আধুনিক ভারত গঠনে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান সম্পর্কে মূল্যায়ন কর । রাজা রামমোহন রায়ের অবদান আলোচনা করো । রাজা রামমোহন রায়ের অবদানের মূল্যায়ন কর ।
রবীন্দ্রনাথ রামমোহন রায়কে বলেছেন ‘ভারত পথিক’, ভারতকে তিনি পথ দেখিয়েছেন। তিনি হলেন আধুনিক ভারতের স্রষ্টা। সেই সময়টা ছিল অশান্ত, অস্থির, ঘোর তমসাবৃত। রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ছিল না, পুরাতন ও নতুনের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলেছিল, জনসমাজ ছিল দিশাহারা। এই যুগ সন্ধিক্ষণে রামমোহনের আবির্ভাব। পুরাতনকে সরিয়ে তিনি নতুনকে আহ্বান করলেন, বাংলা তথা ভারতের নবজাগরণের ‘ভোরের পাখি’ হলেন তিনি।
রামমোহনের আধুনিক জীবনীকার দিলীপকুমার বিশ্বাস তাকে বলেছেন বিশ্বপথিক, কারণ তার দৃষ্টি ছিল বিশ্বব্যাপী, সমগ্র মানব সমাজের ঐক্যে ছিল তাঁর বিশ্বাস। ম্যাক্সমুলার লিখেছেন যে রামমোহন পূর্ব ও পশ্চিমের জীবনতরঙ্গের মধ্যে সংযোগ ঘটিয়েছিলেন, তিনি হলেন ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলাদেশে যে নবজাগরণ দেখা দেয় তার মধ্যে তিনটি প্রধান ধারা ছিল। প্রথম ধারাটি হল ঐতিহ্যনির্ভর গোঁড়া রক্ষণশীলদের, এর নেতৃত্ব দেন রাধাকান্ত দেব। দ্বিতীয় ধারাটি ছিল যুক্তিবাদী প্রগতিশীল পাশ্চাত্যবাদীদের, এদের নেতা ছিলেন ডিরোজিও। আর তৃতীয় ধারাটি হল সমন্বয়বাদীদের এদের নেতৃত্ব দেন রাজা রামমোহন রায়। পশ্চিমি ভাবধারার সঙ্গে ভারতীয় ঐতিহ্যের সমন্বয় ঘটিয়ে তিনি ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সংস্কার প্রবর্তনের প্রয়াস চালিয়েছিলেন। বদ্ধ আঙিনায় তিনি নতুন বাতাস বইয়ে দেন, প্রাণের সঞ্চার করেন, রাষ্ট্র ও সমাজের বহুক্ষেত্রে তিনি নতুন পথের সন্ধান দেন।
বাংলার হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামে এক সচ্ছল পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর পরিবারে সরকারি চাকরির ঐতিহ্য ছিল। গ্রামের পাঠশালায় পড়াশোনার পর তিনি পাটনায় গিয়ে আরবি ও ফার্সি শেখেন। এই দুই ভাষা তিনি এমন উত্তমরূপে আয়ত্ত করেন যে তাঁকে মৌলবিরা ‘জবরদস্ত মৌলবি’ বলতেন। কাশীতে গিয়ে তিনি সংস্কৃত চর্চা করেন, বেদ ও উপনিষদ পড়েন। সরকারি চাকরি নিয়ে তিনি রংপুরে যান এবং ডিগবির অধীনে কাজ করেন। ইংরাজি, গ্রিক, হিব্রু, লাতিন প্রভৃতি ভাষা তিনি আরও করেন ; জৈন, হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের সারমর্ম জানার প্রয়াস চালান। ধর্ম সম্পর্কে তাঁর অদম্য কৌতূহল ছিল।
১৮১৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে তিনি কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন, স্থাপন করেন আত্মীয়সভা। হুগলি জেলায় জমিদারি ও তালুক কিনে তিনি সম্পন্ন হয়ে ওঠেন। ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ফিরিঙ্গি কমল বসুর বাড়িতে তিনি স্থাপন করেন ব্রাহ্মা সভা। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি তিনটি কারণে ইংল্যান্ডে যাবার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন। সম্রাট দ্বিতীয় আকবর তাকে ইংল্যান্ডের রাজার কাছে দূত হিসেবে পাঠানোর প্রস্তাব দেন। রামমোহন এই প্রস্তাবে রাজি হলে তাকে রাজা উপাধি দেওয়া হয়। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার অ্যাক্টের সময় ভারতীয়দের দাবি-দাওয়া সরকারের কাছে তিনি তুলে ধরার কথা ভেবেছিলেন। সতী আইন বাতিল করার জন্য রক্ষণশীলরা রাজার প্রিভি কাউন্সিলের কাছে আবেদন করেছিল। রামমোহন সতী আইনকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য বিলাতে যাবার সিদ্ধান্ত নেন।
১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিলাত যান, ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রিস্টলে অল্প রোগ ভোগের পর তাঁর মৃত্যু হয়। রামমোহনের ওপর বেহামের উপযোগবাদের প্রভাব পড়েছিল। ইউরোপীয় উদারনীতিবান, জাতীয়তাবাদ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন তাঁর ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন। স্পেন, পর্তুগাল ও নেপলসে গণতান্ত্রিক আন্দোলন চলেছিল, রামমোহন এসব আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন ছিলেন। ফ্রান্সের বিপ্লব এবং আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলন তাঁর চিন্তা-ভাবনাকে প্রভাবিত করেছিল। ইংল্যান্ডের সংস্কার আইনকে তিনি স্বাগত জানান, আবার আয়ারল্যান্ডের মানুষের সংগ্রামের প্রতি তাঁর সহানুভূতি ছিল।
ভারতের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মব্যবস্থাকে রামমোহন তার উন্নতির পথে প্রধান অন্তরায় হিসেবে গণ্য করেন। পৌত্তলিকতা, পুরোহিততন্ত্র, নানা অনুষ্ঠান ও আচরণ হিন্দু সমাজের অধোগতির কারণ বলে তিনি মনে করেন। ধর্ম সংস্কারকে তিনি বেশি গুরুত্ব দেন কারণ খ্রিস্টান মিশনারিরা ভারতের ধর্ম ও আচার অনুষ্ঠানকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেছিল। রামমোহন খ্রিস্টান ধর্মশাস্ত্র গভীরভাবে অধ্যয়ন করে এর নৈতিকতা ও সেবামূলক দিকটির প্রশংসা করেন কিন্তু খ্রিস্টের অবতারবাদ বা ত্রিত্বের ধারণাকে তিনি বাতিল করে দেন। ইসলামের একেশ্বরবাদ ও যুক্তিবাদ তাঁকে প্রভাবিত করেছিল।
‘তুফাৎ-উল-মুবাহিদিন’ নামে এক প্রবন্ধ লিখে তিনি সমন্বয়বাদী চিন্তার পরিচয় দেন, একেশ্বরবাদে আস্থা স্থাপন করেন। উপনিষদ ও বেদান্ত থেকে তিনি একেশ্বরবাদের ধারণা পেয়েছিলেন। তবে পরলোক, কর্মফল, জন্মান্তরবাদ ইত্যাদি সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত হতে পারেননি। সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরে তিনি আস্থা রেখেছিলেন। রামমোহনের ঈশ্বর হলেন নিরাকার ব্রহ্ম। এই একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি ব্রাহ্ম সমাজ স্থাপন করেন, তাঁর সমাজে সব ধর্মের মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল। সমাজের জন্য তিনি যে ট্রাস্ট দলিল রচনা করেন তাতে সর্ব মানুষের ধর্মীয় ঐক্যের ওপর জোর দেওয়া হয়। যেসব মিশনারি মনে করেছিলেন যে রামমোহন খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করবেন তাঁরা হতাশ হন।
ধর্মের ক্ষেত্রে রামমোহন ছিলেন সমন্বয়বাদী, ধর্মের ঐক্যে বিশ্বাসী। সত্যানুসন্ধানী রামমোহন মনে করেন সর্ব ধর্মের মূলকথা এক। রবীন্দ্রনাথের মতো তিনিও বিশ্বজনীন মানব ধর্মে আস্থা রেখেছিলেন। ইউনিটেরিয়ান কমিটি বা ব্রাহ্ম সমাজ স্থাপন করে তিনি সর্ব মানুষের ঐক্যের কথা ঘোষণা করেন। কোনোরকম সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা তাঁর ছিল না। সত্যধর্মকে সংস্কার মুক্ত করে অমলিন বিশুদ্ধতায় প্রতিষ্ঠা করা ছিল তাঁর লক্ষ্য। জাতিভেদে তিনি বিশ্বাস করতেন না, কিন্তু বাস্তব জীবনে সংস্কারের সব বন্ধন থেকে তিনি নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি। ব্রাহ্ম সমাজে শুধু ব্রাহ্মণরা বেদপাঠের অধিকার পেয়েছিল, সভা পরিচালনা করত ব্রাহ্মণরা, রামমোহন নিজে উপবীত ত্যাগ করেননি।
রামমোহন কখনও দাবি করেননি যে তিনি একটি নতুন ধর্মসম্প্রদায় স্থাপন করেছেন। তিনি দাবি করেছিলেন যে আচার অনুষ্ঠানহীন, পৌত্তলিকতা বিরোধী, পুরোহিততন্ত্র বিরোধী একেশ্বরবাদ তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন। ধর্ম হল সমাজ জীবনের বিশিষ্ট অঙ্গ, ধর্মের কুসংস্কার, নানা বিধিনিষেধ, জাতিকে পদে পদে পঙ্গু করে রাখে। তাঁর ব্রাহ্ম সমাজ হল সর্বধর্মাবলম্বী মানুষের মিলনস্থল। রামমোহনের যুক্তিবাদী, উপযোগবাদী ধর্মভাবনা সাধারণ মানুষকে তেমনভাবে প্রভাবিত করতে পারেনি। শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন যে তাঁর ধর্মভাবনা ছিল অনেকটা নেতিবাচক, সংস্কারমুখী, ইতিবাচক বা গঠনমূলক একে বলা যায় না। অরবিন্দ পোদ্দার লিখেছেন যে সেই অশান্ত, অস্থির যুগে রামমোহন নিজেও সুস্থিতির মধ্যে ছিলেন না। পশ্চিমি আগ্রাসী সম্প্রসারণবাদের মুখে তাঁর মধ্যেও অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছিল।
রামমোহন তাঁর যুগকে ভালো করে জেনেছিলেন, তমসায় আচ্ছন্ন ছিল সমগ্র সমাজ জীবন। স্মৃতি ও ন্যায়শাস্ত্রের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল বাংলার সমাজ জীবন। কতকগুলি কুপ্রথা ও কুসংস্কার সমাজ জীবনকে বেড়াজালে আবদ্ধ করে ফেলেছিল। সবচেয়ে বড়ো কুপ্রথা ছিল সতীদাহ, মৃত স্বামীর সঙ্গে তার বিধবা পত্নীকেও পুড়িয়ে মারা হত। শ্রীরামপুরের মিশনারিরা বিধবাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন, সতীদের সম্পর্কে এরাই বেশি তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। কলকাতার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সতীদাহের ঘটনা ঘটত।
হিন্দু সমাজের রক্ষণশীলরা সতীপ্রথাকে শাস্ত্রীয় ও আইনসংগত বলে মনে করত। নব্যবঙ্গীয় সমাজ ও সংবাদপত্রগুলি এই কুপ্রথার বিরোধিতা করেছিল। ঠিক এই সময়ে রাজা রামমোহন রায় সতীপ্রথা রদ করার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলেন। মনুসংহিতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি দেখিয়েছিলেন যে এই প্রথা শাস্ত্রসম্মত নয়, শাস্ত্র একে সমর্থন করে না। গোঁড়া হিন্দুরা রামমোহনের বক্তব্যের বিরোধিতা করে বক্তব্য রাখেন। রামমোহন বাংলা ও ইংরেজিতে সতীপ্রথা বিরোধী পুস্তিকা লিখে জনগণের মধ্যে প্রচার করেন। রামমোহন নারীর অধিকারের কথা তুলেছিলেন। এখানেও তিনি যাজ্ঞবল্ক্য, নারদ, বৃহস্পতি প্রভৃতি স্মৃতি থেকে উদ্ধৃতি দেন। তিনি প্রচার করেন পিতা ও স্বামীর সম্পত্তিতে নারীর অধিকার আছে।
রামমোহন চেয়েছিলেন জনমত তৈরি করে তিনি এই ঘৃণ্য প্রথার অবসান ঘটাবেন। আরও অনেক সামাজিক কুপ্রথা ছিল, এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বহুবিবাহ, কুলীন প্রথা, শিশুবিবাহ ইত্যাদি। রামমোহন এসব সামাজিক কুপ্রথাকে আক্রমণ করে লিখেছিলেন। তাঁর তিনখানি পত্রিকায় – সম্বাদকৌমুদী, মিরাত-উল-আখবর ও Brahmamnical Magazine — তিনি সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে জনমত গঠনের প্রয়াস চালান। শিক্ষার বিস্তার ঘটলে যে এসব কুপ্রথা দুর্বল হয়ে যাবে সে সম্পর্কে তিনি অনেকটা নিশ্চিত ছিলেন। গোড়ার দিকে কোম্পানির সরকারও এধরনের বিতর্কমূলক ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে চায়নি। কিন্তু উপযোগবাদী বেন্টিঙ্ক ইউরোপের উদারনৈতিক আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তিনি সুপ্রিম কোর্ট, পুলিশ ও সামরিক অফিসারদের সঙ্গে পরামর্শ করে এই সতীপ্রথা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন।
খ্রিস্টান মিশনারিরা বেন্টিঙ্ককে সমর্থন করেছিলেন। বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে আইন পাশ করে সতীপ্রথা নিষিদ্ধ করলে রামমোহন তাকে সমর্থন করেন। এই আইন বজায় রাখার জন্য বিলাত গমনের সিদ্ধান্ত নেন। অস্বীকার করা যায় না সতীপ্রথার বিরুদ্ধে রামমোহন জনমত গঠন করেন, আন্দোলন গড়ে তোলেন। রামমোহন শুধু সতীপ্রথা উচ্ছেদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তিনি নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, বহু বিবাহ, কুলীন প্রথা ও জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা করে তাঁর বক্তব্য রাখেন। বজ্রসূচি গ্রন্থের কতকাংশ বাংলায় অনুবাদ করে তিনি জাতি প্রথার অসারত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা করেন।
রামমোহন সংস্কৃত, আরবি ও ফার্সিতে সুপণ্ডিত ছিলেন, তাঁর পরিবারে ফার্সি ভাষার চর্চা ছিল। তিনি মনে করেন শিক্ষা হল সমাজ পরিবর্তনের এক মস্ত বড়ো হাতিয়ার। ইংরেজরা এদেশে রাজপাট স্থাপন করার পর ইংরাজি শিক্ষার চাহিদা বেড়েছিল, তিনি ইংরাজি শিক্ষা বিস্তারের পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি মনে করেন আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত না হলে ভারতীয়রা আধুনিক হতে পারবে না। সংস্কৃত কলেজ স্থাপনের প্রস্তাব করা হলে রামমোহন লর্ড আমহার্স্টকে একখানি চিঠি লিখে এদেশীয় ছাত্রদের ব্যাকরণ, অন্ত, পদার্থবিদ্যা, শারীরবিদ্যা ইত্যাদি শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে বলেন। পশ্চিমি শিক্ষা না পেলে যে ভারতীয়রা পিছিয়ে পড়বে সে সম্পর্কে তাঁর বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। হিন্দু কলেজ (১৮১৭) প্রতিষ্ঠার সময় তিনি সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছিলেন যদিও রক্ষণশীল হিন্দুরা কমিটিতে তাঁর সদস্যপদ পছন্দ করেননি। রামমোহন মোটেই ক্ষুণ্ণ হননি কারণ তাঁর ইচ্ছা যথাযথভাবে পূরণ করা হয়েছিল।
মিশনারি আলেকজান্ডার ডাফ কলকাতায় বিদ্যালয় স্থাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করলে রামমোহন তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা করেন। রামমোহন সর্বদা সমন্বয়বাদী, পশ্চিমের জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষাকে গুরুত্ব দিলেও তিনি প্রাচ্যবিদ্যাকে কখনও নস্যাৎ করেননি। কলকাতায় বেদান্ত কলেজ স্থাপন করে তিনি প্রাচীন শাস্ত্র পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা করেন। শিক্ষা সংক্রান্ত বিতর্ক শুরু হলে তিনি পাশ্চাত্যবাদীদের পক্ষ নেন। তিনি চেয়েছিলেন সরকার এদেশে শিক্ষা বিস্তারে উদ্যোগ গ্রহণ করুক। রামমোহনের প্রয়াসের ফলে এদেশের মানুষ পশ্চিমি জ্ঞান বিজ্ঞানের দিকে আকৃষ্ট হয়েছিল, নতুন নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। আধুনিক যুক্তিবাদী, মননশীল শিক্ষিত সম্প্রদায় গড়ে তোলা ছিল তাঁর লক্ষ্য। রামমোহন নারীজাতির শিক্ষার কথাও ভেবেছিলেন, কিন্তু এব্যাপারে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। সম্ভবত গোঁড়া রক্ষণশীল সমাজের বিরোধিতা উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি। অথবা নানা কাজের মধ্যে নারী শিক্ষা বিষয়টিকে তিনি বাস্তব রূপ দিতে পারেননি।
রামমোহনের সময়কালে ইউরোপের রাজনৈতিক চিন্তারক্ষেত্রে তিনটি প্রবণতা লক্ষ করা যায়। প্রথমটি হল আঠারো শতকের জ্ঞানদীপ্তি বা বুদ্ধিবিভাসা, এর মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছিল ফরাসি দার্শনিক ও চিন্তাবিদ ভলতেয়ার, রুশো, মন্টেস্কু ও ফিজিওক্র্যাটদের চিন্তাভাবনা। দ্বিতীয় প্রবণতা হল ইংল্যান্ডের উদারনৈতিক আন্দোলন, মানুষের সব রকম অধিকার মেনে নেবার দাবি উঠেছিল। উপযোগবাদীরা এই ধারার সম্প্রসারণ ঘটিয়েছিলেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নামগুলি হল বেস্থাম, জেমস মিল ও জন স্টুয়ার্ট মিল। তৃতীয় প্রবণতা হল রবার্ট আওয়েন প্রবর্তিত সমাজতান্ত্রিক আদর্শ । ইউরোপীয় চিন্তার এই তিন ধারার সঙ্গে রামমোহনের পরিচয় ছিল। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ ও ফরাসি বিপ্লব তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। বেকন, লক, নিউটন, হিউম, গিবন ও ভলতেয়ারের রচনাবলি তিনি পড়েছিলেন। ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে বেছাম ও রবার্ট আওয়েনের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয় হয়। ইউরোপীয় চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হলেও রামমোহন নিজস্ব ঐতিহ্য, চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি বিসর্জন দেননি। কোনো কিছু অন্ধভাবে অনুকরণের তিনি পক্ষপাতী ছিলেন না। সর্বোপরি, এক উদার, সহিষ্ণু বিশ্বজনীন মানবতাবোধ তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।
শৈশব ও কৈশোরে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষের পরাধীনতার গ্লানি তিনি অনুভব করেন। শক্তি প্রয়োগে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানোর কথা তিনি ভেবেছিলেন। পরিণত বয়সে ব্রিটিশ শাসন সম্পর্কে নতুন চিন্তাভাবনা গড়ে তোলেন। তাঁর ধারণা হয়েছিল ভারতে ব্রিটিশ শাসন হল ঈশ্বরের আশীর্বাদ, ব্রিটিশ উদারনীতি ও ন্যায়বোধ সম্পর্কে তাঁর শ্রদ্ধা গড়ে ওঠে। তিনি মনে করেন ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষ দ্রুত উন্নতি কাবে এবং এক শক্তিশালী বুদ্ধিমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠবে। ঐ বুদ্ধিমান মধ্যবিত্ত সমাজ এবং ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী ইংরেজরা আমেরিকা বা কানাডার মতো স্বাধীন দেশ গঠন করবে। অন্তত কিছুকাল যে ব্রিটিশ শাসন ভারতবাসীর পক্ষে মঙ্গলজনক সে বিষয়ে তাঁর সন্দেহ ছিল না।
ভারতের ব্রিটিশ শাসন কাঠামো নিয়ে রামমোহন চিন্তাভাবনা করেছিলেন। তিনি মনে করেন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হবে ভবিষ্যতে রাষ্ট্র ও সমাজের মেরুদণ্ড। স্বাধীন ভারতে সংসদীয় গণতন্ত্র হবে রাষ্ট্র কাঠামো। ভবিষ্যত ভারতের যে ছবি তিনি কল্পনা করেন তাতে জাতি ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকলে সমান স্থান পাবে, সংকীর্ণ ধর্মীয় প্রভাব তাঁর দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করেনি। যদিও গোড়ার দিকে তিনি নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের পক্ষে ছিলেন, জীবনের শেষদিকে তিনি গণতন্ত্রের দিকে ঝুঁকেছিলেন। গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল স্বাভাবিক কারণ তিনি আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হন।
ব্রিটিশ শাসনের সমর্থক হলেও রামমোহন বিভিন্ন সময়ে কোম্পানির শাসনের সমালোচনা করেন। তিনি মন্টেস্কুর ক্ষমতা বিভাজন নীতিতে আস্থা স্থাপন করেন। তিনি হলেন প্রথম ভারতীয় যিনি শাসন, আইন প্রণয়ন ও বিচার বিভাগীয় ক্ষমতার পৃথকীকরণ চেয়েছিলেন। তিনি এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে বণিক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নয়, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভারতের জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করবে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাতে তিনি ভারত শাসনের চূড়ান্ত দায়িত্ব অর্পণ করতে বলেছিলেন। হাউস অব কমন্সের সিলেক্ট কমিটির সামনে সাক্ষ্যদানকালে রামমোহন শাসননীতি রচনায় ভারতীয়দের মতামত গ্রহণ, শাসনব্যবস্থার উচ্চপদে ভারতীয়দের নিয়োগ, সরকারি ব্যয় হ্রাস প্রভৃতি কয়েকটি প্রগতিশীল সংস্কারের সুপারিশ করেন।
১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতীয় জুরি আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন কারণ এই আইনটি ছিল জাতি বৈষম্যমূলক। এই আইন বাতিল করার জন্য তিনি ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের কাছে আবেদন করেছিলেন। রামমোহন মনে করেন ব্যক্তি ও সমাজের অধিকার রক্ষায় সংবাদপত্র বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করে থাকে। এজন্য সংবাদপত্রের ওপর সরকার কোনো নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের প্রয়াস চালালে রামমোহন প্রতিবাদ করেন। রামমোহন রায়কে বলা হয় আধুনিক সাংবাদিকতার জনক কারণ তিনি সংবাদপত্র ও জনমতের গুরুত্ব উপলব্ধি করে বাংলা, ইংরাজি ও ফার্সি ভাষায় তিনখানি সংবাদপত্র পরিচালনা করেন।
১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির সরকার সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রেস অর্ডিন্যান্স জারি করলে তিনি প্রতিবাদ করেন। এই আইন বাতিল করার জন্য তিনি ইংল্যান্ডের মন্ত্রীসভার কাছে আবেদন করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর ব্রিটিশ সরকার এই কুখ্যাত আইনটি বাতিল করেছিল। রামমোহনের রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে কংগ্রেসের নরমপন্থীদের ভাবনার অনেকখানি মিল দেখা যায়। তিনি ভারতের স্বাধীনতার কথা বলেননি, চেয়েছিলেন প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগীয় সংস্কার। তাঁর দাবির মধ্যে ছিল ক্ষমতা বিভাজন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও ব্যক্তি স্বাধীনতা। তাঁর মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পরে নরমপন্থী কংগ্রেস নেতারা এসব দাবি তুলেছিলেন।
রাজনৈতিক চিন্ত-ভাবনায় রামমোহন ছিলেন বিশ্ব পথিক, তিনি শুধু নিজের দেশের মানুষের অধিকারের কথা ভাবেননি। পৃথিবীর সব দেশের মানুষকে এক মানব জাতির অংশ বলে মনে করতেন। পৃথিবীর সর্বত্র শোষিত অত্যাচারিত মানুষের তিনি পক্ষ নেন। তিনি প্রথম ভারতীয় যিনি পৃথিবীর সর্বত্র মুক্তিকামী মানুষের পক্ষ নেন। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লবের সাফল্যে তিনি অভিভূত হন। স্পেন ও পর্তুগালের স্বৈরাচারী শাসনের তিনি বিরোধিতা করেন, নেপলসের গণবিদ্রোহকে তিনি সমর্থন করেন। আইরিশ বিপ্লবীদের মুক্তি সংগ্রামকে তিনি সমর্থন করেছিলেন। আয়ারল্যান্ডের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদ করে তিনি ‘মিরাতে প্রবন্ধ লেখেন। দক্ষিণ আমেরিকায় ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটলে তিনি আনন্দিত হন। গণআন্দোলনের সাফল্য সম্পর্কে রামমোহন সর্বদা আশাবাদী ছিলেন। ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে সংস্কার আইন পাশ হলে রামমোহন তাকে স্বাগত জানান। তিনি প্রথম ব্যক্তি যিনি একটি আন্তর্জাতিক সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন, এই প্রতিষ্ঠান বিশ্বে শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখবে। রামমোহনের চিন্তা-ভাবনায় জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের এক সুষ্ঠু সমন্বয় ঘটেছিল। এই দুইয়ের মধ্যে তিনি কোনো বিরোধ দেখেননি, পরে রবীন্দ্রনাথ এই ধারার সম্প্রসারণ ঘটান।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যেমন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও রামমোহন ছিলেন নতুন চিন্তার অগ্রদূত। অর্থনৈতিক চিন্তার বিজ্ঞানসম্মত আলোচনায় রামমোহনের কোনো পূর্বসূরি ছিল না, তাঁর মৃত্যুর চারদশক পরে তাঁর উত্তরসূরিদের পাওয়া যায়। উনিশ শতকের শেষদিকে নৌরোজি, রমেশচন্দ্র ও রানাডের হাতে ভারতীয় অর্থনৈতিক চিন্তা যখন নবজীবন লাভ করে তখন দেখা যায় রামমোহনের চিন্তার সঙ্গে এর মিল অনেকখানি। অধ্যাপক ভবতোষ দত্ত লিখেছেন যে রাজা সম্ভবত অ্যাডাম স্মিথ, রিকার্ডো ও ম্যালথাসের রচনার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। কর নীতি, মূলধন সঞ্চয় এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত সমস্যা সম্পর্কে তাঁর চিন্তা এধরনের ইঙ্গিত দেয়। রামমোহনের অর্থনৈতিক চিন্তায় ভারতের ভূমি ও রাজস্ব ব্যবস্থা প্রাধান্য পেয়েছিল, সেটাই স্বাভাবিক কারণ এদেশের বেশিরভাগ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। উনিশ শতকের তিরিশের দশকে ভারতের কুটির শিল্প অবক্ষয়ের পথে চলেছিল, আধুনিক শিল্পের তখনও সূচনা হয়নি ।
রামমোহন বিস্তৃতভাবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং এই ব্যবস্থার ফলে উদ্ভূত সমস্যাবলির কথা আলোচনা করেছেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর জমিদাররা প্রজার খাজনা বাড়ানোর দিকে নজর দিয়েছিল কারণ সরকার খুব উচ্চহারে রাজস্ব ধার্য করেছিল। বাংলার কৃষক অধিকার হারিয়েছিল। রায়ত খাজনা দিতে দেরি করলে বা অপারগ হলে জমিদার তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি দখল করে নিত। রামমোহন লিখেছেন, জমিদাররা উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক নিয়ে নেবার চেষ্টা করত। বাকি অর্ধেক থেকে বীজ, বলদ, লাঙল, সেচ এবং কৃষির অন্যসব ব্যয় নির্বাহ করে জীবনযাত্রার সম্বল খুঁজতে হত। উৎপন্ন ফসলের মূল্য নির্ধারণে চাষি সুবিচার পেত না। এই অবস্থায় চাষির জীবনধারণ শক্ত ছিল, সঞ্চয়ের প্রশ্ন ওঠে না।
রামমোহন দেখিয়েছেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর জমিদাররা কৃষির সম্প্রসারণ ঘটাননি, অনাবাদি জমিতে চাষ বসাননি। অথচ জমিদার ও সরকার উভয়ে রাজস্ব সম্পর্কে নিশ্চয়তা পেয়েছিল। এই সমস্যার সমাধান সম্পর্কে রামমোহনের ধারণা ছিল খুব পরিষ্কার। তিনি প্রস্তাব দেন জমিতে কৃষকের অধিকার স্বীকার করে নেওয়া হোক, উৎপন্ন ফসলের পর্যাপ্ত অংশ কৃষককে দেওয়ার ব্যবস্থা হোক। তিনি চেয়েছিলেন জমিদার যেমন রাজস্বের ব্যাপারে নিশ্চয়তা পেয়েছে কৃষকও তেমনি খাজনার ব্যাপারে নিশ্চয়তা লাভ করুক। চাষির খাজনা স্থায়ীভাবে নির্ধারণের তিনি প্রস্তাব দেন। প্রজার দেয় খাজনা বৃদ্ধি বন্ধ হলে জমিদারের দেয় রাজস্বও কমানো উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।
রায়তের দেয় খাজনা যদি বাড়ানো না হয় এবং জমিদারের দেয় রাজস্ব যদি কিছুটা কমানো হয় তাহলে কোম্পানি সরকারের আয়-ব্যয়ে ঘাটতির সম্ভাবনা রামমোহন স্বীকার করে নেন। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার হারিয়েছিল। ঐ সময় থেকে কোম্পানির প্রশাসনিক আয়-ব্যয় ও বাণিজ্যের পৃথক হিসেব রাখা হত। রামমোহন যখন সিলেক্ট কমিটির সামনে সাক্ষ্য দেন তখন কোম্পানির প্রশাসনিক ব্যয় বছরে কুড়ি কোটি টাকা, এর ৬৬ শতাংশ আসত ভূমি রাজস্ব থেকে। ভূমি রাজস্ব কমানো হলে সরকারি আয়ে ঘাটতি দেখা দেবে।
রামমোহন প্রস্তাব দেন সরকার বিলাস পণ্য ও অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর শুল্ক বসিয়ে আয় বাড়াতে পারে। ব্যয় কমাতে পারে ইংরেজ কর্মচারীর পরিবর্তে ভারতীয় কর্মচারী নিয়োগ করে। সেই সময় সরকারি আয় বাড়ানোর জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য যেমন লবণের ওপর কর বাড়ানোর প্রথা ছিল। রামমোহন সম্ভবত প্রথম ভারতীয় যিনি বিলাস পণ্যের ওপর কর বসানোর প্রস্তাব দেন। রামমোহন অবশ্য বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন সরকারি ব্যয় কমানোর ওপর। তিনি হিসেব করে দেখিয়েছিলেন ভারত সরকারের কয়েক কোটি টাকা ব্যয় কমানো যায়। সাধারণভাবে একজন উচ্চ ইংরেজ কর্মচারীর জন্য সরকারের বার্ষিক ব্যয় হত পনেরো হাজার টাকা, সেখানে সমক্ষমতাসম্পন্ন একজন ভারতীয় কর্মচারীর জন্য ব্যয় হত সাড়ে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা।
রামমোহন শুধু উচ্চপদগুলির ভারতীয়করণ দাবি করেননি, তিনি শাসন বিভাগকে বিচার বিভাগ থেকে পৃথক করতে বলেছিলেন। এই প্রসঙ্গে তিনি দেখিয়েছিলেন যে ইংরেজ কর্মচারীদের বেতন, পেনশন ইত্যাদি বাবদ প্রতি বছর প্রায় তিন কোটি টাকা ইংল্যান্ডে চলে যায়। বোর্ড অব কন্ট্রোল, ইন্ডিয়া অফিস, কোম্পানির ক্ষণের ওপরে দেয় সুদ এবং লন্ডনে কোম্পানির প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে অনেক টাকা ইংল্যান্ডে চলে যেত। ইংরেজ কর্মচারীরা প্রতি বছর নিজেদের বেতন থেকে দুকোটি টাকা দেশে পাঠাত, ইংরেজ ব্যবসায়ীদের মুনাফা এর মধ্যে ধরা হয়নি। ভারতীয়দের মধ্যে রাজা রামমোহন রায় এই আর্থিক নিষ্ক্রমণের কথা প্রথম তুলেছিলেন। পরবর্তীকালে দাদাভাই নৌরোজি এই তত্ত্বের পূর্ণতর সুগঠিত রূপ দেন। রামমোহন বহির্বাণিজ্যের সমতা রক্ষা বা টাকা ও পাউন্ডের বিনিময় হার নিয়ে কোনো আলোচনা করেননি। অর্থনৈতিক আলোচনায় তিনি জোর দেন ব্যয় সংকোচের ওপর।
ভূমি ব্যবস্থা, সরকারি আয়-ব্যয়, আর্থিক নিষ্ক্রমণ এসব আলোচনার পর রামমোহন প্রস্তাব দেন ইউরোপীয়রা ভারতবর্ষে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করলে এদেশের কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের উন্নতি হবে। তারা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, মূলধন ও অভিজ্ঞতা নিয়ে আসবে। রামমোহন আফ্রিকায় ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের শোষণমূলক দিকটি দেখেননি, এজন্য তাঁর ইউরোপীয় নেতৃত্বে অর্থনৈতিক উন্নতির পরিকল্পনা কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছে। সম্ভবত রামমোহন আমেরিকার মডেল দ্বারা প্রভাবিত হন। তিনি সেই সময়কার শ্রমিকদের অবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন যে সেই সময় কলকাতায় একজন মিস্ত্রিজাতীয় শ্রমিকের মাসিক আয় ছিল দশ থেকে বারো টাকা। সাধারণ শ্রমিকের সাড়ে তিন থেকে চার টাকা। অন্য শহরে মজুরি ছিল কম, গ্রামে আরও কম। জিনিসপত্র অবশ্য সত্তা ছিল কিন্তু রামমোহন জানিয়েছেন যে দরিদ্র শ্রেণির মানুষ ভাত ও নুন ছাড়া আর কোনো আহার্য পেত না। বাড়ি হত মাটি ও খড় দিয়ে তৈরি, পরিধেয় বস্তু ছিল নামমাত্র।
রামমোহনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চিন্তা মৌলিকতায় অনন্য। এই দুইক্ষেত্রে অন্তত তিনি ছিলেন ভারতপথিক। ভারতের স্বাধীনতার কথা তিনি বলেননি। উনিশ শতকের শেষ দিকে শিক্ষিত ভারতীয়রা স্বাধীনতার দাবি তোলেননি। রামমোহন প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হয়ে তাঁরা প্রশাসনিক সংস্কার, সাংবিধানিক অধিকার, ব্যক্তি ও নাগরিক অধিকার দাবি করেছিলেন। তাঁর হাতে ভারতের অর্থনৈতিক চিন্তা একটি বৈজ্ঞানিক রূপ পেয়েছিল। তাঁর সব অর্থনৈতিক প্রস্তাবের মধ্যে একটি স্বচ্ছন্দ যোগসূত্র লক্ষ করা যায়, প্রত্যেকটি প্রস্তাব একসঙ্গে এক চিন্তাধারায় প্রথিত। অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদী অর্থনীতিবিদদের পূর্বসূরি।
রাজা রামমোহন রায়কে আধুনিক ভারতের জনক বলা হয়। বাংলা রেনেসাঁসের প্রাণপুরুষ, নবজাগরণের স্রষ্টা প্রথা ভেঙেছিলেন, তৈরি করেন নতুন পথ। সমালোচকরা তাঁর মধ্যে পরস্পর বিরোধিতা লক্ষ করেছেন, এই নবজাগরণের ভিত্তি হল ভারতীয় সমাজের ওপর ব্রিটিশ প্রভাব। তাঁর সমালোচকদের মধ্যে আছেন সুমিত সরকার, অরবিন্দ পোদ্দার ও অশোক সেন। বলা হয় তাঁর মৌলিকতা ও মহত্ত্বের উৎস হল। সমন্বয়বাদী ধর্মচিন্তা। তিনি হিন্দু, ইসলাম ও পশ্চিমের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছিলেন। আসলে চিন্তায় ও মননে তিনি ছিলেন সর্ব ধর্মের প্রতি সহনশীল, সব রক্ষণশীল ধর্মমত তিনি মেনে নেন। আকবর থেকে রামকৃষ্ণ সকলে এই সহনশীলতার কথা বলেছেন। তাঁর ধর্মচিন্তায় ছিল দুটি নিরিখ—যুক্তি ও সামাজিক উপযোগিতা। ‘তুফাৎ-উল-মুবাহিদিন’ নামক প্রবন্ধে তিনি একেশ্বরবাদ ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন যে সব ধর্মেই মিথ্যা আছে, এগুলির স্রষ্টা পুরোহিততন্ত্র। ধর্মের ক্ষেত্রে সত্যকে তিনি মেনে নেন। এই সত্য হল একেশ্বরবাদ, আত্মার অস্তিত্ব ও পরলোকে বিশ্বাস। উপযোগবাদের ভিত্তিতে তিনি দ্বিতীয় ও তৃতীয় সত্যকে যাচাই করেন। একেশ্বরবাদ ছাড়া ধর্মের আর সব সংস্কারকে তিনি নির্দয়ভাবে আক্রমণ করেন কারণ তাঁর মনে হয়েছিল এগুলি যুক্তি বিরোধী এবং সমাজের পক্ষে ক্ষতিকারক।
পরবর্তীকালে রামমোহন ধর্ম সম্পর্কিত এই চিন্তাধারা থেকে সরে দাঁড়ান। তুফাতের বাংলা বা ইংরাজি অনুবাদ তিনি করেননি যদিও উপনিষদ ও বেদান্তের অনুবাদ করেন। খ্রিস্টধর্মের অলৌকিকত্ব ও ত্রিত্বের ধারণা যেমন তিনি বাতিল করেন তেমনি হিন্দু ধর্মের পৌত্তলিকতাকে আক্রমণ করেন। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে রামমোহন অদ্বৈতবাদী, উপযোগবাদের সঙ্গে এর সমন্বয়ের প্রয়াস চালান। জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য এক ধর্মতত্ত্ব তিনি নির্মাণ করেন। ঈশ্বর সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা, এই তত্ত্ব তিনি গ্রহণ করেন। হিন্দুদের কর্মফল ও জাতিভেদকে তিনি আক্রমণ করেননি। তাঁর ধর্মতত্ত্ব ও তার প্রয়োগের মধ্যে দুস্তর ফারাক দেখা যায়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মধর্ম যথেষ্ট যুক্তিপূর্ণ ও সামাজিকক্ষেত্রে উপযোগী ছিল না। তিনি নিজে উপবীত ত্যাগ করেননি, ব্রাহ্মণ পাচক সঙ্গে নিয়ে তিনি ইংল্যান্ডে যান। মার্টিন লুথারের সঙ্গে তিনি নিজেকে তুলনা করেছেন, ইউরোপে লুথারের ধর্ম সংস্কার আন্দোলন অনেক বেশি সফল হয়েছিল।
ভারতে ব্রাহ্ম আন্দোলন তেমন সাফল্য লাভ করেনি। রামমোহন রায় ও তাঁর অনুগামীরা পশ্চিমি জ্ঞান-বিজ্ঞানকে স্বাগত জানান। লর্ড আমহার্স্টকে লেখা চিঠিতে (১৮২৩) তিনি অক্ষ, প্রকৃতি বিজ্ঞান, রসায়ন, শারীরবিদ্যা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিজ্ঞান শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে বলেন। তিনি পশ্চিমি এবং এদেশীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমন্বয় সাধন করতে চেয়েছিলেন। অনেকগুলি উপনিষদ ও বেদান্তের বঙ্গানুবাদ করে তিনি জনশিক্ষার সহায়ক হন। ভারতে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার পথিকৃৎ হিসেবে তিনি কাজ করেন। তাঁর আত্মীয়সভা ও হিন্দু কলেজের ছাত্ররা পশ্চিমি বিজ্ঞান ও সাহিত্যের বাংলা অনুবাদ করে জনশিক্ষার বিস্তার ঘটান। সংবাদকৌমুদিতে প্রবন্ধ লিখে তিনি এদেশি ছাত্রদের প্রথমে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে বলেন। রামমোহনের অ্যাংলো হিন্দু স্কুলের ছাত্ররা সর্বতত্ত্ব দীপিকা সভা স্থাপন করে বাংলা প্রচার করেছিল। এসব ক্ষেত্রে রামমোহনের অবশ্যই অগ্রণী ভূমিকা ছিল। কিন্তু ঔপনিবেশিক পরিমণ্ডল তাঁর সব প্রয়াসকে সার্থক হতে দেয়নি।
রামমোহনের সমাজচিন্তায় সবচেয়ে বড়ো স্থান নিয়েছিল সহমরণ প্রথা। সতীপ্রথা বদ্ধ করার ব্যাপারে তিনি বদ্ধপরিকর হন। অন্যান্য সামাজিক কুপ্রথা যেমন জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা, কুলীন প্রথা, শিশুবিবাহ, দাস প্রথা ইত্যাদিকে তিনি অতখানি গুরুত্ব দেননি। বজ্রসূচির অনুবাদে তিনি জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা করেন। ইসলামের যুক্তিবাদ থেকে তিনি অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন, পরে দেখানো হয় ব্রিটিশ যুক্তিবাদ থেকে তিনি তাঁর অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। রামমোহনের বিরুদ্ধে তাঁর বিরোধীরা পরস্পর বিরোধিতার অভিযোগ এনেছিল। সামাজিক ক্ষেত্রে তিনি রক্ষণশীল রয়ে যান, যুক্তিবাদকে সরিয়ে দিয়ে তিনি উপনিষদ, মনুস্মৃতি ও উপযোগবাদকে আশ্রয় করেন। ইসলামের যুক্তিবান থেকে তিনি সরে যান। ঔপনিবেশিক চিন্তাধারার প্রভাবে মুসলিম শাসনকে তিনি ভারতের দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী করেন। সম্ভবত তিনি জেমস মিলের রচনার দ্বারা প্রভাবিত হন।
প্রথম জীবনে রামমোহন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরোধী ছিলেন, এমনকি সশস্ত্র শক্তির সাহায্যে ভারতের মুক্তির কথা ভেবেছিলেন। রংপুরে অবস্থানকালে বিদ্রোহী কৃষক ও জমিদারদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ স্থাপিত হয়। পরে তিনি ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব ত্যাগ করেন। ব্রিটিশ শাসনকে তিনি ভারতের পক্ষে আশীর্বাদ হিসেবে গণ্য করেন। রামমোহন কতকগুলি সংস্কারের প্রস্তাব দেন—ভারতীয়দের উচ্চপদে নিয়োগ, বিচার বিভাগের সংস্কার, জুরির বিচার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ব্যক্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা, পার্লামেন্টের হাতে আইন প্রণয়নের অধিকার দান, শাসন ও বিচারবিভাগের পৃথকীকরণ ইত্যাদি। পরবর্তীকালের কংগ্রেসের নরমপন্থী রাজনীতির তিনি সূচনা করে যান। রামমোহনের অর্থনৈতিক চিন্তার মধ্যে অনেকে পরস্পর বিরোধিতা লক্ষ করেছেন। তিনি জমিদারদের সমালোচনা করেন, কৃষকদের খাজনা বাড়ানোর বিরোধিতা করেন। এজন্য জমিদারদের মুখপাত্র সমাচারচন্দ্রিকা তাঁর সমালোচনা করেছিল। আবার বেঙ্গল হরকরা তাঁর নরমপন্থার সমালোচনা করতে ছাড়েনি। তিনি ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনের প্রস্তাব দেন অথচ এ সম্পর্কে যথেষ্ট উৎসাহ দেখাননি বলে বেঙ্গল হরকরা তাঁর সমালোচনা করেছিল।
রামমোহন ও দ্বারকানাথের মতো মানুষরা ছিলেন জমিদার, মহাজন ও বণিক, এরা মুক্ত বাণিজ্যের পক্ষ নেন যদিও এর মর্মার্থ তারা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখেননি। মুক্ত বাণিজ্য যে ভারতীয় শিল্প-বাণিজ্যের পক্ষে মঙ্গলজনক হতে পারে না তা তারা অনুধাবন করতে পারেননি। রামমোহন নতুন যুগের বাঙালি মধ্যবিত্তের প্রতিনিধিত্ব করেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, মুক্ত বাণিজ্য ও উপনিবেশের সম্প্রসারণ যে এদেশে নতুন কর্মকাণ্ডের সৃষ্টি করবে সে সম্পর্কে তাঁর সন্দেহ ছিল না। কাঁচামাল যাবে ইংল্যান্ডে, শিল্প পণ্য আসবে ভারতে, সচ্ছল মধ্যবিত্ত ও কৃষক তা কিনবে। এতে বাংলার অর্থনৈতিক উন্নতি হবে। শিল্পবিপ্লবের ভয়ংকর অভিঘাত তাঁরা উপলব্ধি করতে পারেননি, বাংলায় অন্তত দশ লক্ষ তাঁতি কর্মচ্যুত হয়, ঢাকা শহর তার স্বাচ্ছন্দ্য হারিয়েছিল, বাঙালি মধ্যবিত্ত জমি, পেশা ও চাকরি নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল।
মূল্যায়ন :
রাজা রামমোহন রায়ের অবদান অনস্বীকার্য। অস্বীকার করা যায় না রাজা রামমোহন রায়ের ছিল বিশাল ব্যক্তিত্ব, সমকালের কোনো মানুষ তাঁর সঙ্গে তুলনীয় নয়। তাঁর বিশাল ব্যক্তিত্ব ও পাণ্ডিত্য দিয়ে তিনি ইতিহাসে নতুন পথ তৈরি করতে চেয়েছিলেন কিন্তু সর্বাংশে সফল হননি। ইংল্যান্ডের উদারনীতি, যুক্তিবাদ ও উপযোগবাদ তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তিনি এসব ধ্যান-ধারণার প্রয়োগ করে ভারতকে আধুনিক করতে চেয়েছিলেন। তাঁর চিন্তার পরস্পর বিরোধিতা ছিল তাঁর যুগের সীমাবদ্ধতা।
প্রাক্-ধনতান্ত্রিক ভারত ধীরে ধীরে বুর্জোয়া যুগে প্রবেশ করেছিল কিন্তু পুরোপুরি ধনতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটেনি কারণ হল। ঔপনিবেশিকতা। তাঁর মৃত্যুর পর বেঙ্গল হরকরা লিখেছিল কোনো বিশাল ব্যক্তিত্ব হয় হাতুড়ি, নয় নেহা হিসেবে কাজ করে। রামমোহন হাতুড়ির ভূমিকা নেন, নেহা হিসেবে পরিবর্তনের হাতিয়ার হতে পারেননি। অশোক সেন লিখেছেন যে, সেযুগে রামমোহন ছিলেন এক অসহায়, নিঃসঙ্গ পথিক। জাতীয়তাবাদী ও উদারনীতিবাদীরা তাঁকে সামাজিক সংস্কার ও সাংবিধানিক আন্দোলনের স্রষ্টা হিসেবে দেখেন। মার্কসবাদীরা তাঁকে সামন্ততান্ত্রিক, উপনিবেশবাদী, বুর্জোয়া বলে অভিহিত করেছেন। রামমোহন অবশ্যই যুক্তিবাদী ও আন্তর্জাতিকতাবাদী ছিলেন। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে সদ্যোজাত কায়েমি স্বার্থপুষ্ট বুর্জোয়া সমাজের তিনি প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। নানা সীমাবদ্ধতা ও পরস্পর বিরোধিতা সত্বেও ঔপনিবেশিক কাঠামোর মধ্যে তিনি ভারতকে আধুনিকতার পথ দেখিয়েছিলেন।