ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা উল্লেখ কর ।
ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা :
সমকালে এবং পরবর্তীকালে ডিরোজিও পন্থীরা কঠোরভাবে সমালোচিত হয়েছেন। এদের দৃষ্টিভঙ্গিকে বলা হয়েছে নেতিবাচক, গড়ার চেয়ে ভাঙার দিকে এদের নজর ছিল বেশি। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে রাজনারায়ণ বসু এদের সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে, ‘পাশ্চাত্যের আলো এদের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে। ইয়ং বেঙ্গলের কাজকর্মকে অনেকে এভাবেই দেখেছেন, নিষিদ্ধ খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করে, প্রথা ও আচার ভেঙে সমকালীন সমাজে এরা আলোড়ন সৃষ্টি করেন।
শিবনাথ শাস্ত্রী জানিয়েছেন যে ডিরোজিও পন্থীরা কর্মকাণ্ডের ফলে সমাজে হুলুস্থুলু পড়ে যায়। এদের বিরুদ্ধে ইংরেজিয়ানার অভিযোগ উঠেছিল, বলা হয় এরা দেশ ও দেশবাসীকে ভালোবাসেনি। আসল সত্য হল ডিরোজিও থেকে শুরু করে নব্যবসীয়দের সকলে ছিলেন খাঁটি দেশপ্রেমিক। অনেকে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করলেও হিন্দু ঐতিহ্য অস্বীকার করেনি। জ্ঞানান্বেষণ এবং মাসিক পত্রিকা মারফত তাঁরা বাংলাভাষী মানুষের কাছে আবেদন রেখেছিলেন। এদের বিরুদ্ধে নাস্তিকতার অভিযোগ পুরোপুরি সত্য নয়, আসলে ডিরোজিওপন্থীদের লক্ষ্য ছিল হিন্দু ধর্মকে যুক্তিসিদ্ধভাবে প্রতিষ্ঠা করা। ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যদের সততার কথাও ভোলা যায় না, এরা যা করেছেন তারমধ্যে আন্তরিকতা ও সততার অভাব ছিল না। এঁরা মূর্তি পূজা ও পুরোহিততন্ত্রের বিরোধী ছিলেন, কিন্তু একেশ্বরবাদে বিশ্বাস রেখেছিলেন।
অধ্যাপক সুশোভন সরকার লিখেছেন যে, ইয়ং বেঙ্গলের সীমাবদ্ধতা হল বাংলার নবজাগরণের সীমাবদ্ধতা। এজন্য তাদের স্বতন্ত্রভাবে দায়ী করা ঠিক নয়। বাংলার বুদ্ধিজীবীরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শোষণমূলক রূপটি ঠিকমতো ধরতে পারেননি, তাঁরা শুধু সুফল গুলি লক্ষ করেছিলেন। সমকালীন অর্থনৈতিক সমস্যার গভীরে তাঁরা প্রবেশ করতে পারেননি। সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বজনীন প্রেক্ষাপটও তাঁরা ঠিকমতো অনুধাবন করতে পারেননি। অবাধ অর্থনীতির মাধ্যমে যে ভারতবর্ষ শোষিত হচ্ছে এই ধারণাটি তাদের ছিল না। সে যুগের বুদ্ধিজীবীরা সকলে ব্রিটিশ শাসনকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।
ইয়ং বেঙ্গল ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা না করলেও এর দুর্বলতাগুলি তুলে ধরেছিল। বাংলার রেনেসাঁস ছিল শহরকেন্দ্রিক, বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ, বাংলার আপামর অনসাধারণ, কৃষক শ্রমিকের মধ্যে, তাদের চিন্তাধারার প্রভাব পড়েনি। শ্রমজীবী মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল না। হিন্দুধর্ম ও ঐতিহ্য নিয়ে তাঁরা ব্যক্ত হয়ে পড়েছিলেন, হিন্দুদের কথা তারা ভেবেছেন, অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছে তাঁরা নতুন জ্ঞানের আলোক পৌঁছে দিতে পারেননি। বাংলার মুসলমান সমাজ এই আন্দোলন থেকে দূরে ছিল। নবজাগরণের এই দুর্বলতাগুলি পরবর্তীকালে স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিল।
ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের সবচেয়ে বড়ো সীমাবদ্ধতা হল এরা স্থায়ী আন্দোলন বা ক্রমবর্ধমান আদর্শবাদী ধারা সৃষ্টি করতে পারেনি। এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বলা যায় ডিরোজিও ও তাঁর অনুগামীরা যে আন্দোলন গড়ে তোলেন তার গুরুত্ব কম নয়। তাঁরা নিয়ে এলেন নির্ভীক যুক্তিবাদ ও পশ্চিমি জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি আনুগত্য। পরবর্তীকালে ঐতিহ্য, অতীন্দ্রিয়বাদ বা পুনর্জাগরণবাদের ধাক্কায় এর অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়েছিল, তবে একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। কিশোরীচাঁদ মিত্র লিখেছেন যে, হিন্দু কলেজের এই শিক্ষিত তরুণরা প্রথম ঊষার আলোক দেখেন এবং দেশের মধ্যে তা ছড়িয়ে দেন (They were the first to catch and reflect the dawn)। তারা হল রেনেসাঁসের ‘প্রভাতী তারা’, নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও তাদের অবদান নবজাগরণের ঐতিহ্যে স্থায়ী আসন নিয়েছে।