StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের চরিত্র ও প্রকৃতি আলোচনা করো

 

উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের চরিত্র ও প্রকৃতি আলোচনা করো ।

বাংলার ইতিহাসে উনিশ শতক হল এক বিস্ময়কর যুগ (annus mirabilis)। ব্রিটিশ শাসন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, বুর্জোয়া অর্থনীতি এবং পশ্চিমি সংস্কৃতির বিস্তার এদেশে রেনেসাঁসের পটভূমি তৈরি করে দিয়েছিল। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে বাংলা অনেকখানি এগিয়ে ছিল। পশ্চিমের যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ, উদারপন্থা ও বিজ্ঞান জিজ্ঞাসা বাঙালি মানসে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। এজন্য বলা হয় ভারতের নবজাগরণে বাংলার সেই ভূমিকা ইউরোপীয় নবজাগরণে ইতালির যে ভূমিকা ছিল। ইতালি গ্রিকো-রোমান সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে ইউরোপীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলিয়ে এক অসাধারণ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল যা আজও ইউরোপীয় জীবনধারার ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে আছে।

উনিশ শতকের ভারতীয় মনীষীরা অতীতকে আবিষ্কার করে পশ্চিমি সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিয়ে নতুন সংস্কৃতির পত্তন করলেন। এজন্য অনেকে বলে থাকেন প্রাচ্যবাদীরা হলেন বাংলার নবজাগরণের স্রষ্টা। ডেভিড কফ এধরনের অভিমত প্রকাশ করেছেন, জোন্স, উইলকিনসন, উইলসন ও প্রিন্সেপরা হলেন এই নবজাগরণের সূচনাকারী। অন্য মতে, এই নবজাগরণের স্রষ্টা হলেন বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় যারা ভদ্রলোক নামে পরিচিত। ব্রিটিশ শাসন এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত স্থাপিত হলে বাঙালি সমাজের সম্পন্ন মানুষরা জমিদারি কিনেছিল। উনিশ শতকের ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে এই জমিদারি লাভজনক হয়ে উঠতে থাকে। সমাজে স্থিতিশীলতা এসেছিল, ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়তে থাকে, বাঙালিবাবু সওদাগরি অফিসে চাকরি পেয়েছিল। অফিস-আদালত গড়ে উঠলে পেশাদারি বৃত্তিতে তারা নিযুক্ত হয়। এই জমি, চাকরি ও পেশা নির্ভর বাঙালি হল নবজাগরণের হোতা, ধারক ও বাহক।

জন্মলগ্ন থেকে বাংলার নবজাগরণের চরিত্র ও প্রকৃতি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। স্যার যদুনাথ একে এক সত্যিকারের নবজাগরণ বলে অভিহিত করেন। তাঁর মতে, এই নবজাগরণ ইউরোপীয় নবজাগরণের চেয়ে গভীরতর ও ব্যাপকতর ছিল, ছিল আরও বেশি বৈপ্লবিক রূপান্তরের ঘটনা (It was truly a renaissance, wider, deeper and more revolutionary than that of Europe after the fall of constantinople)। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখছেন : “ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালির ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতিক চেতনা, দেশপ্রীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে সমুদয় উন্নতি বাঙালিকে গৌরবের সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠাইয়াছিল, অষ্টাদশ শতাব্দীতে তাহার বিন্দুমাত্র সূচনা বা সম্ভাবনা দেখা যায় নাই। এই সমুদয় গুরুতর পরিবর্তনের ফলে বাঙালির জাতীয় জীবনে যে নবজাগরণের সূত্রপাত হইয়াছিল এবং যাহা ক্রমে সমুদয়। 

ভারতবর্ষে বিস্তৃত হইয়া নবীন ভারত গঠন করিয়াছে, পৃথিবীর যে-কোনো দেশের ইতিহাসে তাহা এক গৌরবময় অধ্যায় বলিয়া পরিগণিত হইবার যোগ্য’। কাজি আবদুল ওদুদ, শিবনারায়ণ রায়, ডেভিড কফ ও নরহরি কবিরাজ সকলে উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের পরিচয় দিয়েছেন। ডেভিড কফ জানিয়েছেন যে ভারতবিদ্যা চর্চার শুরু থেকে ব্রিটিশ প্রশাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলায় নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল। বাংলায় সামস্ত ব্যবস্থার উচ্ছেদ করে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী বুর্জোয়া ধনতন্ত্রের উত্থানের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল। অনেকে এমন অভিমত দিয়েছেন ব্রিটিশ পূর্ববর্তী নৈরাজ্য দূর করে ব্রিটিশ শাসন নবজাগরণের সূচনা করেছিল। আবার অনেকে এমন ধারণা প্রচার করেছেন যে নবজাগরণ ছিল মূলত ও প্রধানত শিক্ষিত ভদ্রলোক শ্রেণির অবদান, আর এরা সকলেই ছিলেন হিন্দু। এজন্য নবজাগরণ পরবর্তীকালে হিন্দু পুনরুত্থানের রূপ নিয়েছিল। জাতিকে সর্ব বিষয়ে উন্নত ও সমৃদ্ধ করাই ছিল এই নবজাগৃতির লক্ষ্য। এই হিন্দু জাগৃতির উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু জাতিকে অধঃপতন হইতে তুলিয়া জগতের শ্রেষ্ঠ ও সমৃদ্ধিশালী জাতিসমূহের পাশে একই মর্যাদাসম্পন্ন উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠিত করা”।

