১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলন । উনিশ শতকের ভারতে ধর্ম ও সমাজসংস্কার আন্দোলন সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর। উনিশ শতকের ভারতে প্রধান সামাজিক ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের মূল্যায়ন করুন ।
ভূমিকা :
উনিশ শতকের ইংরাজি শিক্ষা বিস্তারের অন্যতম সুফল হল ধর্ম ও সমাজসংস্কার আন্দোলন। শিক্ষিত ভারতীয়রা তাদের ধর্ম ও সমাজের অনেক আচার-আচরণ, প্রথা ও বিধি-নিয়মকে আধুনিক ও যুগোপযোগী বলে গণ্য করেননি। অনেক অনুষ্ঠান, আচার-আচরণ ছিল মানবতা বিরোধী, অযৌক্তিক ও উৎপীড়নমূলক। মূর্তিপূজা ও পুরোহিততন্ত্র ছিল রীতিমতো শোষণমূলক। ইউরোপের মানবতাবাদী চিন্তা, সামাজিক সাম্যের ধারণা বা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের আদর্শ দ্বারা সংস্কারকরা প্রভাবিত হন। ভারতের ইংরাজি শিক্ষিত মানুষরা শুধু নন, প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষরাও ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের বিরোধিতা করেছিলেন।
ধর্ম ও সমাজসংস্কার আন্দোলন :
ধর্ম ও সমাজসংস্কার আন্দোলন পরস্পরের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল কারণ সামাজিক আচার-আচরণের পেছনে ধর্মের সমর্থন ছিল। এজন ধর্মসংস্কারকরা সকলে ছিলেন সমাজসংস্কারক। রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ধর্মশাস্ত্রের সমর্থন নিয়ে (মনুস্মৃতি ও পরাশর স্মৃতি) সমাজসংস্কার করতে চেয়েছিলেন। তাঁরা রক্ষণশীল সমাজকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে সতীদাহ প্রথা বা বিধবার বৈধব্য শাস্ত্র সমর্থন করে না। ইংল্যান্ডে ধর্ম ও সমাজসংস্কারের পক্ষে জনমত তৈরি হয়েছিল, হিতবাদী দর্শনের প্রবক্তা, মিশনারি ও অবাধ বাণিজ্যের পক্ষপাতী মানুষজন মনে করেন যে ভারতের ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের প্রয়োজন আছে।
উনিশ শতকের গোড়ারদিকে ভারতে ধর্ম ও সমাজসংস্কার আন্দোলনের সূচনা করেন রাজা রামমোহন রায়। তাঁকে বলা হয় আধুনিক ভারতের জনক কারণ তিনি সংস্কারের মাধ্যমে ভারতে আধুনিকতার সূচনা করেন। দেশের ধর্মীয় কুসংস্কার, সামাজিক কুপ্রথা, অজ্ঞতা, জাতিভেদ প্রথা এবং নারীজাতির দুরবস্থা তাকে পীড়া দিত। ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি কলকাতায় আত্মীয় সভা স্থাপন করেন এবং ধর্ম ও সমাজসংস্কারের সূচনা করেন। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে বিলাত গমন পর্যন্ত যুক্তিবাদী, মানবতাবাদী এবং ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ রামমোহন ধর্ম, সমাজ ও শিক্ষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি ব্রাহ্মসভা স্থাপন করে একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠা করেন, মূর্তিপূজা ও পুরোহিততন্ত্রের বিরোধিতা করেন। ধর্ম সম্পর্কে তিনি উদার সমন্বয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরই উদ্যোগে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক
১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে সতী আইন পাশ করে সহমরণ নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন। সেযুগের বাংলাদেশে কুলীন প্রথা, বহুবিবাহ, শিশুবিবাহ প্রভৃতির চলন ছিল। রামমোহন এসব সামাজিক কুপ্রথার বিরোধী ছিলেন। স্ত্রীশিক্ষার বিস্তার ও মহিলাদের সম্পত্তিতে অধিকার দানের কথা তিনি চিন্তা করেন। ভারতের মধ্যে বাংলাদেশে প্রথম ইংরাজি শিক্ষার সূচনা হয়, এজন্য বাঙালি অন্যান্য প্রদেশের মানুষের চেয়ে চিন্তা-ভাবনায় অনেক এগিয়েছিল, এখানে ধর্ম ও সমাজসংস্কার আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠেছিল।
হিন্দু কলেজের শিক্ষক ডিরোজিওর ছাত্ররা ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী নামে পরিচিত হয়। এরা ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ ও ‘সোসাইটি ফর দ্য অ্যাকুইজেশন অব জেনারেল নলেজ’ স্থাপন করে পুরোনো কুসংস্কার ও রক্ষণশীল সামাজিক ও ধর্মীয় আচার-আচরণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। সংবাদপত্র এনকোয়ারার, জ্ঞানান্বেষণ ও কুইল স্থাপন করে, পুস্তিকা লিখে এরা সামাজিক কুপ্রথা ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে আক্রমণ করেন। এরা সংস্কারের পক্ষে জনমত গঠন করেন, বিধবা বিবাহ আন্দোলনকে সমর্থন করেন এবং স্ত্রীশিক্ষার প্রসার দাবি করেন। বাংলাদেশে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শিক্ষাবিস্তার এবং নারীমুক্তি আন্দোলনের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন। বিদ্যাসাগর নিজেই লিখেছেন যে বিধবা-বিবাহ আন্দোলন হল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড়ো কাজ। বহুবিবাহ, শিশুবিবাহ এবং কুলীন প্রথার বিরুদ্ধে তিনি লেখনী ধারণ করেন। নারীশিক্ষা বিস্তারের জন্য তিনি পঁয়ত্রিশটি স্কুল স্থাপন করেন। বিদ্যাসাগরের চেষ্টায় সরকার ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে বিধবা-বিবাহ আইন পাশ করেছিল।
বাংলার মতো মহারাষ্ট্রে ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে মহারাষ্ট্রে সাহিত্য ও বিজ্ঞানচর্চার জন্য স্টুডেন্টস লিটারারি ও সায়েন্টিফিক সোসাইটি স্থাপিত হয়। আলিগড়ে স্যার সৈয়দ আহমদ খান এধরনের সায়েন্টিফিক সোসাইটি গঠন করে শিক্ষা ও সামাজিক সংস্কারের সূচনা করেন। মহারাষ্ট্রে আন প্রকাশমণ্ডলী নামে একটি সভা বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনার ব্যবস্থা করেছিল। নারী শিক্ষা বিস্তারের জন্য এরা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিল। ভাওদাজি, শংকর শেঠ, জ্যোতিরাও ফুলে প্রমুখ ব্যক্তিগণ নারীশিক্ষা বিস্তারের আন্দোলন জোরদার করে তোলেন। বিধবা-বিবাহ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন বিষ্ণুশাস্ত্রী পণ্ডিত। আত্মারাম পাণ্ডুরং, গোপাল হরি দেশমুখ প্রমুখ কৃতী মানুষরা সামাজিক কুসংস্কার, অস্পৃশ্যতা, অবিচার, অসাম্য ইত্যাদির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। মহারাষ্ট্রের মধ্যযুগে পুরোহিততন্ত্র বিরোধী, জাতিভেদ প্রথা বিরোধী ভক্তি আন্দোলনের ঐতিহ্য ছিল। আধুনিককালের সংস্কারকরা এই ঐতিহ্যের ওপর দাঁড়িয়ে সংস্কার আন্দোলন পরিচালনা করেন। দাদাভাই মৌরোজি পার্সি সম্প্রদায়ের মধ্যে নারীমুক্তি ও নারীর অধিকার নিয়ে আন্দোলন করেন।
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতে যে ধর্ম ও সমাজসংস্কার আন্দোলন হয়েছিল। তার লক্ষ্য ছিল তিনটি—একেশ্বরবাদের প্রতিষ্ঠা, নারীর মুক্তি ও নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং জাতিভেদ প্রথা থেকে যেসব অনাচার ও বৈষম্য ভারতীয় সমাজে প্রবেশ করেছিল সেগুলি দূর করা। ভারতীয় সমাজে নারীর মর্যাদা ও অধিকার ছিল না, সবধর্ম নারীকে মর্যাদা দেয়নি। ভারতে নিম্নণর্গের মহিলারা কিছু সুযোগ পেত, তাদের পর্দা মানতে হত না, পুনর্বিবাহের অধিকার ছিল। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ভারতীয় সমাজ ছিল পুরুষশাসিত, নারী ও পুরুষের কখনও সমানাধিকার ছিল না। শুধু হিন্দুদের মধ্যে নয়, মুসলমান সমাজের মহিলারাও সমান অধিকার পেত না। মুসলমান সমাজে বহুবিবাহ প্রথা ছিল, হিন্দু সমাজে ছিল শিশুবিবাহ, বহুবিবাহ, কুলীন, সহমরণ প্রথা ইত্যাদি। পিতা বা স্বামীর সম্পত্তিতে নারীর অধিকার স্বীকৃতি পেত না, ভারতের মহিলারা ছিল সম্পূর্ণভাবে পুরুষের অধীন। ভারতীয় সংস্কারকরা নারীকে অধিকার দিয়ে সমাজকে সুস্থ ও সবল করতে চেয়েছিলেন। সতীপ্রথা বন্ধ হয়েছিল, বিধবাকে পুনর্বিবাহের অধিকার দেওয়া হয়, নারী শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়ে সংস্কারকরা সমাজে নারীর অবস্থানকে উন্নত করতে চেয়েছিলেন।
ভারতীয় সমাজের দ্বিতীয় প্রধান ব্যাধি হল জাতিভেদ প্রথা। হিন্দু সমাজ চতুর্বর্ণে বিভক্ত, তাছাড়া রয়েছে বহু জাতি, উপজাতি ও সংকর জাতি। বাংলাদেশে হিন্দুদের মধ্যে পাওয়া যায় ছত্রিশ জাতি, হিন্দু সমাজের একেবারে নিম্নস্তরে রয়েছে চণ্ডাল ও অস্পৃশ্যরা। জাতিভেদ প্রথার প্রধান দুটি বৈশিষ্ট্য হল আন্তবর্ণ বিবাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং পরস্পরের মধ্যে আহার-বিহারে বাধা (রুটি ও বেটির লড়াই)। অস্পৃশ্যরা ছিল সমাজে সবচেয়ে নির্যাতিত, অবহেলিত ও শোষিত। এরা নিম্নস্তরের সাফাইকর্মী, চর্মকার, সংকার কর্মী, এরা উচ্চবর্ণের মানুষের সামনে আসতে পারত না, কুয়ো থেকে জল নিতে পারত না, মন্দিরে প্রবেশাধিকার ছিল না। জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের বিকাশের পক্ষে এগুলি ছিল সবচেয়ে বড়ো বাধা। ভারতের সংস্কারকরা ছিলেন বিদ্বান ও বুদ্ধিমান, তাঁরা এসব উপলব্ধি করেছিলেন। মুসলমান, খ্রিস্টান ও শিখদের মধ্যেও সীমিতভাবে জাতিভেদ ছিল, তবে হিন্দু সমাজের মতো তা এত ভয়ংকর হয়ে ওঠেনি। ব্রাহ্মসমাজ ও প্রার্থনাসমাজ এসবের নিন্দা করেছিল, সরকার জাতিভেদ প্রথা মানেনি, এতে সংস্কারকদের সুবিধা হয়।
মূল্যায়ন :
ধর্ম ও সমাজসংস্কার আন্দোলন ভারতে আধুনিকতার সূত্রপাত করেছিল। পুরোনো সামাজিক আচার-আচরণের কিছু পরিবর্তন অবশ্যই ঘটেছিল, কিন্তু সমাজের ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া এসব সংস্কার সর্বাংশে সার্থক হয়নি। শহরকেন্দ্রিক শিক্ষিত সমাজের মধ্যে ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলন প্রধানত সীমাবদ্ধ ছিল। বৃহত্তর জনগণের মধ্যে এই আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। ভারতের অশিক্ষিত গ্রামীণ মানুষ এসব আন্দোলনের তাৎপর্য বোঝেনি, তাদের জীবনের ওপর এসবের স্থায়ী প্রভাব পড়েনি। উচ্চস্তরের মানুষের মধ্যে সীমিত এই আন্দোলন সাফল্যের জন্য ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কামনা করেছিল। ঔপনিবেশিক আধুনিকতার দুর্বলতা থেকে এই আন্দোলন মুক্ত ছিল না। সংস্কারের ক্ষেত্রে ঐতিহ্য বনাম আধুনিকতার দ্বন্দ্ব চলেছিল। সংস্কার আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল সীমিত, মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটানো সংস্কারকদের উদ্দেশ্য ছিল না।