আধুনিকীকরণে উদ্যোগী হয়। বিদেশীদের সহায়তায় রাজ সমুদ্র শুল্ক বিভাগ (Imperial Maritime Customs) গড়ে তোলায় চীনে রাজস্ব ব্যবস্থায় জোয়ার আসে। বহির্বাণিজ্য শুল্ক থেকে চীন প্রভূত আয় করতে পেরেছিল মূলতঃ হোরাসিও নেলসন লে ও রবার্ট হার্ট-এর মত অভিজ্ঞ বিদেশীদের একনিষ্ঠ সেবার জন্যই। হার্টের উদ্যোগেই আন্তর্জাতিক শুল্ক সংস্থা গড়ে তোলা হয়।
সমুদ্র শুল্ক বিভাগের বিদেশী পরিদর্শকরা চীনা সরকারের হয়ে বিশ্বস্ততা ও একনিষ্ঠতার সঙ্গে চীনের আধুনিক পরিকাঠামো গড়ে তোলায় নিজেদের উৎসর্গ করে। এর ফলে চীনাদের সঙ্গে বিদেশীদের সম্পর্কের উন্নতি ঘটে। এই সময় চীনের অধিকাংশ প্রদেশই যোগ্য গভর্নরদের নিয়ন্ত্রণে ছিল যারা মৃতপ্রায় পরীক্ষা পদ্ধতির মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসেনি, এসেছিল তাইপিং বিদ্রোহের মত কঠোর অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে। গৃহযুদ্ধের এই অভিজ্ঞতাই তাদের আধুনিক সমরান্ত্রের সঙ্গে এবং আধুনিক শিল্পের সঙ্গে পরিচিত করিয়েছিল এবং এইভাবেই আধুনিকতার সঙ্গে তাদের প্রথম পরিচয় ঘটে। সর্বোপরি জাপানের মত ছোট দেশের আধুনিকতার প্রতি ঝাপিয়ে পড়া চীনকেও উৎসাহিত করেছিল। চীনের আত্মশক্তি বিকাশের এই আন্দোলন জু-চিয়াং (Tzu-Chiang) নামে পরিচিত ছিল।
ফেয়ারব্যাঙ্ক তুং চি সংস্কার সম্পর্কে লিখেছেন যে এর আসল লক্ষ্য ছিল বৈদেশিক আগ্রাসন ও অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ থেকে দেশকে রক্ষা করা। এজন্য শাসকরা পুরোনো কনফুসীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তারা চিনকে আধুনিক করে গড়ে তুলতে চায়নি (China’s basic response in the 1860s to the dual menace of foreign aggression and domestic rebellion was to reaffirm, or restore, the old Confucian system rather than to modernize it)।
আধুনিকীকরণের ক্ষেত্র ছিল অবশ্যই সীমিত, অস্ত্রশস্ত্র, জাহাজ, যন্ত্রপাতি, যোগাযোগ, খনি এবং হালকা শিল্প স্থাপন ছিল লক্ষ্য। পুরোনো ব্যবস্থার ওপর আমদানি করা নতুন প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান চাপালে তার ফল ভালো হয় না। পশ্চিমি রাষ্ট্র, অর্থনীতি, দর্শন, শিল্প সংস্কৃতিকে না বুঝে শুধু তার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে গ্রহণ করার প্রয়াস চালানো হয়েছিল। তুং চি পর্বের শিল্পায়ন তাই গভীরতা লাভ করেনি, কৃত্রিম আধুনিকতার বাতাবরণ তৈরি করেছিল (The self strengthening efforts barely scratched the surface of modernization, without achieving a breakthrough in industrialization)।
১৮৮৪-৮৫ খ্রিস্টাব্দে আন্নাম নিয়ে ফরাসিদের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হলে চিনের আধুনিকীকরণের দুর্বলতা ধরা পড়েছিল। দশ বছর পর জাপানের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয়ের পর এসম্পর্কে আর কোনো সন্দেহ ছিল না। মার্কসবাদী ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে কৃষি-নির্ভর কনফুসীয় সমাজের ওপর আধুনিক পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও শিল্পায়ন চাপিয়ে দিয়ে সমাজে নতুন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা হয়।
তুং চি সংস্কারের অনেকে আত্মশক্তি বৃদ্ধি আন্দোলনের সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করেছেন। তাইপিং বিদ্রোহের পর চিনের কেন্দ্রীয় সরকার দুর্বল হয়ে পড়েছিল, তুং চি সংস্কার পর্বে সরকার খানিকটা শক্তি সঞ্চয় করলেও তা স্থায়ী হয়নি। সরকারের কোনো দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা বা নীতি ছিল না। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ও পরিকল্পনায় সংস্কার সাধিত হয়নি, প্রাদেশিক শাসক এর নেতৃত্ব দেন। প্রাদেশিক শাসকরা যাঁরা নেতৃত্ব দেন তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করেননি, নিজেদের ক্ষমতার কেন্দ্র গড়ে তোলেন। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি যুদ্ধের সময় ফুকিয়েন নৌবহর আক্রান্ত হলে উত্তরের নৌবহর পেইল ও দক্ষিণের নৌবহর নানইয়াং সহযোগিতা করেনি। চিন-জাপান যুদ্ধের সময় নানইয়াং নৌবহর পেইয়াং নৌবহরের সঙ্গে সহযোগিতা করেনি, চিনের পরাজয়ে এটি ছিল একটি বড়ো কারণ।