উনিশ শতকে ভারতে হিন্দু পুনর্জাগরণবাদের পটভূমি বা প্রেক্ষাপট আলোচনা কর
ভূমিকা :
উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে ভারতে হিন্দু পুনর্জাগরণবাদের সূচনা হয়েছিল। চরমপন্থীদের চিন্তাভাবনার মধ্য দিয়ে এর প্রথম প্রকাশ ঘটেছিল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দেশকে মাতা হিসেবে দেখালেন, মাতৃবন্দনা করলেন বন্দেমাতরম্। চরমপন্থী নেতারা বঙ্কিমের চিন্তাভাবনা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। দেশের মুক্তির আদর্শকে গ্রহণ করে আত্মত্যাগের কথা বলেন। প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবনের কথা এরা বলেছিলেন।
ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাসের যে ব্যাখ্যা ইংরেজ ঐতিহাসিকরা দিয়েছিলেন এরা তার দ্বারা প্রভাবিত হন। মিল থেকে ভিনসেন্ট স্মিথ সকলে মধ্যযুগের ইতিহাসকে বলেছেন অত্যাচারী শাসনকাল। চরমপন্থীরা মধ্যযুগের শাসনকে সেভাবে দেখেছিলেন। মোগল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শিবাজি, রানা প্রতাপ ও প্রতাপাদিত্যের সংগ্রামকে এরা জাতীয় সংগ্রাম বলে প্রচার করেন। চরমপন্থীদের প্রাচীন ভারতের সংস্কৃতি প্রীতি এবং মধ্যযুগের হিন্দু বীরদের সংগ্রামকে জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করার প্রয়াস হলে মুসলমানরা ক্ষুণ্ণ হন।
হিন্দু পুনর্জাগরণবাদের পটভূমি / প্রেক্ষাপট
স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী আর্যসমাজ প্রতিষ্ঠা করলে হিন্দুত্ববাদ আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। আর্যসমাজ শুদ্ধি ও সংগঠনের ওপর জোর দিলে মুসলমানরা তবলিগ ও তনজিম আন্দোলন শুরু করেছিল। আর্যসমাজ ধর্মান্তরিত হিন্দুদের স্বধর্মে ফেরার জন্য শুদ্ধির ব্যবস্থা করেছিল। আর্যসমাজ মুসলমান ও খ্রিস্টান বিরোধী অবস্থান নিয়েছিল, হিন্দু সমাজের সব দুর্ভাগ্যের জন্য এদের দায়ী করা হয়। হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য সংগঠনের ওপর জোর দেওয়া হয়। আর্যসমাজ আন্দোলন পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে প্রভাব বিস্তার করেছিল।
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম লিগ প্রতিষ্ঠার আগে থেকে নানাকারণে মুসলমান স্বাতন্ত্র্যবাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী ও মুসলিম স্বার্থরক্ষার দাবি নিয়ে মুসলিম প্রতিনিধিরা গভর্নর-জেনারেল লর্ড মিন্টোর সঙ্গে সিমলাতে দেখা করেন। স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলনের সময় হিন্দু ও মুসলমান স্বার্থের সংঘাত ঘটেছিল, স্বদেশি ও বয়কট নিয়ে পূর্ববঙ্গের কয়েকটি স্থানে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ঘটনা ঘটেছিল। মুসলমানদের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছিল, এতে রক্ষণশীল ও গোঁড়া হিন্দুরা ভয় পেয়েছিল। হিন্দু স্বার্থরক্ষার জন্য এদেশের রাজা, মহারাজা ও ভূস্বামীরা উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছিলেন। পাঞ্জাবে হিন্দুদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাবের উদ্ভব লক্ষ করা যায়। পাঞ্জাবের লাজপত রায় হিন্দু সভা গঠনে বিশেষ উদ্যোগ নেন। তিনি আর্যসমাজের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।
১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবে হিন্দুসভা স্থাপিত হয়, ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে সেখানে প্রাদেশিক হিন্দু সম্মেলন বসেছিল। লাজপত রায় তাঁর বক্তৃতায় হিন্দুদের একটি পৃথক জাতি বলে উল্লেখ করেন। উত্তরপ্রদেশে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে দুটি বিষয় নিয়ে বিরোধ চলেছিল— হিন্দি বনাম উর্দু ও গোহত্যা। হিন্দুরা ধরে নিয়েছিল হিন্দি হল হিন্দুদের ভাষা আর উর্দু হল মুসলমানদের। হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুত্ব নিয়ে একধরনের গর্ববোধ ও আত্মম্ভরিতা প্রকাশ পেতে থাকে, মুসলমানরা ক্ষুণ্ণ হয়। উত্তরপ্রদেশে সরকারি ভাষা হিসেবে হিন্দিকে প্রতিষ্ঠাদানের জন্য হিন্দুদের উৎসাহের সীমা ছিল না। তেমনি আর্যসমাজ ও অন্যান্য হিন্দু প্রতিষ্ঠান গোরক্ষাকে কর্তব্য বলে প্রচার করতে থাকে, গো-রক্ষিণী সভা স্থাপিত হয়। মসজিদের সামনে গান-বাজনা ও শোভাযাত্রা নিয়ে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মাঝে মাঝে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটত।
হিন্দু পুনর্জাগরণবাদের পিছনে তিনটি কারণ ঐতিহাসিকরা লক্ষ করেছেন। একটি হল মুসলমান সম্প্রদায়ের নিজের ধর্ম ও সংস্কৃতি রক্ষার তাগিদ, অহেতুক ভয় ও অবিশ্বাস। মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদ থেকে হিন্দু স্বাতন্ত্র্যবাদের জন্ম হয়েছিল বলে অনেকে অনুমান করেন। মুসলিমরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অতিমাত্রায় সচেতনতা দেখালে হিন্দুরাও মুসলমানদের মতো ‘হিন্দুত্ব বিপন্ন’ এই জিগির তুলে ঐক্যবদ্ধ হতে চেয়েছিল। হিন্দুরা ব্রিটিশ সরকারের তোষণনীতিকে মুসলমানদের বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্য দায়ী করে নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধ হবার প্রয়োজন বোধ করেছিল।
হিন্দু পুনর্জাগরণবাদের পিছনে ব্রিটিশ সরকারের ‘বিভাজন ও শাসননীতি’ অনেকখানি দায়ী ছিল। ভারতের দুই প্রধান সম্প্রদায়কে বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন রেখে সরকার নিজের সাম্রাজ্যবাদী শাসনকে অক্ষুণ্ণ রাখতে চেয়েছিল। গোঁড়া রক্ষণশীল হিন্দুরা কংগ্রেসের মুসলমান তোষণনীতিকে আক্রমণ করেছিল। কংগ্রেসের প্রতি এধরনের হিন্দুদের বিদ্বেষ তৈরি হয়েছিল। হিন্দুদের মধ্যে এই স্বাতন্ত্র্যবাদী চিন্তাভাবনার প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয় ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে হরিদ্বারের কুত্তমেলায়। গঠিত হয় হিন্দু মহাসভা। মদনমোহন মালব্য, তেজবাহাদুর সপ্রু, লালা হংসরাজ ও অন্যান্য ব্যক্তিরা এর সঙ্গে যুক্ত হন। মুসলিম লিগের মতো হিন্দু মহাসভার সঙ্গে যুক্ত হন ধনী ও প্রভাবশালী উচ্চবর্ণের হিন্দুরা। হিন্দু মহাসভা মুসলমানদের সঙ্গে সমঝোতার বিরোধী ছিল। এরা মনে করত ভারতবর্ষ হল হিন্দুদের দেশ, মুসলমানরা বিদেশি, ভারতীয়রা খাঁটি আর্য, ভারতবর্ষ আর্যদের আদি বাসভূমি।
হিন্দু মহাসভা উত্তর ভারতের পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে প্রভাব বিস্তার করেছিল। নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে ধর্মপ্রচার, ধর্মান্তরিতদের স্বধর্মে ফিরিয়ে আনা, হিন্দির প্রচার, গোরক্ষা ইত্যাদি মহাসভার কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল। বিনায়ক দামোদর সাভারকর ‘এসেন্স অন হিন্দুত্ব’ পুস্তিকায় হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতিকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করেন। তাঁর হিন্দুত্বের ধারণা ছিল অবশ্যই সাম্প্রদায়িক, পুরুষতান্ত্রিক এবং অবশ্যই মুসলমান বিরোধী। উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ঘটনা ঘটত। এতে হিন্দুত্ববাদীরা উৎসাহিত হয়ে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে গঠন করেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ। এটি হল হিন্দু পুনর্জাগরণবাদের সবচেয়ে বড়ো ঘটনা।
কে. বি. হেডগেওয়ার ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান সংগঠক। হিন্দুত্ববাদ ক্রমশ জঙ্গি ও অসহিষ্ণু হয়ে উঠতে থাকে। আত্মরক্ষার তাগিদে এই হিন্দু সংগঠনটি শারীরিক শক্তি অর্জনের ওপর জোর দিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল। বিভিন্ন অঞ্চলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের শাখা স্থাপিত হয়। পশ্চিমি শিক্ষায় শিক্ষিত হিন্দুরা এর পৃষ্ঠপোষকতা না করলেও নিম্নবর্ণের হিন্দু ও উচ্চসম্পদশালী হিন্দুরা একে উৎসাহ ও সমর্থন জোগাতে থাকে। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে বারাণসীতে হিন্দু মহাসভার সম্মেলনে হিন্দিভাষী অঞ্চল থেকে এসেছিল ৮৬.৮ শতাংশ প্রতিনিধি, বাংলা, বোম্বে ও মাদ্রাজ থেকে এসেছিল মাত্র ৬.৬ শতাংশ। বিজয়া দশমীকে এরা প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে পালন করত, এদের পতাকা ছিল গেরুয়া রং এর। এরা কংগ্রেস পরিচালিত জাতীয় আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল কারণ এরা ধরে নিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার রুষ্ট হলে হিন্দুদের ক্ষতি হবে, মুসলমানদের লাভ হবে।
১৯২১-২৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মধ্যে সমঝোতা স্থাপনের ক্ষেত্রে হিন্দু মহাসভা ছিল একটি বড়ো বাধা। এই সভা মুসলমানদের ন্যায্য দাবিগুলি মেনে নিয়ে বহুত্ববাদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ জাতিরাষ্ট্র গঠনের কথা ভাবেনি তবে অখণ্ড ভারতের কথা বলেছিল।
উপসংহার :
মতিলাল নেহরু ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধানের যে খসড়া প্রস্তুত করেছিলেন হিন্দু মহাসভা তার বিরোধিতা করেছিল। এই সভা স্বাধীনতা আন্দোলনের কোনো পর্বে জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে সহযোগিতা করেনি। বরং সাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রকাশ করে হিন্দু ও মুসলমান ঐক্যের পথে নানা বাধার সৃষ্টি করেছিল। জিন্নাহ্ এদের ওপর বিরক্ত হয়ে মুসলমানদের জন্য চোদ্দ দফা দাবিপত্র রচনা করেন। ভারত বিভাজনের জন্য হিন্দু পুনর্জাগরণবাদের অবদান নেহাত কম ছিল না। মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠের উগ্র আগ্রাসী জাতীয়তাবাদকে ভয় পেয়েছিল।