নবজাগরণের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অনেকে দেখেছেন এর সামন্ততন্ত্র বিরোধী চরিত্র, আধ্যাত্মিকতা, জাতীয়তাবাদের স্ফুরণ এবং রাজনৈতিক চেতনার উদ্বোধন। অনেক মনীষী ভারতের হিন্দুধর্মকে তার আধুনিকতার পথে সবচেয়ে বড়ো বাধা হিসেবে গণ্য করেন, এজন্য ধর্মের সংস্কারকে তাঁরা প্রাধান্য দেন। রামমোহন, দেবেন্দ্রনাথ, কেশবচন্দ্র ও রামকৃষ্ণদেব সকলে একেশ্বরবাদী ধর্মের প্রতিষ্ঠা চেয়েছিলেন। পুরোহিতত্য ও আচার সর্বস্বতাকে তাঁরা মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন, শাস্ত্রবচন ও গুরুবাদের জায়গায় তাঁরা স্থান দেন জ্ঞান, যুক্তি ও নৈতিকতাকে। বাংলার রেনেসাঁসের মধ্যে অবশ্যই ধর্মজিজ্ঞাসা বিশিষ্ট স্থান গ্রহণ করেছিল। সুশোভন সরকার এর মধ্যে লক্ষ করেন।

মানবতাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি, মানুষকে মর্যাদা দানের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছিল। ইতালির রেনেসাঁসে মানুষকে সৃষ্টির কেন্দ্রস্থিত চরিত্র হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল (Man is the measure of all things)। বাংলার নবজাগরণের ওপর ইউরোপীয় উদারনীতিবাদের প্রভাব পড়েছিল। সমাজ ও ব্যক্তির মঙ্গলের জন্য কতকগুলি অধিকারের প্রয়োজন হয়। ফরাসি বিপ্লবী দার্শনিকরা এই ধারার অগ্রগতি ঘটিয়েছিলেন, উনিশ শতকের বাঙালি মনীষীরা এদের চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। হিতবাদ, উদারনীতিবাদ, দৃষ্টবাদ প্রভৃতি দর্শনের উল্লেখ এদের লেখায় পাওয়া যায়। মধ্যযুগের চিন্তাভাবনার ওপর ধর্মের প্রভাব ছিল গভীর, ইতালি থেকে এই ধর্মের নিগড় ভাঙার প্রয়াস শুরু হয়েছিল। মানুষ জাগতিক ও আধ্যাত্মিক জীবনকে পৃথক করতে শিখেছিল।নবজাগরণের স্রষ্টারা সর্ব ধর্মের মানুষের মঙ্গলের কথা বলেছেন, ইসলামের যুক্তিবাদী ও সমন্বয়বাদী চিন্তার প্রভাব অনেকের ওপর লক্ষ করা যায়।

ইতালির রেনেসাঁসের শ্রেষ্ঠ অবদান হল তার শিল্প, বাংলার নবজাগরণের শ্রেষ্ঠ ফসল হল তার সাহিত্য ও শিল্প। সাহিত্য ও শিল্পে বাঙালি মননের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে। নতুন যুগের বণিক শ্রেণির মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটেছে। নগরে নগরে সাহিত্যসভা, দর্শন সভা, বিজ্ঞান সভা প্রভৃতি বিবিধ বিষৎসভা প্রতিষ্ঠা হতে লাগল। বিত্তবান ও বিদ্বানরা এসব সভায় মিলিত হয়ে নবযুগের নানা বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে লাগলেন। লাইব্রেরি ও বিতর্ক সভার বিস্তার হতে লাগল। নবজাগরণ ও নতুন সংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে উঠল এই সভাগুলি। ১৮১৮-৭৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ৭১টি বাংলা পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয় যাদের মাধ্যমে এদেশের মানুষের আত্মপ্রকাশের ব্যাকুলতা প্রকাশ পেয়েছিল। এই নবজাগরণের প্রাণকেন্দ্র হল মহানগর কলকাতা এবং পার্শ্ববর্তী ক্রমবর্ধমান মফস্সল শহরগুলি। এই রেনেসাঁস অবশ্যই শহরকেন্দ্রিক, ইতালির রেনেসাঁসও শহরকেন্দ্রিক ছিল। নবজাগরণের এটি হল এক সীমাবদ্ধতা।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *